পূজা সনাতন ধর্মীর, উৎসব সবার

ফুডল্যান্ড টাওয়ারের শারদীয় দুর্গোৎসবে ভক্তরা
ফুডল্যান্ড টাওয়ারের শারদীয় দুর্গোৎসবে ভক্তরা

দুর্গতিনাশিনী দুর্গা দেবী এসেছেন মর্ত্যে। চতুর্দিকে উৎসবের আমেজ। পূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন সবাই। নানা আয়োজনে রাঙিয়ে তোলা হয়েছে আয়োজনকে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে আলাদা মহিমায় ফুডল্যান্ড টাওয়ারে ভীষণ জমজমাট ও উৎসবের আমেজের মধ্যই উদ্‌যাপিত হয়েছে শারদীয় দুর্গোৎসব। শাস্ত্র অনুযায়ী এ বছর দুর্গা এসেছেন ঘোড়ায় চড়ে আবার প্রস্থানও করেছেন একই বাহনে।

প্রতিদিন সকালে ঢাকের বাদ্য, উলু ধ্বনি, কাশর ইত্যাদির মধ্য দিয়ে দিনের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। সারা দিনব্যাপী মন্দিরে চলে দেবীর আরাধনা। এখানে কুমারী পূজা হয়নি। তবে মহাষ্টমীতে সন্ধিপূজা হয়েছে। গত সোমবার (১৫ অক্টোবর) কল্পারম্ভ, বোধন আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে পূজা উৎসবের প্রথম দিন ষষ্ঠী সম্পন্ন হয়। এদিকে মহাসপ্তমীতে আত্মশক্তির উত্থান, প্রাণশক্তির জাগরণ, ষড় রিপুর গ্রাস থেকে মুক্তির আশায় দেবী দুর্গার বন্দনা চলে মণ্ডপে।

ফুডল্যান্ড টাওয়ারের শারদীয় দুর্গোৎসবে সেলফিময় সময়
ফুডল্যান্ড টাওয়ারের শারদীয় দুর্গোৎসবে সেলফিময় সময়

মহা নবমীতে ভোগ নিবেদন, বলিদান ও সন্ধ্যারতি। পূজারি শুভাশীষ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হলো। এখানে পশু বলি দিই না আমরা। মনের অহংবোধ, নীচতাকে হত্যা করি। প্রতীকী এ আয়োজন। মূলত সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী—এই তিন দিনই বলি দান পর্বটি আছে। মনোজ চট্টোপাধ্যায় এ সময় পড়ছেন—‘রূপং দেহি, যশং দেহি।’ ভক্তদের হাতে পত্র পুষ্প, তাঁরা উচ্চারণ করছেন সেই মন্ত্র। অন্যদিকে দেবীর সামনে ঘণ্টা বাজিয়ে পূজা করছেন তমাল চট্টোপাধ্যায়। অন্যরকম সময় বয়ে চলেছে তখন।

সোমা বাগ ব্যস্ত পূজা কর্মে। লাকি হালদার উল্কাকে দেখামাত্র এগিয়ে এলেন। স্বাগত জানালেন পূজার উপকরণ গোছাতে। ফুল সাজালেন তাঁরা। দেবারতি কর তখন নৈবেদ্য সাজাতে মন দিয়েছেন। কলা, চাল, আঙুর, কমলা ও আপেল মেশাচ্ছেন।

ফুডল্যান্ড টাওয়ারের শারদীয় দুর্গোৎসবে বন্ধুরা একসঙ্গে
ফুডল্যান্ড টাওয়ারের শারদীয় দুর্গোৎসবে বন্ধুরা একসঙ্গে

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ও আল আইনেও শারদীয় উৎসব উদ্‌যাপিত হয়েছে। দেবী দুর্গার পূজায় গিয়েছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তারা ধর্মীয় বিষয়টির পাশাপাশি সামাজিক দিকটিরও গুরুত্ব দিতে পেরেছেন। ঢাক, কাঁসরের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনি তাদের মনে পবিত্রতা এনেছে। তারা পুণ্য আহরণ করেছেন। তাদের বিশ্বাস-দেবী দুর্গার আবির্ভাবে পৃথিবী থেকে আসুরিক শক্তির পতন হবে।

ফুডল্যান্ড টাওয়ারের শারদীয় দুর্গোৎসবে বন্ধুরা একসঙ্গে
ফুডল্যান্ড টাওয়ারের শারদীয় দুর্গোৎসবে বন্ধুরা একসঙ্গে

আবুধাবির ফুডল্যান্ডে এপার বাংলার দর্শকেরাও শামিল হয়েছেন। উপভোগ করেছেন শারদীয় উৎসব। ষষ্ঠী থেকে শুরু করে কয়েক দিনই ভবনের প্রশস্ত দোতলার কনফারেন্স হল একেবারে লোকে লোকারণ্য। সরগরম প্রতিটি পর্ব।

দেয়াল কর্ম এখানকার আলাদা এক আকর্ষণ। দুটি অংশ নিয়ে এ পৃথিবী। একদিকে দুটি দীর্ঘ জমিনের দেয়ালিকা। সেখানে মানবিক ঐতিহ্যের লালন এসেছেন। আছে, আদিবাসী নৃত্য। অন্যদিকে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের বিয়ে, তরুণ তরুণীর ভালোবাসা মূর্ত হয়ে এসেছে শিল্পীর তুলিতে। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে অখণ্ড এ উদ্যোগ পূজা আয়োজনকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যায়।

ফুডল্যান্ড টাওয়ারের শারদীয় দুর্গোৎসবে বন্ধুরা একসঙ্গে
ফুডল্যান্ড টাওয়ারের শারদীয় দুর্গোৎসবে বন্ধুরা একসঙ্গে

পৃথ্বীনাথ মুখোপাধ্যায় ও দেবাশীষ মান্না এখানকার জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। প্রথমজনের সঙ্গে কথা হয়। বললেন, এবারের শারদীয় আয়োজনের প্রতিপাদ্য আদি বাংলার সাজ পোশাক ও গয়না। ছবির দিকে আহ্বান জানালেন। বর্ধিঞ্চু বাঙালির নারীরা মাথায় টিকলি, নাকে নথ, কানে বড় বৃত্তের দুল ব্যবহার করে। শিল্পীর তুলির আঁচড়ে সেটা দেখানো হয়েছে।

দেয়ালের ছবিতে পাহাড়ি আদিবাসীর নৃত্য এঁকেছেন শিল্পী। বাউল গান গাইছেন। নরনারীর কণ্ঠ আর একতারার দ্যোতনা পাগলপারা করে ভক্তকে। ‘লোকে বলে লালন কি জাত এ সংসারে’। মানবিকতায় সিক্ত হয় প্রান্তর।

দেখা হয় বৈশালী সরকারের সঙ্গে। শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। তিনি দেখান তার আঁকা ছবি। তরুণ তরুণীর সে মুখ। মিষ্টি মুখের ব্যাখ্যা শুনলাম। আমি অভিনন্দন জানাই।

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। তিনি ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব হুগলির তীরে আনার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। কালাপানি পেরিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন বিলেতে। সংবাদপত্রের উন্নতি সাধন বা ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে রেলপথের স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁরই প্রতিকৃতি দেখলাম। এঁকেছেন নীতা ঘোষ।

মৌসুমি মুখার্জি এঁকেছেন বাঙালি বধূ। সোনালি হালদার দেখালেন তাঁর আঁকা বর-বউ ছবি। তুতুন নন্দীর কাদম্বরী দেখলাম। মরিয়া যে প্রমাণ করিয়াছে সে মরে নাই। আদিবাসী বিষয়ক ছবি এঁকেছেন প্রজ্ঞা পারমিতা আর সংঘ মিত্রা দত্ত। তানিয়া এল শেষে। একই সারিতে তার আঁকার বিষয় সাঁওতাল। ছবি দেখলাম, ক্যামেরায় ধারণ করলাম এই একদল শিল্পীর ছবি।

কথা বলি জয়দীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তাঁরা দুজন আয়োজনের সমন্বয় করছেন। অন্যজন বুদ্ধিশ্বর রায়। বলেন, একগুচ্ছ উৎসর্গের হাত অনুষ্ঠান সফল করতে চলেছে। সাংস্কৃতিক পর্বে অন্যবারের মতো এবার মেধাবী শিল্পীরা যুক্ত। সব জয় করবে তারা। গত দুই দিনে ছোটদের আবৃতি, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, ঢাক বাজানোর প্রতিযোগিতা সবাইকে মুগ্ধ করেছে। নৃত্য ও নাটকেও তারা দর্শক শ্রোতার হৃদয় জয় করবে। আলাপকালে তিনি তিন দিনব্যাপী সিনেমা আয়োজনের আমন্ত্রণ জানালেন। ৩১ জানুয়ারি, ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি আইএসসিতে অনুষ্ঠিতব্য এ অনুষ্ঠানে টালিউডের নায়ক নায়িকারা আসবেন। সেখানে থাকবেন দুই বাংলার জনপ্রিয় মুখ জয়া আহসান।

আবহমান বাংলার পুণ্যার্থীরা দেবী দুর্গার একটি রূপ মনে মনে নির্মাণ করে নিয়েছেন। দেবী তাদের কাছে নারীর মতো শাশ্বত এক চরিত্র। মিহি সুতার বুননে লাল পেড়ে সোনালি বর্ণের শাড়ি সজ্জিতা জননী। সঙ্গে তার দুই পুত্র গণদেবতা গণেশ, সুদর্শন সশস্ত্র কার্তিক আর দুই কন্যা-ধনে গরবিনী লক্ষ্মী ও বিদ্যাদেবী শুভ্র সমুজ্জ্বলা সরস্বতী। আছে ইঁদুর, ময়ূর, প্যাঁচা, হাঁস। দুর্গার চোখ বিস্ফোরিত দীপ্তোজ্জ্বল। হাতে ত্রিশূল, সিংহ তার বাহন। মহিষাসুরকে করা হয়েছে এ ফোঁড়-ওফোঁড়।

তরুণীরা পূজামণ্ডপে এসেছে শাড়ি পরে। কেউবা এই প্রথম এই পরিচ্ছদে। একইভাবে তরুণী মায়েদের মধ্যে ভিন্ন স্বাদের এক অনুভূতি। মন্দিরে গিয়েছেন ফুল, ফল-ফলারি, মিষ্টির নৈবেদ্য সাজিয়ে মায়ের পাদপদ্মে অর্ঘ্য দিতে। ছোটরা কেউ বা শাড়ি-ব্লাউজ বা পায়জামা-পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়েছে। কেউ বা আবার ধুতি পরেছে।

হলের বিপরীত দিকে টেবিলে চৈতালি চক্রবর্তী বসে। তার কাছ থেকে কুপন বুঝে নিচ্ছেন সংঘ মিত্রা মিশ্র। শিল্পী মুখার্জি ভালোবাসার কথা বলছেন ঝুমা বিশ্বাসের সঙ্গে। আমি ক্লিক করি। ঝুমা এ ছবি চান দৈনিকে।

শর্মিষ্ঠা পাঞ্জাবির সঙ্গে আলাপ হয়। কথা হয় কথা কলির সঙ্গে। সংসার ছেলে মেয়ের খবর বাদ যায় না। অবন্তি সেনগুপ্ত সেলফি তুলছেন। সংঘ মিত্রা দত্ত, শমিতা দত্ত তারাও ছবিতলার ছায়ায়। দেবারতি মুখার্জি, সুদেষ্ণা সেনগুপ্ত, ছন্দা ভাদুড়ী সাংহাই ব্যস্ততার পায়ে এগোন। অদিতি রায়, সংঘ মিত্রা মিশ্র শুভেচ্ছা জানান। সুস্মিতা দাশগুপ্ত বললেন, বিক্রমপুর তার পূর্বপুরুষের ঠিকানা। সুদীপ্তা কুন্ডু জানালেন, শরীয়তপুর তার বাবার জন্মস্থান। সোনা ব্যানার্জি, মৌলিমা রায় বলেন প্রাণের কথা।

ফুডল্যান্ড টাওয়ারের শারদীয় দুর্গোৎসবে সমবেতদের একাংশ
ফুডল্যান্ড টাওয়ারের শারদীয় দুর্গোৎসবে সমবেতদের একাংশ

ড. স্বদেশ সাহা আসেন একটু পরে। অনুজপ্রতিম চন্দন হালদার সঙ্গে। আমরা ছবি তুলি। আনন্দের এই পর্যায়ে সামনে দেখি কৌশিক সেন, বশিষ্ঠ নন্দী, কৌশিক রায় ও পার্থ বিশ্বাসকে। বন্ধুত্বের হাত মেলাই। গল্প করি প্রণব পাল ববির সঙ্গে। সেখানে ছিলেন সুবর্ণা পাল, বকুল রানি।

এদিকে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে তাৎক্ষণিক দৃশ্য তুলে ধরার পরপরই সুহৃদদের মধ্যে ঝড় ওঠে। ড. রায়হান জামিল জিজ্ঞেস করেন, কোথায় এ আয়োজন! সুনির্দিষ্টভাবে স্থান কাল উল্লেখ করে আহ্বান জানাই আসতে। অন্যদিকে কলকাতাবাসী ডা. শামসুর রহমান শুভেচ্ছা জানালেন বন্ধুদের। আমি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি।

পূজার পুরো সময়টাতেই ছিল অন্য রকম আমেজ। আলোর সজ্জায়, পুষ্পরাজির শোভায়, ধূপ ধুনোয়, আরতির তুমুল নৃত্য গানে, ঢোল বাদ্য ঘণ্টায় মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে অঙ্গন। পুরোহিতের চন্দন শোভিত মুখাবয়ব, মন্ত্র আর স্তোত্রের গম্ভীর ধ্বনি অপূর্ব করে তোলে পরিবেশ। আয়োজকেরা তৃপ্তি পান সব বাঙালির সাড়া পেয়ে। দর্শকেরা উপভোগ করেন প্রতিটি পর্বের প্রতিটি মুহূর্ত। তারপর একসময় ছুটে চলেন নিজ নিজ গৃহের দিকে।