আজ না হয় আরেকটু ভিজি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সকাল থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কদমের গন্ধে ভরে যাচ্ছে ঘর। আমার ‘ঘর’ না-থাকার ঘর। চৌরাশিয়া বাঁশি অহর্নিশ বাজে বুকের ভেতর। ছেলেবেলায় বইখাতা জামায় লুকিয়ে, বৃষ্টিভেজা হয়ে বাড়িফেরা। অতঃপর গলাব্যথায় আঁটসাঁট হয়ে মামণির ওম-মাখা শাড়ির ভেতর মুখ লুকানো আর দুধরুটি মুখে গুঁজে দিতে চাইলেই এ ঘর-ও ঘর। আত্মরক্ষার জন্য নয়া কৌশল! আর দিয়ো না মা–আ–আ–আ–আ–আ, তুমি কত্ত ভালো!

জানলা খুলে বাইরে তাকাতেই দেখি ফুচকাওয়ালা ভিজতে ভিজতে চলে যাচ্ছে। আজ বুঝি বিক্রি-বাট্টা ভালো হয়নি। বৃষ্টির আলতো ছাঁট গায়ে এসে লাগছে। মনে পড়ছে, প্রথম জলরঙে আঁকা ছবিটা ছিল—একটা রাখাল বালক ছাতামাথায় বটগাছের নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে...বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়ছে, পাশে তিরতির বয়ে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদী। ড্রয়িং পরীক্ষায় তাক লাগানো নম্বর! জুজুবুড়ির গল্প।

দুপুরবেলাতেই আকাশ কালো করে নামে ভরসন্ধ্যা! এবেলায় মাঝিমাল্লাও খেয়া-পারাপার রেখে ঘর খোঁজে। আদুরে বিড়াল আমাকে ঘিরেই আহ্লাদ নিচ্ছে। চন্দ্রমল্লিকা, মুগডালের খিচুড়ির সঙ্গে ভাজছে পাঁপড়, সঙ্গে বেগুন বাহার।

আমি গাইছি...

‘মন মোর মেঘেরও সঙ্গী, উড়ে চলে দিক-দিগন্তে...।’

এখন রাতেও বৃষ্টি...গহিন অন্ধকার! মাঝে মাঝে অন্ধকারও ভালো লাগে। মেঘরাগ, বাঁশি...বুকে হু হু কান্না! অনন্তকে ছুঁয়ে যাওয়ার। মেঘমল্লার দাঁড় টানছে; হেইয়া হো...হেইয়া হো...।

লণ্ঠন নিভু নিভু!

‘কী লিখি তোমায়?’

ভিজে যাচ্ছি আমি। ভিজে যাচ্ছে আমার আদিম সত্তা। বাইরে ডাকছে ঝিঁঝি। আমি বলছি, ভিজি...আরেকটু ভিজি!

কুদ্দুস বয়াতি গাইছে...

‘একদিন মাটিরও ঘর, সঙ্গী হইব তোর...’

আর আমার ঘর না-থাকার ঘর জুড়ে তখনো তুমুল বৃষ্টি। কখন থেকে যে পুরো পৃথিবীটাকেই ‘ঘর’ ভেবে বসে আছি! নিস্তব্ধ চুপকথার আড়ালেও লুকিয়ে থাকে প্রাচীন ব্যথা, গহিন বেদনা।

আজ না-হয় খুব করে ভিজি...
ভিজতে দিই আমার আমিকে!
...

মুক্তা মাহমুদা: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।