প্রবাসে নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় আশ্রয়

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

শীত চলে এসেছে। বদলাচ্ছে আবহাওয়া। গ্রীষ্ম শেষে গাছের পাতাগুলো সবুজ থেকে হলুদ হতে শুরু করেছে। যেন বিয়ের কন্যার গায়েহলুদের মতো গাছেরও গায়েহলুদ। দিনের সময়টাও আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে। বড় হয়ে যাচ্ছে রাত। যেন দিনরাত্রির বড় ছোটর প্রতিযোগিতা চলছে। এই সময়টাতে আরিফ অসুস্থ হয় বেশি। আরিফের অ্যাজমা আছে। আছে অ্যালার্জির সমস্যাও।

ইনহেলার সব সময় সঙ্গেই রাখে। বলা তো যায় না কখন অ্যাজমা দেখা দেয়। দেশ থেকে আসার সময় মা কতবার বলেছেন, যেন ঠান্ডা পড়লে একটু সরিষার তেলের সঙ্গে রসুন গরম করে হাত-পায়ে মাখে। আরিফের এত সময় কই? সেই সকাল আটটার সময় কাজে যায়, ফেরে সন্ধ্যায়। তখন এত বেশি টায়ার্ড থাকে যে, টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়েও পান করতে ইচ্ছে করে না।

আজ প্রায় দুই দিন হলো আরিফ অসুস্থ। শুধু জুস আর ফল খাচ্ছে। আজ ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছিল কেউ যদি এসে ভাত রান্না করে দিয়ে যেত, কতই না ভালো হতো। দেশে থাকতে ভাত খেতে ইচ্ছে করলেই মাকে বলত, মা, ভুক লাগছে, ভাত দেও। মা তাচ্ছিল্যের সুরে বলতেন, এত্ত বড় পোলা নিজে নিয়া খেতে পারে না, আমারে কয়। আমি কী সারা জীবন থাকব? নিজে নিয়া খা। কিন্তু ঠিকই সব কাজ ফেলে মা ভাত দিতেন।

এখানে তো মা নেই। ক্ষুধা লাগলেও দুর্বল শরীর নিয়ে রান্না করতে ইচ্ছে করে না। বরং ক্ষুধাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় আরিফ।

আরিফ দুই রুমের বাসায় থাকে। সঙ্গে আরও তিনজন থাকে। চারজন চুলা ভাগ করে ব্যবহার করে। একজন চীনা, একজন রাশিয়ান, আরেকজন কোরিয়ান আর আরিফ।

লেখিকা
লেখিকা

চীনার সঙ্গে আরিফের দেখা হয় না বললেই চলে। সে কাজ করে দুপুর থেকে মধ্যরাত অবধি। আর কোরিয়ান রাতে কাজ করে দিনে ঘুমায়। সবচেয়ে অসহ্য লাগে তাকে। কীসব রান্না করে। আরিফের মনে হয় সব পোকামাকড়, সাপ আর ব্যাঙ, এই কোরিয়ানের পছন্দ। আর আরিফের এগুলো দেখলেই খাবারের রুচি চলে যায়। রান্না ঘরে যেতেই ইচ্ছে করে না। আলাদা বাসা নেবে সে সামর্থ্যও নেই আরিফের। থাকলে কী আর এখানে থাকে। মানুষ বলে টাকায় নাকি সুখ নাই। আরিফের তা মনে হয় না। যথেষ্ট টাকা থাকলে তো এখন আলাদাভাবে নিজের মতো করে চলত পারত। আর কিছু না হোক অন্তত শান্তি পেত। এই যে আরিফ দুই দিন ধরে অসুস্থ রুমমেট হিসেবে তো একটু কেয়ার করতে পারত? অবশ্য তাদের দোষ দিয়েও লাভ নাই। আসলে সবাই এত বেশি কাজ করে অবসর হলে নিজের জন্যই সময়টুকু ব্যয় করে। এটাই প্রবাস জীবন।

একবার আরিফ তার ছোট বোনকে বলেছিল এই কোরিয়ানের কথা। নাম হোয়াং চো। নাম শুনে ছোট বোনের কী হাসি। বলেছিল ভাইয়া, হুইয়া হুইয়া (শুয়ে শুয়ে) যে চকলেট চোষে তার নাম হোয়াং চো। শুনে আরিফ কিছুটা রেগে গিয়েছিল, ফাজিল ফোন রাখ বলে লাইন কেটে দিয়েছিল। অবশ্য লাইন কেটে দিয়ে সে নিজেও কিছুক্ষণ হেসেছিল। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে দেশে চলে যেতে। কিন্তু গিয়ে কী কাজ করবে? এটা ভাবলে মনে হয় কষ্ট হলেও এখানেই ভালো। অন্তত কিছু একটা করে তো জীবন চলছে। অসুস্থ শরীর নিয়েই আরিফ ভাত রান্না করে। একটা আলু সেদ্ধ করে ভর্তা বানায়। একটু রেস্ট নেয়। তারপর গরম ভাতের সঙ্গে আলু ভর্তা মাখিয়ে মাখিয়ে খায়। এটাই যেন অমৃত খাবার। ভাবে কাল কাজে যেতে হবে। আজ লন্ড্রি করতে হবে। কিছু বাজারও করতে হবে। অসুস্থ হলে কী চলে?

আরিফ মট্রিন ট্যাবলেট নিয়েছিল। কাজ হয়েছে। নাকের পানি চোখের পানি বন্ধ হয়েছে। অ্যাজমাও ছিল। ইনহেলার নেওয়ার পর কমে গেছে। প্রবাসে নিজেই নিজের আশ্রয়। ভাবছে কঠিন অসুখ হলে কী হতো? এখন বুঝতে পারে আপনজন কী।

আরিফ একটা চরিত্র মাত্র। প্রবাসে একরকম হাজার হাজার আরিফ আছে যারা আরিফের মতোই জীবনযাপন করছে। কেউ প্রকাশ করছে। কেউ আড়ালে থাকছে। গত পরশু বাহরাইনে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে চারজন বাংলাদেশি মারা গেছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। দুজনের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। যে বিল্ডিঙে এই ঘটনা সেখানে অনেক বাংলাদেশি একসঙ্গে বসবাস করতেন। বেশির ভাগ ছিল কুমিল্লার। তাদের লাশগুলো আপনজনরা পেয়েছে কিনা জানি না। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি জানাই অন্তত পুড়ে গিয়ে না থাকলে লাশগুলো যেন দেশে পাঠানো হয়। আর যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছে তাদের যেন সাহায্য করা হয় অর্থনৈতিকভাবে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে মানুষগুলো জীবিকার তাগিদে হয়তো এসেছিল বিদেশ। তারা নিজেরাও হয়তো ভাবেনি এভাবে লাশ হয়ে যাবে। সে মানুষগুলোর হয়তো স্বপ্ন ছিল একদিন দেশে ফিরবে আপনজনদের কাছে। আসলে একবার প্রবাসী হলে তার আর দেশে আর ফেরা হয় না ইচ্ছে থাকলেও। প্রবাসেই থেকে যেতে হয় জীবনের প্রয়োজনে। তখন সে নিজেই নিজেকে আশ্রয় দেয় সুখে দুঃখে।

(১০ অক্টোবর ২০১৮)