মগশেল বিচে একদিন

পাহাড়ের পেছনে সূর্যাস্ত
পাহাড়ের পেছনে সূর্যাস্ত

ওমানের সালালাহে এই সময়টা বেশ গরম থাকে। এখন রাত। রাতের তাপমান ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু বোধ হচ্ছে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর বাতাসের আর্দ্রতা হলো ৮৮ শতাংশ। অল্প একটুক্ষণ চুলার পাশে থাকলে ঘেমে নেয়ে একাকার। আকাশ জুড়ে মেঘ, কিন্তু মেঘে বর্ষণ নেই। সকালের শুরুতেই সূর্য বেশ কড়া মেজাজে মাথার ঘিলু ভাজি করতে থাকে। যা হোক, যেই দেশে যা যথাযথ।

গত শনিবারটা ছিল বেশ গরম একটা সকাল। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল কোনো কারণ ছাড়াই। মনে হচ্ছিল হাঁক ছেড়ে কান্না করি। এমন একটা সকালে আমার পরম বন্ধুটি ঠিক বুঝে গিয়েছিল তার বেটার হাফের মেজাজ ফোরটি নাইন। বড় কন্যার স্কুলে কুইজ প্রতিযোগিতা। সকাল সকাল শেষ হয়ে গেল। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে হাঁকডাক করে একাকার।

এই ছুটির দিন...এখনো রেডি হও নাই! তাড়াতাড়ি চলো, কাছেই কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। আসলে বৃষ্টির একটা সংকেত আবহাওয়া বিভাগ জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তা হবে রোববার সকাল ৬টা থেকে। বৃষ্টির কথা শুনতেই আমার কী যে হয়ে গেল! সত্যি আমি জামা-কাপড় পরে তৈরি।

কাউকে বোঝাতে পারব না। আমি বাচ্চাদের নিয়ে ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাড়িতে পৌঁছে গেলাম। কারও চুল আঁচড়ানো বাকি। কারও মুখে ভরা ডিম, কেউ বা গল্পের বইয়ে মুখ ডুবানো। কিন্তু আমরা সবাই বেড়াতে বের হয়ে গেলাম। আহা! আকাশজুড়ে আসলেই ঘন মেঘ। মেঘগুলো একটু কালোও বটে।

গত বছরও আজকের দিনে আকাশে কালো মেঘ দেখে বাহন ছুটিয়ে মেঘ তাড়া করে আমরা বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। তাই সঙ্গীর ওপর আমার শতভাগ ভরসা। সে যখন বলেছে ভরসা করা যায়। আমাদের নিয়ে হাওয়াই জাহাজ মেঘের পিছু ছুট। এই হাওয়াই জাহাজ হলো আমাদের চার চাকার বাহন।

মগশেল পৌঁছাতেই গুটিকয়েক সুন্দর উট সম্ভাষণ জানাল। তারা আমাদের দেখে বেশ খুশি। একজনতো আন্তরিকতার নিদর্শন রাখতে দিয়ে ক্যামেরায় সুন্দর সুন্দর পোজ দিতে লাগল। একপর্যায়ে তার মনে হলো জিনিসটা খাওয়া গেলে কেমন হয়। আমার ভিতু বর উটের মুখ আর ক্যামেরার নৈকট্য বুঝতে পেরে দুই লাফে পেছনে চলে গেল। বেচারা সুন্দরী উট আরও আগ্রহ ভরে ক্যামেরার দিকে আগাতে লাগল।

মগশেল বিচ
মগশেল বিচ

আমাদের মেজ কন্যা যে বাসা থেকে মুখ ভরা ডিম নিয়ে রওনা দিয়েছিল তার মনে হলো উটগুলো ক্ষুধার্ত। মনের আনন্দে গাড়ি থেকে কয়েকটা কাপ কেক কাগজ খুলে খুলে উটদের খাওয়াতে লাগল। আমি মনে মনে লজ্জিত হলাম। আরও কাপকেক দরকার ছিল। উটগুলো মুখের নড়নচড়ন করে সুন্দর টুক টুক করে কেকগুলো খাচ্ছিল। উট সুন্দরীর কাছে মাফ চাইলাম মনে মনে।

এবার এক ইতালীয় দম্পতি গাড়ি থামিয়ে আমাদের দিকে আসছে। দুজনই সুন্দর কিন্তু গরমে একদম কাবু। লোকটার হাতে একটা ম্যাপ। ম্যাপের একটা অংশে হাত দিয়ে জানতে চাচ্ছে জায়গাটা কোথায়? জায়গাটার নাম হলো মগশেল। চোখে চশমা দিয়ে যেমন আমরা চশমা খুঁজে মরি, ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম। ভদ্রলোক মগশেলে পৌঁছানোর খুশিতে কিছু লতাপাতা নিয়ে কেক ভক্ষণরত উটের কাছে গেলেন। উট পারলে তার হাতসহ খেয়ে ফেলে।

বিচে রোদ্দুর মেখে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। তারপর স্বভাবমতো বালুর পরে বসে নকশা বানাতে লাগলাম। আর পিচ্চিগুলো ক্যাসেল বানাতে বসে গেল। পাশ দিয়ে বেশ কিছু লাল কাঁকড়া ছুটে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে। সাগরের জলরাশি খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।

একটু হেঁটে ওপরে উঠলেই মারনিফ কেইভ। তারপর আবার কিছুটা পথে নামতে হবে। নামার সময় যে ভিউ পাওয়া যায় তা কী যে অসম্ভব সুন্দর!

এই বিচে একটা মজার জিনিস আছে। তা হলো ব্লো হোল। আমার ছোট মেয়ে বলে ‘Lion roar’. বিচের পাথরের অংশে কোনো কারণে ছিদ্র আছে। যেটা দিয়ে প্রথমে বাতাস ঢুকে সিংহের গর্জনের মতো আওয়াজের সৃষ্টি করে। পরে সাগরজল ঢুকে ভুস করে ওপরে উঠে আসে। আশপাশের সকলে মজা করে তাতে ভেজে। একটা নয়, অনেকগুলো ব্লো হোল আছে।

জলরাশি
জলরাশি

যা হোক, রোদ্দুরে পুড়তে পুড়তে ক্লান্ত হয়ে নিচে নেমে সেখানে মক্কা ক্যাফেতে ঢুকলাম নাশতা সারতে। ক্লাব স্যান্ডউইচ, সোলেমানি চা (নান্নাপাতা দিয়ে রং চা), আলু ভাজা (ফ্রেঞ্চ ফাই) আর নাগেটস অর্ডার করলাম। এত কিছুর সঙ্গে কুকিজ ফ্রি। আর ঘাম! আহা সমুদ্রপাড়ের চিটচিটে গরমে আমরা ঘেমেনেয়ে বিধ্বস্ত। ওদিকে মারনিফ কেইভ দেখে আরও অনেকের সঙ্গে সেই ইতালীয় দম্পতিও হাজির।

আমার একটা গুণ বা দোষ আছে, তা হলো সমুদ্রপাড়ে বসে আমি ঢেউ গুনব না তা হবে না। আর পরিচিত বা অপরিচিত মানুষ দেখলে একটা হাসি দেব। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সব সময় ভালো প্রত্যুত্তর পাই না। তারপরও কখনো কখনো রাইট ক্লিক পড়ে যায়। তখন আমি অজানা মানুষটার সঙ্গে গল্প করতে পারি। আমার সঙ্গে আরও চারজন মানুষ ছিল, তারা আমার কেচ্ছাকাহিনি দেখে গাড়িতে গিয়ে উঠল।

বেচারা ইতালির দুই মানুষ। তারা মিট ওমান নামক ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে ওমান এসেছে ঘুরতে। চুক্তি অনুযায়ী তাদের মাসকাট, সুর আর সালালাহ দেখানো হবে। কিন্তু সালালাহ নয়, শুধু মগশেল দেখতে বলা হয়েছে এবং সেই রাতেই তাদের ইতালি ফেরত যাওয়ার ফ্লাইট। আমার বেশ দুঃখ হলো। অনেকগুলো টাকা খরচ করে, ছুটিছাটা কুড়িয়ে তবেই তারা এখানে পৌঁছেছে।

তারা আমাকে বলল, ‘you are in heaven, and we are jelous. This Salalah is beautiful. We will come soon only to see Salalah ’.

Then come after khareef, just after August. You can enjoy the Green Salalah at that time. That’s the original beauty of Salalah. আমি বললাম। নিজের পরিচয় দিলাম, কিন্তু তাদের দুজনের নাম জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গিয়েছিলাম-‘I’m from Bangladesh. The actual heaven you’ll enjoy there in Bandarban, Khagrachori, Rangamati, Kaptai, Shundorbon, Sylhet, Shunamgonj, even in Dhaka.

তারা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘We had a plan to visit Bangladesh once. We know about the beautyful rain & the green Sylhet. But but we don’t know why we are not making a plan to visit Bangladesh.’

জীবনসঙ্গীর সঙ্গে লেখিকা। তাদের পেছনে একটা ব্লো হোল দেখা যাচ্ছে
জীবনসঙ্গীর সঙ্গে লেখিকা। তাদের পেছনে একটা ব্লো হোল দেখা যাচ্ছে

সব কথা সব সময় বলা যায় না। যারা ভ্রমণপিপাসু তারা অনেক কারণেই নিরাপদবোধ করেন না বাংলাদেশ ভ্রমণে। অতি ভদ্র ইতালীয় জুটির বোকা বোকা হাসিতে অনেক কিছু বোঝা হয়ে গেল। তারপরও দাওয়াত দিলাম আমার সবুজ-শ্যামল দেশটিতে ঘুরতে যাওয়ার। তারা হাসিমুখ বিদায় নিলেন। তাদের সময় ছিল না, সময় থাকলে বগলদাবা করে আমরা তাদের ‘শাত’-এ নিয়ে যেতাম।

আমরা পেটপূজা শেষে শাত-এ রওনা হলাম। মেঘের দেশ, মেঘময় পরিবেশ শাত। পাহাড়ের প্রাচীর ডিঙিয়ে তবেই শাত-এর দেখা মিলবে। দুটো বড় পাহাড় কেটে কখনো ঢালু কখনো বা খাঁড়া রাস্তা সোজা উঠে গিয়েছে। চারদিকে পাহাড়, সেই পাহাড়ের বুক চিরে রাস্তা, কী সুন্দর যে রাস্তার বিন্যাস তা কেবল চেয়ে চেয়ে দেখি।

শাতের গল্প অন্যদিন শোনাব।

ফেরার পথে বিচে বসে সূর্যাস্ত দেখলাম পাহাড়ের পেছনে। হলুদ সূর্যটা খুব ধীরে ধীরে অস্তগামী হলো। আমরাও বাড়ির পথ ধরলাম।

(১০ অক্টোবর ২০১৮)