উন্নয়ন মেলা আমার চাঁদের হাট

মেলায় পিঠাঘরের স্টল
মেলায় পিঠাঘরের স্টল

একটি পরিবার, একটি সমাজ, একটি দেশ ও একটি জাতি নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া উন্নতি বা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে না। এই বিবেচনায় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে সরকারি ও বিরোধী দুই দলের প্রধান ও জাতীয় সংসদের স্পিকারও নারী। উন্নয়ন মেলায় সেই চিত্রটিই তুলে ধরার চেষ্টা চালানো হয়েছে।

সেদিন (৪ অক্টোবর) আবুধাবির বাংলাদেশ স্কুলে উন্নয়ন মেলার আয়োজন করা হলো। ইসলামিয়া স্কুলের অডিটোরিয়ামে ছিল বর্ণাঢ্য এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ দূতাবাসেরই উদ্যোগ।

পুরস্কার বিতরণী
পুরস্কার বিতরণী

ঝুনঝুন ময়না নাচো না...। মঞ্চে নৃত্য চলছে। তা থৈ, তা থৈ নাচো না...বুলবুল পাখি গাও না...গুনগুন গুনগুন গাও না...। ছোটরা নাচের মধ্য দিয়ে আনন্দের ঘোষণা দিচ্ছে।...মোর পিয়া ঘরে আজ এসেছে … বাংলাদেশের শিশুরা ছাড়া কেউ এমন বার্তা দিতে পারে না। তার কারণ, উন্নয়নের একটা পর্যায় ছুঁই ছুঁই আমরা।

এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় বিজয়ের পদচিহ্ন এঁকে চলেছেন বাংলাদেশের অদম্য ও আলোকিত নারীরা। প্রশাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্য আর অগ্রযাত্রা আজ তার। সেনা-বিমান-নৌবাহিনী, পুলিশ, আনসার ও বিজিবিসহ সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। এখন বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন নারী। দেখুন, অনুপম এক দৃশ্য! তিনি একজন নারী। মেজর জেনারেল পদক পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাকে। এমন সুখবর প্রতিদিন!

ফারলুনা হকের জীবন্তিকার একটি দৃশ্য
ফারলুনা হকের জীবন্তিকার একটি দৃশ্য

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছে বাংলার সন্তানেরা। এই ত্যাগ, সাহস আর শৌর্য বীর্য জাতিকে এনে দিয়েছে একটি মানচিত্র, একটি পতাকা। আজকের জয় তারই ধারাবাহিকতা। কিশোরী এবারও সঁপে দেয় তার মন প্রাণ। সালাম জানাই মুক্তিযোদ্ধাকে, যদিও যুদ্ধ দেখিনি। নাচের কথা ছিল এটা। পূর্ণা শবনম খন্দকার মুক্তিযোদ্ধার ঘরের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তারও আছে এক গল্প। মহিলা সমিতির সভাপতি সে গল্প ভাঙতে চেয়েছিলেন। তার আগেই পূর্ণা বললেন, নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দলকে জিততে হবে। তিনি যোগ করেন, সে জন্যই এই মেলার গুরুত্ব অনেক।

নারীর ক্ষমতায়ন কর্মসূচি নিয়ে বাংলাদেশের চলা। এ সম্পর্কে মহিলা সমিতির সভাপতি জাকিয়া হাসনাত ইমরান বলেন, দেশের এত উন্নয়ন প্রধানমন্ত্রীর জন্য। নারীর ক্ষমতায়নে তাঁর অবদান অসামান্য। গর্ব করি, তিনি নারী ও তাঁরই কারণে দেশ আজ এত দূর এগিয়ে এসেছে। দেশের উন্নয়নে তাবৎ নারীদের ভূমিকা তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

মঞ্চে তখন জীবন্তিকা দেখছিলাম। রচনা ও পরিচালনা দুইই করেছেন ফারলুনা হক। কৃষক ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন, স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না তৃণমূল মানুষটিও—দেখালেন কত শিল্পিত ভাবে। দেশে রেমিট্যান্স পাচ্ছেন মা, ফোনে তারই ছেলের সঙ্গে কথা। ডিজিটাল বাংলাদেশ, সবার জন্য বিদ্যুৎ ইত্যাকার কর্মকাণ্ড চমৎকার করে তুলে এনেছেন।

মহিলা সমিতির স্টল
মহিলা সমিতির স্টল

একের পর এক সাফল্যের জোয়ার বয়ে আনছে বাংলাদেশের মেয়েরা। সাফ অনূর্ধ্ব ১৫ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ঘরে তুলে নিয়েছে তারা। নামের পাশে ‘অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন’ কথাটা এখন তাদের জন্যই প্রযোজ্য। বাংলাদেশে স্কুল স্টলে এলাম। জাকিয়া সুলতানা বলেন, আনন্দের বন্যা বইছে দেশে। আমরা আনন্দিত, উদ্বেলিত-বললেন, মুখ ভরা হাসি নিয়ে।

গান টি মুখরিত করে গোটা হল। সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি, ও আমার বাংলাদেশ। সুর তাল দুই-ই মোহগ্রস্ত করে সবাইকে। ছোটরা নাচে।

দেশ থেকে বাল্যবিবাহ নামের বিষবৃক্ষের গোড়া সমূলে উৎপাটন করার অভিযান চলছে। সমাজ তাকে সহযোগিতা দিচ্ছে। কিশোরী নিজেও এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার সাহস সঞ্চয় করেছে। সে সমাজকে নানা কুসংস্কারের হাত থেকে রক্ষায় রাখছে অসাধারণ অবদান। জনতা ব্যাংকের স্টলে দাঁড়িয়ে মাসুমা খান। এ মেলা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনেক কিছু এনে দিয়েছে। রুবাইয়া খানম বলেন, ছোটদের নিয়ে সবাই একসঙ্গে হয়েছি। অসম্ভব ভালো লাগছে।

তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নাজিয়া, রুমাইয়া ও সাদিয়া। ওরা মঞ্চে ছিল। ভালো লাগল নেচে, বলল সমস্বরে। একজন জানাল, দেশে যেতে ইচ্ছে করে। ওদের সঙ্গে গল্প করি। ওরা বিনা মূল্যে বই পেয়েছে।

শেখ হাসিনার সরকার মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে ব্যাপক জোর দিয়েছেন। প্রতি বছর বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়। বাহ্, কী মনোলোভা সুযোগ!

উন্নয়ন মেলা সম্পর্কেই কথা।

জাকিয়া হাসনাত ইমরানের সঙ্গে মেলায় আগত কয়েকজন
জাকিয়া হাসনাত ইমরানের সঙ্গে মেলায় আগত কয়েকজন

সুন্দর মুখের কারিশমা ইনাম। মিষ্টি করেই বললেন তার পর্যবেক্ষণ। এই মেলার মধ্য দিয়ে অনেক কিছু জানা হলো। জানালেন, এই-ই তার জীবনে প্রথম পিঠা বানানো। আজ জন্মদিন, মাধুর্যের উচ্চারণ তার। আমি শুভেচ্ছা জানাই।

ফেরদৌস আরা বললেন, পিঠা বাঙালির ঐতিহ্য। আজ এরই আয়োজন দেখতে পেল ছোটরা। মন্তব্য করেন, এ এক বড় অর্জন। আনোয়ারা আক্তার ছাড়া অন্যরাও আপ্যায়নে ছিলেন নিবেদিত। তারা পিঠা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন।

মহিলা সমিতির স্টলের সামনে যাই। জাকিয়া হাসান এলি বলেন, ছোটরা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেশকে ভালোবাসার সুযোগ করে নিল। নিলুফা সুলতানা বলেন, ঐতিহ্য তুলে ধরছি। আঞ্জুমান আরা শিল্পী বললেন, অগ্রযাত্রার সমান্তরালে আমরা করছি উন্নয়ন মেলা। চমৎকার প্রকাশ! মৈত্রী বড়ুয়া, সাইফুন্নাহার জলি, নাজনীন এজাজ, ফারজানা অ্যানির সঙ্গে কথা হলো। তারা উদ্‌যাপন করছেন সময়টি।

কানিজ ফাতিমা এসেছেন এই প্রথম। বললেন, এ এক মিলনমেলা। তিনি অনেক অনেক ভালো লাগার অনুভূতি ঢেলে দিলেন।

মেলায় আগত কয়েকজন
মেলায় আগত কয়েকজন

রেছিয়া খানম বলেন, মেলার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ উঠে এসেছে। নাসরিন মোস্তাফিজ বলেন, শেখ হাসিনা অ্যাওয়ার্ড পেলেন। সুখবর, বুকটা ভরে ওঠে।

নৃত্য করেছে দুই শিশু সুমাইয়া ও আয়শা।...চলো এগিয়ে যাব।...নাচে অবিরাম। চলার অঙ্গীকার তাদের। তারা এখানেও ভিড় ঠেলে এগোচ্ছে। ওদের সাথে চলি। শুনি প্রাণের কথা।

দেখা হয় শেখ সাবিনার সঙ্গে। স্বামী-সন্তানসহ দাঁড়িয়ে।...বাড়ি কোথায়? ফরিদপুর। কোন গ্রাম?...কপালে চোখ তুললেন। তারপর বললেন, বাঁশগাড়ি। আপনার?...বললাম, চাঁদহাট...চাঁদের হাট। বললেন, এ পর্যন্ত কাছাকাছি আপনাকেই পেলাম। ফরিদপুরের আর কাউকে পাইনি। আমি বলি, বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। অভিন্ন গ্রামের মতোই।

মোসাফফাহে তাদের আবাস। ব্যবসা-বাণিজ্যও ওই এলাকায়। সফল তারা। বেড়াতে বললেন। ছুটছেন...। আমাদের অদম্য, আলোকিত নারীরা প্রতি নিয়ত বুনে যাচ্ছেন সফলতার গল্প। চলছেন এই তরুণীর মতোই। অসম্ভবকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছেন এই অপরাজিতারা। উন্নয়ন মেলা চাঁদের হাট হয়ে যায়।