নীল কুমুদিনীর নৃত্য-নয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের কোনো আত্মিক সম্পর্ক আছে কিনা রাকিব জানে না। কিন্তু সে এ মুহূর্ত অবাক হয়ে দেখল, হায়াস প্যাডকের ওক গাছগুলোর কাছে আসতেই হঠাৎ মেঘ ভেদ করে এক চিলতে রোদ এসে তাদের পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। অথচ আজ সারাটা দিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ছিল। এই বৃষ্টিটা গতকাল থেকেই শুরু হয়েছে।

রাকিব ভেবেছিল, আজ আর বৃষ্টিটা থামবে না। নিউজিল্যান্ডের বৃষ্টি! এখানে ঝুম বৃষ্টি খুব কমই হয়। যেটা হয় সেটা হলো ছিঁচকাঁদুনে বৃষ্টি। ঝিরিঝিরি, ঝিরিঝিরি। কখনো বৃষ্টিটা এমন হালকা হয় যে, বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। খানিকক্ষণ বাইরে দাঁড়ালে মনে হয়, বাতাসটাই বুঝি ভেজা। কিন্তু বৃষ্টি ঠিকই হচ্ছে।

নদী রোদ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, রাকিব ভাই, দেখেছেন, কী সুন্দর রোদ উঠেছে?

রাকিব সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ, দারুণ রোদ উঠেছে।

: এই রোদের রংটা কিন্তু অন্য রোদের চেয়ে অন্যরকম।

: সেটা কী রকম?

; মনে হচ্ছে, এটা রোদ নয়। কাঁচাসোনা বিছিয়ে রেখেছে?

রাকিব চোখ বড় করে বলল, আরে বাব্বা, তুমি তো দেখি বড় কবি হয়ে উঠেছ। কী উপমা!

নদী মিষ্টি করে হাসল। বলল, আমার মা কবি। আমার পাশে এখন আরেকজন কবি। দুই কবির কারণে অবশ্যই আমি বড় কবি হয়ে উঠেছি। ডবল কবি। হি–হি–হি!

রাকিবও নরম করে হাসল। তবে শব্দ করে নয়। বলল, নদী, ঘাস তো এখনো ভেজা। বসার বেঞ্চিটাও বেশ ভেজা। চল আমরা ডকের ওপর যাই। নদীতে দেখেছ কেমন জোয়ারের টান এসেছে?

নদী ওয়াইকাটো নদীর দিকে তাকাল। নদীতে সত্যি জোয়ারের টান। জোয়ারের জল পাড়ের পেট বের হওয়া বড় বড় পাথরগুলোতে আছড়ে পড়ছে—ছলাৎ ছলাৎ, ছলাৎ ছলাৎ। নদীর জলেও বিকেলের মেঘ ভাঙা রোদটা বিছিয়ে রয়েছে। অনেকগুলো হাঁস স্রোতের বিপরীতে কৌণিক স্রোত করে সাঁতার কাটছে। হাঁসের সম্মিলিত ডাক—প্যাঁক-প্যাঁক, প্যাঁক-প্যাঁক।

নদীকে চুপ করে থাকতে দেখে রাকিব আবার বলল, নদী, ডকে যাবে?

নদী বলল, যাওয়া যায়। কিন্তু একটা জিনিস আমার মাথায় এসেছে।

: কী সেটা?

: আপনি কি কখনো আমাদের ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি ও রিক্রিয়েশন সেন্টারের সামনের ছোট্ট লেকটা দেখেছেন?

: হ্যাঁ, দেখেছি তো। তোমাদের ইউনিভার্সিটির নাইটন রোডের দুই নম্বর গেট দিয়ে ঢুকলেই বড় যে কার পার্কটা, ওটার পরই তো লেকটা।

: হ্যাঁ, ওটাই। আপনি ইদানীং গিয়েছেন?

: না, কেন?

: ওখানে পুরো লেক ভর্তি পদ্মফুল ফুটেছে। কোনো সুন্দর দিনে যখন বাতাস বয়, লেকের জলের ঢেউয়ের তালে তালে তখন পদ্মফুলগুলো নাচে। তখন দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে।

রাকিব মুগ্ধ হয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি?

নদী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, সত্যি। গত কয়েক দিন ধরে লাইব্রেরিতে আর ল্যাবে কাজ করতে গিয়ে আসা যাওয়ার পথে দেখছি।

: তাই, দারুণ তো!

: হ্যাঁ, যখনই দেখছি তখনই আপনার কথা মনে পড়েছে। আপনি যাবেন ওখানে?

: কখন, এখন যাব?

: হ্যাঁ, এখন। কাছেই তো।

রাকিব বলল, তাহলে চল। গাড়িটা তো হাইড্রো রেস্টুরেন্টটার সামনেই পার্ক করা। মনে হয় না তোমাদের ইউনিভার্সিটির যেতে দশ মিনিটের বেশি লাগবে।

নদী বলল, হ্যাঁ, চলেন।

তারা যখন নাইটন রোডের দুই নম্বর গেট ধরে লেকটার পাড়ে এলে তখন সূর্যটা যেন মেঘ থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এসে আরও স্পষ্টভাবে রোদ ছড়াচ্ছে। দক্ষিণের বাতাসের একধরনের হিল্লোল চারদিক।

লেকটার পাড়ে পৌঁছতে তাদের দশ মিনিটও লাগেনি। একে তো শনিবার। তার ওপর মধ্য বিকেল। ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ বলে সর্বত্র সুনসান ফাঁকা। লেকের পাড়ে নদী ও রাকিব বাদে আর কেউ নেই।

নদী জিজ্ঞেস করল, নীল পদ্মগুলো সুন্দর না?

রাকিব মুগ্ধ চোখে লেকটার সর্বত্র তাকিয়ে বলল, শুধু সুন্দর না। অসাধারণ সুন্দর!

নদী বলল, আপনি একটু ভালো করে দেখুন, লেকের পানিতে যখন বাতাস বয়, পদ্মফুলগুলো কেমন নৃত্য করে। মনে হয় যেন পুরো লেকটা নীল পদ্মগুলো বুকে নিয়ে অনবরত নাচছে। যেন নীল কুমুদিনী নৃত্য করছে।

: ও মাই গড, তুমি এত কঠিন বাক্য শিখেছ কোথায় থেকে?

: কোন বাক্যটা?

: ওই যে বললে, নীল কুমুদিনীর নৃত্য?

: মার কাছ থেকে। মার সঙ্গে যখন ফোনে লেকের এই দৃশ্যটা নিয়ে কথা বলেছি, মা তখন এই বাক্যটা বলেছেন।

: আর তুমি তা মনে রেখেছ?

: হ্যাঁ, রাকিব ভাই।

রাকিব মৃদু হেসে বলল, নদী, আজ তুমি সত্যি কবি হয়ে উঠেছ।

নদী বলল, আমি কবি হতে চাই না।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, তাহলে কী হতে চাও?

নদী মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না।

(পর্ব পাঁচ সমাপ্ত)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন