প্রবাসে আমাদের দুর্গাপূজা

মেরিল্যান্ডের একটি পূজামণ্ডপ
মেরিল্যান্ডের একটি পূজামণ্ডপ

আমরা সপরিবার যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে আসি ২০০৪ সালের জুন মাসে। এখানে আসার আগে বিদেশে নিজের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ধরে রাখা নিয়ে মনে এক অজানা শঙ্কা ছিল। বিশেষ করে দেশে যেভাবে শারদীয় দুর্গোৎসব উদ্‌যাপন করি, সেভাবে এখানে করতে পারব কি না, তা নিয়ে মনে যথেষ্ট সংশয় ছিল। কিন্তু আমার সব আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করেছে সে বছর অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজার সব আচার-অনুষ্ঠান। ওই বছর দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় ২৬ অক্টোবর। মনে আছে, বেশ ঠান্ডা পড়েছিল ওই সময়। বিভিন্ন বাঙালি সংগঠন পূজার আয়োজন করেছিল। পূজা উপলক্ষে প্রবাসী বাঙালিরা ব্যাপক আনন্দে মেতে ওঠেন। প্রথম পূজাতেই আমাদের অনেক নতুন বাঙালি পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন মনে হয়েছিল দেশেই আছি।

মেরিল্যান্ডে প্রতিবছরই শারদীয় দুর্গোৎসব উদ্‌যাপিত হয়। তবে এখানে পূজা সব সময় তিথি মেনে করা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে দুর্গাপূজার আয়োজনের যে ব্যাপকতা, তা হয়তো এখানে নেই। পূজার অনেক আগে থেকেই ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করা বা মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে ঠাকুর দেখা এসব হয়তো হয় না বা থাকে না কাশফুল ও শিউলির গন্ধ। তারপরও দূর প্রবাসে দুর্গাপূজার আনন্দ-আয়োজনে মেতে থাকার যে সুযোগ মেলে, তা-ও বা কম কী?

মেরিল্যান্ডে বাংলাদেশের সংগঠন ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সংগঠন পূজার আয়োজন করে থাকে। মন্দিরের পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুলের অডিটোরিয়ামে পূজার আয়োজন করা হয়। আবার অনেকে বাড়িতেই পূজার আয়োজন করেন। সংগঠনের পূজাগুলো বেশ ব্যয়বহুল। তাই সেসব পূজা দেখতে গেলে টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হয়। টিকিটের দাম আবার বেশ চড়া।

লেখিকা
লেখিকা

প্রবাসে আমাদের দুর্গাপূজা দুই সপ্তাহ ধরে অনুষ্ঠিত হয়। পূজা উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন মেলার আয়োজন করে। এসব মেলায় মেলে শাড়ি, গয়না, বই, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, পূজা সংখ্যা, গানের সিডি ইত্যাদি। পূজা উপলক্ষে প্রতিটি পণ্যের দামে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়। এসব মেলার অন্যতম আকর্ষণ ঢাকাই জামদানি শাড়ি। বাঙালি নারীদের প্রায় সবাই এ শাড়ি কিনে থাকেন। পূজা উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এসব অনুষ্ঠানে সাধারণত স্থানীয় ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিশিষ্ট শিল্পীদের নিয়ে আসা হয়। তারা মনোমুগ্ধকর গান ও নাচ পরিবেশন করেন। অঞ্জলি হওয়ার পর ব্যাপক ভূরিভোজেরও আয়োজন করা হয়। শাক-সুক্তো থেকে ঝিঙে পোস্ত, ডালনা, লাবড়া, সন্দেশ, লুচি, মালপোয়া, পোলাও, ভাজা, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি, লাড্ডু সবকিছুই থাকে এতে।

আমাদের বাড়ির বেশ কাছেই ওয়াশিংটন কালীমন্দির। এই মন্দিরে অবশ্য তিথি মেনে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মহালয়ায় দেবীপক্ষের আরাধনা থেকে শুরু করে দশমীর সিঁদুর খেলা তিথি ও নিয়ম অনুযায়ী করা হয়ে থাকে। অষ্টমীতে সন্ধিপূজার আয়োজনে থাকে ১০৮টি প্রদীপ। ফুল, বেলপাতা, ভোগ, হোম, আরতি, কুমারীপূজা—কোনো কিছুই বাদ যায় না। দুই বেলা ভোগ প্রসাদ থেকে শুরু করে পুরো পূজার আনন্দ ধনী, গরিব, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে সবাই উপভোগ করতে পারেন।

বিসর্জন দেওয়ার মতো কোনো পুকুর-নদী এখানে না থাকায় দশমীতে ঠাকুর বিসর্জন হয় না। তবে এখানে দশমীতে প্রতীকীভাবে দর্পণ বিসর্জন দেওয়া হয়। ঠাকুর নিয়ে আসা হয় কলকাতা থেকে। পরের বছর একই মাকে পূজা করা হয়।

এখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও মহা ধুমধামে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ স্লোগান প্রতিটি পূজামণ্ডপে অনুসরণ করা হয়।
...