নীল কুমুদিনীর নৃত্য-আট

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বেডরুম ছেড়ে লাউঞ্জে ঢুকেই রাকিব দেখল, প্রফেসর নিকোলাস রজারসন এরই মধ্যে খাওয়া শেষ করে চুপচাপ বসে আছেন। কিন্তু তিনি চুপচাপ বসে থাকলেও তার চেহারায় বেশ তৃপ্তির ছাপ।

প্রফেসর রজারসনের এমন চেহারা দেখে রাকিবের খুব ভালো লাগল। তার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, অকল্যান্ডের জাকারান্ডা লজে থাকাকালে একবার সে এক মাস বা তার ওপরে ভাতের সংস্পর্শ পায়নি। তখন রাকিব চারদিকে একটা ছোটখাটো কাজ বা চাকরি হন্য হয়ে খুঁজছিল। কিন্তু কোথাও চাকরি পাচ্ছিল না। তাই রাকিব জাকারান্ডা লজে চুলার ধারে যাওয়ার সময় পেত না। এ ছাড়া তখন তার একটা হাঁড়ি-পাতিলও ছিল না যে সে রান্না করবে। রাকিব হেস্টিংসে সবকিছু ফেলে শূন্য হাতে তাওরাঙ্গা হয়ে অকল্যান্ডে এসেছিল।

সেই এক মাসের সময়টা পেরিয়ে যাওয়ার পর একদিন হঠাৎ করেই রাকিবের পরিচয়ে হয় একজন বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে। ভদ্রলোক ইঞ্জিনিয়ার। খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছেন। আরও উচ্চশিক্ষা নিতে অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর পড়ছিলেন। পড়াশোনার ফাঁকে অকল্যান্ড শহরে পার্টটাইম ট্যাক্সি চালাতেন। ভদ্রলোকের নাম মাসুদ হাসান। একদিন রাকিবকে তার গাড়ি সার্ভিসিংয়ের জন্য গ্যারেজে দিতে হয়েছিল বলে সেদিন ওকে ট্যাক্সিতে উঠতে হয়েছিল।

ওই ট্যাক্সিরই চালক ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ হাসান। তার ট্যাক্সিতে ওঠার পরপরই রাকিবের একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হয়। ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ হাসানের ট্যাক্সির সিডি প্লেয়ারে খুব ধীর লয়ে একটা বাংলা গান বাজছিল—‘আমি মেলা থেকে এক তালপাতার বাঁশি কিনে এনেছি। বাঁশি তো আগের মতো বাজে না...!’

রাকিব ট্যাক্সিতে উঠেই জিজ্ঞেস করে, আপনি নিশ্চয়ই বাঙালি?

ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ বলেন, হ্যাঁ।

: বাংলাদেশের?

: হ্যাঁ, বাংলাদেশের।

তার জবাব শুনে রাকিব বেশ উচ্ছ্বসিত হয়। বলে, দারুণ তো! আপনি আপনার ট্যাক্সিতে বাংলা গান বাজাচ্ছেন?

ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ বলেন, হ্যাঁ, কাস্টমার না থাকলে আমি শুনি। আপনি ওঠার আগে সিডি প্লেয়ার বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলাম।

রাকিব বলে, ভালোই হয়েছে। এই বাংলা গানের কারণে আপনার সঙ্গে পরিচয় হলো।

পরিচয় পর্বের পর থেকেই ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ বেশ আন্তরিকতা দেখান। রাকিব জানতে পারে, তিনি ওর পাশের সাবার্ব মাউন্ট আলবার্টে থাকেন। সেদিন তিনি রাকিবের কাছ থেকে ট্যাক্সি ভাড়া তো নেননি, উল্টো রাকিবকে তার বাসায় নিয়ে যান।

তখন মধ্য দুপুর ছিল। ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ হাসানের স্ত্রী বাসার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাসুদ হাসানের সঙ্গে রাকিবকেও খেতে দেন। সাদা ভাতের সঙ্গে স্ন্যাপার মাছ আর মুগ ডাল।

রাকিবের মনে পড়ল, আহা! সেদিন কী মজা করেই না সে ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ হাসানের বাসায় সাদা ভাতের সঙ্গে স্ন্যাপার মাছের পেটি ও মুগ ডাল দিয়ে মেখে খেয়েছিল...!

ডাইনিং টেবিলের কাছে আসতেই প্রফেসর রজারসন জিজ্ঞেস করলেন, কে, নদী ফোন দিয়েছিল?

রাকিব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনি জানলেন কীভাবে? আমি তো বেডরুমে গিয়ে কথা বলেছি। আর আমি নদীর সঙ্গে কথা বলেছি বাংলায়।

প্রফেসর রজারজন বললেন, দুটো কারণে নদী ফোন দিয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। এক, তুমি কিচেনের বেঞ্চটপ থেকে মোবাইলটা নিয়ে বেডরুমে গিয়ে কথা বলেছ। তুমি তোমাদের ভাষায় কথা বলবে। কিচেনে বললে কী এমন সমস্যা ছিল? আমি কি তোমাদের ভাষা বুঝি? দ্বিতীয়ত, নদীকে আমি বলে এসেছি দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে ফিরব। কিন্তু এখন প্রায় দেড় ঘণ্টার ওপরে হয়ে গেছে। তাই নদী আমার জন্য চিন্তিত হয়ে ফোন দিয়েছে। হয়তো আমার মোবাইলেই ফোন দিত। কিন্তু আমি ভুলে মোবাইল বাসায় ফেলে এসেছি।

: আপনার ইমাজিনেশন দারুণ স্যার।

: এটা ইমাজিনেশন নয়, সাইকোলজি।

রাকিব মৃদু হেসে বলল, তাও অবশ্য ঠিক।

প্রফেসর রজারসনও মৃদু হাসলেন। জিজ্ঞেস করল, নদী মনে হয় রান্না করে বসে আছে?

: জি, স্যার। নুডলস রান্না করেছে।

: আহা, বেচারি এত কষ্ট করে রান্না করল। আর আমি তোমার বাসায় খেয়ে ফেললাম।

: অসুবিধা নেই স্যার। নদীর রান্না করা নুডলস রাতে খাবেন।

: হ্যাঁ, তাই করব। আচ্ছা, তোমার কাছে একটা দরকারে এসেছিলাম।

: কী দরকার স্যার?

: নদীর সঙ্গে তোমার কী হয়েছে?

: আমার কিছু হয়নি তো।

: কিছু একটা তো হয়েছে। নয়তো নদী এমন মন খারাপ করে আমার কাছে আসত না।

: আমি ঠিক জানি না স্যার।

: আমিও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কেন সে মন খারাপ করে আছে।

: নদী আপনাকে কিছু বলেছে?

: উল্লেখ করার তেমন কিছু বলেনি। তবে এটুকু বলেছে, তুমি যেদিন আমার বাসায় গিয়েছিলে, সেদিনের পর থেকে তুমি তার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলছ না।

রাকিব কী ভেবে চুপ হয়ে গেল। নদী তো কথাটা ঠিকই বলেছে। সে নদীর সঙ্গে স্বাভাবিক না থেকে একটু বেশিই কঠিন হয়ে গিয়েছিল। নদী আজ ফোনে তাকে অহংকারী উপাধি দিয়েছে। তবে সে অহংকারী, এ কথা ঠিক নয়। পরিস্থিতি একটু প্রতিকূলে গেলে সে একটু বেশি মাত্রায় চুপ হয়ে যায়। এর পেছনেও একটা যুক্তি আছে। জীবনে সে একজন বড্ড পোড় খাওয়া মানুষ। পোড় খাওয়া মানুষেরা আকাশের সিঁদুর মেঘ দেখলেও ভয় পায়। আটা দেখলেও মনে করে চুন!

প্রফেসর রজারসন নিজ থেকেই বললেন, এটা সত্য যে, আমি সেদিন তোমাকে কিছু কটু কথা বলেছি। তুমি আমার বাসায় গিয়েছিলে। অথচ আমি ঠিকভাবে কথা বলিনি।

রাকিব তাড়াতাড়ি বলল, না স্যার, আপনি সেদিন আমার কথা বা যুক্তির পেছনে আপনার যুক্তি দেখিয়েছেন। যুক্তি দেখানো আমার যেমন অধিকার আছে, আপনারও সেই অধিকার আছে। আপনি আমার কথার পেছনে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এটাই তো স্বাভাবিক হওয়া উচিত, তাই না?

প্রফেসর রজারসন মাথা ঝাঁকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, আমি সেদিন কথা বলতে গিয়েই টের পেয়েছি, তুমি খুব বুদ্ধিমান। তবে চালাক নও। চালাক আর বুদ্ধিমান এক নয়, এটা জানো তো?

রাকিব বলল, জি, স্যার।

: তুমি বুদ্ধিমান, চালাক নও। বুদ্ধিমান বলেই আমার প্রতিটা কথা, যুক্তি ও অভিমতের পেছনে নিজের যুক্তি ও অভিমত ব্যক্ত করেছ। কোথাও কোথাও প্রতিবাদও করেছ। আই লাইকড দ্যাট, আই রিয়েলি লাইকড দ্যাট। চালাক হলে কিন্তু আমার প্রতিটা কথার সমর্থন দিয়ে আমার কাছে ভালো সাজতে। মানুষ সাধারণত ওটাই করে। কিন্তু তুমি করোনি।

: স্যার, আপনি ওভাবে ভেবেছেন?

: হ্যাঁ, কারণ নদীকে আমি খুব পছন্দ করি। আমার কিন্তু দুটো মেয়ে আছে। একজন ওয়েলিংটনে, অন্যজন অস্ট্রেলিয়াতে, কুইন্সল্যান্ডের রকহ্যামটনে। তুমি জানো কিনা, আমার দুটো ছেলেও আছে। ওদের একজন লন্ডনে থাকে। অন্যজন কাছেই থাকে। অকল্যান্ডে। অকল্যান্ডের মানোকাউয়ে। মাত্র নব্বই কিলোমিটার দূরে। কিন্তু কেউ আমার একবার খবরও নেয় না। এই নদী গত দেড়-দুই বছরে আমাকে ও আমার জীবনটাকে নতুন করে চেনাতে শিখিয়েছে। নদী কিছুই করে না। সপ্তাহে একদিন কী দুই দিন আসে। কিন্তু এসেই বাসাটাকে জীবন্ত করে তোলে। আমি তার জন্য প্রায় প্রতিটা দিন অপেক্ষা করি। আমি জানি, নদীর পক্ষে প্রতিদিন আমার বাসায় আসা সম্ভব না। তবুও তার জন্য অপেক্ষা করি। যেদিন সে না আসে, মন খারাপ হয়। যে দিন সে আসে, আমি ভেতরে-ভেতরে খুব খুশি হই। কিন্তু আমি কখনো তা প্রকাশ করি না।

: স্যার, আপনার যেদিন মন খারাপ হয় বা নদীকে দেখতে ইচ্ছে হয়, তাকে বাসায় ফোন করে ডেকে নিয়ে আসলেই পারেন?

: হ্যাঁ পারি। আমি ফোন দিলেই সে দৌড়ে আসবে, ওটা জানি। কিন্তু তাকে যদি ফোন দিয়ে ডেকেই আনি, তাহলে আর অপেক্ষার মজা থাকল কোথায়?

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ইউ আর গ্রেট স্যার!

প্রফেসর রজারসন মৃদু হেসে বললেন, তুমি এবার কিন্তু চালাকের পর্যায়ে চলে গেলে।

রাকিব বেশ শব্দ করে হেসে ফেলল। হা–হা–হা, হা–হা–হা। সাধারণত সে এত জোরে শব্দ করে হাসে না।

প্রফেসর রজারসনও শব্দ করে হাসলেন। বললেন, আচ্ছা, আমি এখন উঠি। নদীকে দশ-পনেরো মিনিটের কথা বলে প্রায় দেড় ঘণ্টার ওপরে কাটিয়ে দিয়ে গেলাম। দুই ঘণ্টা মনে হয় হয়ে গেছে তাই না?

: না স্যার, আপনি এসেছেন দুই ঘণ্টা হয়নি। দেড় ঘণ্টা হয়েছে।

: দেড় ঘণ্টাই বা কম কী?

: জি, স্যার।

: তবে খুব ভালো লাগল রাকিব। তুমি মাঝেমধ্যে আমাকে রান্না করে খাইয়েও তো। নদীকেও রান্নাটা শিখিয়ে দিয়ো।

রাকিব সায় দিয়ে মৃদু হেসে বলল, জি, স্যার।

প্রফেসর রজারসন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ডাইনিং টেবিলে ভর দিয়ে সোজা হতে হতে বললেন, ও হ্যাঁ রাকিব, তোমাকে একটা কথা বলি। আমার সেদিনের কথাগুলো সিরিয়াসলি নিয়ো না।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, কোন কথাগুলো স্যার?

: ওই যে, তোমাদের বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ মুজিব সম্বন্ধে কটূক্তি করেছি।

: আপনি কটূক্তি করেননি স্যার। আপনি আপনার অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। তবে এটা সত্য, আপনার অভিমত ও যুক্তিগুলো বড্ড একপেশে ছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধেও আপনি যথার্থ অভিমত ব্যক্ত করতে পারেননি।

: ওটা আমি ওটা ইচ্ছে করেই করেছিলাম।

: সেটা কেমন?

: তোমাকে জানার জন্য।

: আমাকে জানার জন্য, কেন?

: নদী কোন ছেলেটাকে পছন্দ করেছে, ওটা আমার জানতে ইচ্ছে হয়েছিল।

: কী জানলেন?

: ওটা তো আমি তোমাকে কিছুক্ষণ আগেই বলেছি।

: তা অবশ্য ঠিক স্যার।

: তবে একটা কথা বলি, তুমি উইলিয়াম এ এস ঔডারল্যান্ডের নাম শুনেছ? একমাত্র বিদেশি যিনি তোমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম দিকে জীবন-মৃত্যুকে হাতে নিয়ে পাকিস্তান সেনা অফিসারদের সঙ্গে মিশে তাদের কাছ থেকে মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করে সেই তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাচার করতেন এবং শেষের দিকে দুই নম্বর সেক্টর হয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরেও অংশগ্রহণ করেছিলেন।

: জি, অবশ্যই তাঁর নাম শুনেছি। তিনি তো অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করেন।

: করেন নয়, করতেন। তিনি বছর কয়েক আগে মারা গেছেন।

: ও, সরি। আমি এই নিউজটা পাইনি।

: ইটস ওকে। সেই উইলিয়াম এ এস ঔডারল্যান্ড যদিও বয়সে আমার অনেক বড় ছিলেন, কিন্তু তিনি আমার বন্ধুর মতো ছিলেন। তিনি যখন হাসপাতালে শয্যাশায়ী, তখনো তাঁর সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছে। তিনি নিউজিল্যান্ডে এসে আমার এই স্যালারি স্ট্রিটের বাসায় বেড়িয়ে গেছেন। তাঁর মুখে আমি তোমাদের শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা শুনেছি। ঔডারল্যান্ড একটা কথাই বলতেন, শেখ মুজিব যদি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ না করে উন্নত বিশ্বের কোনো দেশে জন্মগ্রহণ করতেন, তাহলে তাকে মানুষজন দেবতার আসন দিত।

: বাংলাদেশের মানুষ তাকে দেবতার আসনেই দিয়েছে।

: না, দেয়নি। উনিশ শ পঁচাত্তর সালে শেখ মুজিবকে যেভাবে হত্যা করা হয়, তা নিয়ে আমি কথা বলব না। রাকিব, একটা কথা বলি, বর্তমানে বাংলাদেশে যে সরকার ক্ষমতায় আছে, ওরা শেখ মুজিবের অনুসারী। তাই জনগণ শেখ মুজিবকে দেবতার আসন দিচ্ছে। আবার এই দল যখন ক্ষমতায় থাকবে না, তখন তোমাদের সেই জনগণই মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলবে। অতীতেও একই অবস্থা হয়েছে। সত্তরের মাঝামাঝি থেকে, পুরো আশির দশক তোমাদের দেশের জনগণ শেখ মুজিবের নামটা পর্যন্ত নিত না। অ্যাম আই রাইট?

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, জি, আপনি ঠিকই বলেছেন।

প্রফেসর রজারসনও মাথা ঝাঁকালেন। বললেন, কথা বাড়ালে অনেক কথাই হবে। তোমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে সেদিন যেসব কথাগুলো বলেছি, ওগুলোও ভুল কথা বলেছি। জাস্ট আই ওয়ান্টেড টু নো ইউ, দ্যাটস হোয়াই। তুমি কী জানো, তোমাদের বাঙালি জাতি তোমাদের সেই মুক্তিযুদ্ধে কী করেছে?

রাকিব পাল্টা জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কোন বিষয়টা জানতে চাচ্ছেন?

: আমি বলতে চাচ্ছি, তোমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। উইলিয়াম এ এস ঔডারল্যান্ড তোমাদের ওখানে টঙ্গী বাটা সু কোম্পানিতে চাকরি করলেও তিনি কিন্তু প্রথম যৌবনে একজন সৈনিক ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হল্যান্ডের সেনাবাহিনীর হয়ে অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। পরে নাৎসি বাহিনীর হাতে বন্দীও হয়েছিলেন। সেটা অবশ্য অন্য ইতিহাস। ও হ্যাঁ, তুমি নিশ্চয়ই জানো, ঔডারল্যান্ডের জন্ম কিন্তু হল্যান্ডের আমস্টারডামে। তিনি ডাচ ছিলেন।

: জি, জানি। আমি তাঁর জীবনবৃত্তান্ত ও ইতিহাস পড়েছি। তিনি বাংলাদেশে বেশ সম্মানী লোক। তিনিই একমাত্র বিদেশি যিনি মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ খেতাবের অন্যতম খেতাব ‘বীর প্রতীক’ ভূষিত হয়েছিলেন।

: আমিও সেটা জানি। তিনি তাঁর নামের পেছনে এই উপাধিটা কিন্তু সব সময় লিখতেন।

: তাই নাকি?

: হ্যাঁ। গর্ব করে এ কথাটা সবাইকে বলতেনও।

: দারুণ তো। ওটা আমি জানতাম না।

: হুম, যে কথা বলছিলাম। ঔডারল্যান্ড বেশ অনেকবার তোমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে একটা চমৎকার কথা বলতেন।

: কোন কথা স্যার?

: তিনি বলতেন, বাঙালি জাতি এমন একটা বীরের জাতি, যারা মাত্র সাড়ে নয় মাসে একটা দেশ স্বাধীন করে ফেলেছিল। পৃথিবীর আধুনিক ইতিহাসে এমনটা আর নেই। একদিন বড় বড় দেশগুলোতে যুদ্ধের ইতিহাস টানলে তোমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনি টানবে।

প্রফেসর রজারসনের এ কথা শুনে রাকিবের মুখটা বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, থ্যাংক ইউ স্যার। আমিও তাই বিশ্বাস করি। বলেই সে কী ভেবে বলল, স্যার, আপনার কথাগুলো অনেক ভালো লাগছে। অনেক শুনতে ইচ্ছে করছে। আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। একটু বসেন না, প্লিজ! আমি এক কাপ চা বানাই?

প্রফেসর রজারসন বললেন, না না, নদী চিন্তা করবে। আর আমার ওষুধ খাওয়ার সময় চলে যাচ্ছে। আমি বৃদ্ধ মানুষ। ঠিকমতো ওষুধপত্র খেয়ে না বেঁচে থাকলে তোমাকে এমন দারুণ দারুণ গল্প শোনাব কোথায় থেকে?

রাকিব বলল, স্যার, কী যে বলেন।

প্রফেসর রজারসন বেশ শব্দ করে হাসলেন, হা–হা–হা, হা–হা–হা। আচ্ছা, যাওয়ার আগে একটা কথা বলি, তোমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন আমার ধ্যান ও ধারণা। আমি মাঝেমধ্যে তাঁর গান শুনে, তাঁর কবিতা পড়ে, এমন কী উপন্যাস ও ছোটগল্পগুলো পড়ে এতটাই বিস্মিত হই যে, একজন মানুষ এত সৃষ্টি করেছেন কীভাবে? তাঁর অনেক বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ আমার লাইব্রেরিতে আছে। আরও ছিল। কিন্তু কীভাবে যে হারিয়ে ফেলেছি!

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে বলল, আমি সেদিন আপনার লাইব্রেরিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ দেখেছি। নদী আপনার লাইব্রেরিতে নিয়ে দেখিয়েছিল।

প্রফেসর রজারসন বললেন, ও তো সামান্যই দেখেছ। আরও ছিল। মিসিং হয়ে গেছে। আচ্ছা, আজ আর কথা বাড়াই না। বাসায় যাই। তুমি গাড়ি নিয়ে পরে আমার বাসায় আস। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।

রাকিব বলল, জি, স্যার। আমি দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে আসছি।

প্রফেসর রজারসন দরজা ঠেলে বের হতে হতে বললেন, তোমার বাসাটা কিন্তু সুন্দর। চারদিকে অনেক গাছ আছে।

রাকিব বলল, এ আর কী স্যার! আপনার বাসাটা যা সুন্দর! এমন সুন্দর দৃশ্য নিয়ে হ্যামিল্টন শহরে কয়টা বাসা আছে? আপনার বাসার ওপরের ডেকে দাঁড়ালে কারও মনেই হবে না সে শহরের ভেতরে আছে। মনে হবে, সে কোনো ফরেস্ট বাংলোতে দাঁড়িয়ে আছে। অসংখ্য ফার্নগাছ আপনার বাসাকে বৃত্ত করে আছে। এ ছাড়া ক্যাবেজ গাছ, রাবার গাছ, শত বছরের মেহগনি, পাইন ও ওক গাছ। তবে সবচেয়ে বেশি সৌন্দর্য যেটাতে ফুটে ওঠে, সেটা হলো ওয়াইকাটো নদী। ডেকে বসে বিমুগ্ধ ওয়াইকাটো নদীর স্রোত দেখা আর কল কল, কুল কুল শব্দ শোনা, আহা!

প্রফেসর রজারসন বললেন, বাহ, তুমি তো বেশ সুন্দর করে কথা আমার বাসাটার বর্ণনা দিচ্ছ?

রাকিব একটা লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিয়ে বলল, থ্যাংক ইউ স্যার, আমার আরেকটা কথা আছে। ঠিক কথা নয়, অনুরোধ।

: বলো কী কথা?

: আমার একটা ইচ্ছে, কোনো জ্যোৎস্নার রাতে আপনার ডেকে বসে জ্যোৎস্না দেখব।

: হ্যাঁ হ্যাঁ আস। একদিন জ্যোৎস্না দেখে আস। নদীকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসো। আমি তো মাঝেমধ্যেই আমার ডেকে বসে একা একা জ্যোৎস্না দেখি।

: জি স্যার। গ্রীষ্মকালটা থাকতে থাকতেই আমি আসব। শীতকালে তো আর বাইরে বসে থাকা যাবে না।

প্রফেসর রজারসন আন্তরিক হাসলেন। সায় দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।

গাড়ি স্টার্ট দেওয়া থেকে গাড়িটা অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত রাকিব প্রফেসর রজাসনের গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা ভালো লাগার ভারী শ্বাস ফেলল।

রাকিব ভাবল, এ জন্যই তার নিউজিল্যান্ড দেশটা ছেড়ে যেতে মোটেও ইচ্ছে করে না। তার ছোট ফুফু প্রায়ই বলেন, রাকিব, তুই তো একটা ভেড়া। অস্ট্রেলিয়ার জব মার্কেট কত ভালো। তুই যে জব করিস, অস্ট্রেলিয়াতে তুই ডবল বেতন পাবি।

কিন্তু রাকিব কখনোই অস্ট্রেলিয়াতে স্থায়ী বসবাসের চিন্তা করে না। নিউজিল্যান্ডই তার প্রিয়। একে তো দেশটা পৃথিবীর স্বর্গ হিসেবে পরিচিত। আর এ দেশের মানুষগুলোকেও যেন স্বর্গেরই মানুষের মতো মনে হয়। কারও কোনো উচ্চাশা নেই। কারও বড় কোনো চাহিদা নেই। কারও মধ্যে কোনো হানাহানি নেই। রাহাজানি নেই। কেউ দুর্নীতিপরায়ণ হবে, এই চিন্তাই কারও মাথাতেই আসে না।

আরেকটা ব্যাপার রাকিবের বেশ ভালো লাগে। এখানে সেলিব্রেটি বা নন-সেলিব্রেটি বলে কোনো কথা নেই। এ নিয়ে কেউ মাথাও ঘামায় না। এ দেশে কেউ সেলিব্রেটি হলে সবাই হয়তো তাকে প্রাপ্য সম্মান দেবে ঠিক। কিন্তু এই নয় যে, কোথাও কোনো জনগণের মধ্যে তার জন্য আলাদা পথ করে দেবে। কোনো রেস্টুরেন্টে বা পাবে তার জন্য আলাদা কোনো চেয়ার পাতা হবে না। সুপার মার্কেটে তার জন্য আলাদা কোনো লাইনও তৈরি করা হবে না। প্রফেসর রজারসন তো এক অর্থে সেলিব্রিটি। কিন্তু কী তাঁর জীবনযাপন, কী তাঁর বেশভূষা! (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1561567