মেঘে মেঘে রংধনু-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শনিবার রাতে বরাবরই নদী অনেক রাত অবধি জাগে। কখনো কখনো সারা রাত জেগে ভোরের সূর্য ওঠা দেখে। কোনো কোনো শনিবারের রাত যদি পূর্ণ জ্যোৎস্নার রাত হয়, তখন নদী একা জানালার পাশে বসে কত কী ভাবে। তার শৈশব। ডেমরার সেই ছোট্ট বাসা। তার কৈশোর। হাতিরপুলের সেই টিনশেড। তার ছাত্রজীবন। বুয়েটের শতসহস্র স্মৃতি। তার বিদেশ জীবন। আর এই সবকিছু ছাপিয়ে সে তার মায়ের কথাই বেশি ভাবে।

নাজমুল ভাই–শিমুল ভাবিদের বাসায় জ্যোৎস্নার রাতটাকে নদী খুব একটা উপভোগ করতে পারে না। জানালার পর্দা সরালে এখানে দিঘল একটা পথ ও দুই পাশের সারি সারি বাড়ি বাদে আর কিছুই চোখে পড়ে না। বড়জোর মাথা উঁচিয়ে বেড়ে ওঠা ম্যাপল গাছগুলো চোখে পড়ে। কিন্তু সে গ্রিন্সবড়ো স্ট্রিটে লিয়নি ও স্ট্যাফিনির সঙ্গে থাকাকালে জ্যোৎস্নাকে খুব উপভোগ করত। বাসার দোতলার জানালা থেকে তার দৃষ্টিটা গ্রিন্সবড়ো স্ট্রিট পেরিয়ে গ্রিন্সবড়ো পার্কের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। জ্যোৎস্নার মৌনতা সর্বত্র বিরাজ করত।

নদী গ্রিন্সবড়ো স্ট্রিটের বাসাটা ছেড়েছে প্রায় নয় মাসের মতো হয়ে গেল। লিয়নির সঙ্গে নদীর মাঝেমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা হয়। কী কারণে যেন লিয়নি তার লেখাপড়া এক বছর পিছিয়ে দিয়েছে। লিয়নি এখন সিটি সেন্টারের স্টারবাক কফি হাউসে ফুল টাইম কাজ করে। স্ট্যাফিনি বিয়ের পর তার স্বামী রডরিক ওডকে নিয়ে বেশ সুখেই আছে। ওরা ফরেস্ট লেক সাবার্বে একটা দুই বেডরুমের বাসা ভাড়া থাকে।

মাসখানিক আগে নদী একদিন লিয়নিকে সঙ্গে করে নিয়ে স্ট্যাফিনিকে দেখতে গিয়েছিল। স্ট্যাফিনি সংসারটা বেশ সুন্দর গুছিয়ে তুলেছে। বাসায় সর্বত্র সুখের ছাপ। স্ট্যাফিনি পুরোনো চাকরিটা ছেড়ে নোয়েল ল্যামিঙ্গে নতুন চাকরি নিয়েছে। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ। রডরিক ওড পুরোনো চাকরিটাই করছে।

স্ট্যাফিনির বিয়ের পর নদী মাইকেলকে আর কখনো দেখেনি। হয়তো গ্রিন্সবড়ো স্ট্রিটের বাসায় থাকলে বা আগের মতো পার্টি ও নাইট ক্লাবে গেলে মাঝেমধ্যে দেখা হতো। আজকাল নদী এসব পার্টি বা নাইট ক্লাবে যায় না। নিউজিল্যান্ডে আসার পরপর শখের বশে যে কয়েকবার মদ-বিয়ার চেখে দেখেছিল, ওগুলোর সঙ্গেও তার সংস্পর্শ নেই প্রায় নয়-দশ মাস হয়ে গেল।

নদী মাঝেমধ্যে ভাবে, সে ভালোই আছে। পেয়িং গেস্ট হিসেবে বসবাসের বাইরেও শিমুল ভাবি ও নাজমুল আহসানের সঙ্গে এক ধরনের আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নিজের বড় বোন বা ভাবি হলে যে ধরনের ব্যবহার আশা করত, ঠিক সে ধরনের ব্যবহারই সে শিমুল ভাবির কাছ থেকে পাচ্ছে। নাজমুল আহসান তো সারা দিন কাজেই ব্যস্ত থাকেন। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা-নয়টা পর্যন্ত তিনি ট্যাক্সি চালান। দেখা-সাক্ষাৎ খুব কম হয়। তারপরও নাজমুল আহসানের সঙ্গে নদীর একধরনের শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

তবে এতগুলো মাস এ বাসায় থেকেও আজ পর্যন্ত নদী নিঝুমকে বুঝতে পারেনি। নিঝুমের সেই আগের মতোই নিশ্চুপ স্বভাব। সব সময় গম্ভীর। সব কাজে অনীহা ভাব। মানুষের প্রতি খুব অবহেলার আচরণ করে।

নদী অবশ্য আজকাল আর নিঝুমের এ ধরনের আচরণে তেমন গা করে না। নদী ধরেই নিয়েছে, সে এ বাসায় যত দিন থাকবে বা এ বাসা থেকে দূরে কোথাও চলে গেলেও নিঝুম এমনটাই করবে।

আর নিরালা তো নিরালাই। নামের পুরোপুরি উল্টো স্বভাব। আজকাল নদী মাঝেমধ্যে নিরালাকে নিয়ে বিকেলের দিকে দিঘল ফিন্সলি স্ট্রিট ধরে হাঁটতে বের হয়। কখনো কখনো শিমুল ভাবি সঙ্গী হন।

ওদিকে রাকিব আগের চেয়ে অফিসের কাজে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাকিব এখন শনিবারেও কাজ করে। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে শনিবারে তাদের ওয়াইকাটো নদীর তীরে হাঁটা হয় না। রোববারে এক-দুবার হাঁটতে গিয়েছিল। কিন্তু রোববারে তারা কাছাকাছি কোথাও ঘুরতে যায়। তবে প্রত্যেক রোববারে নয়। এরই মধ্যে হ্যামিল্টন গার্ডেন, কেমব্রিজ শহর, কারাপিরো লেক ও টি-আওমুটু রোজ গার্ডেন—এসব জায়গাগুলোতেই গিয়েছে। আজ তাদের মাউন্ট পিরংগিয়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা।

নদী এখনো নিয়ম করে প্রফেসর নিকোলাস রজারসন বাসায় সপ্তাহে দুই দিন যায়। প্রফেসর রজারসনের শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছে না। এরই মধ্যে দুবার দুই দিন করে হাসপাতালে থেকে এসেছেন।

আজ রোববার। আজ দুপুরের দিকে নদী হ্যামিল্টন ইস্টে যাবে। রাকিবের বাসার উদ্দেশেই সে যাবে। নদী সময়টা ঠিক করে বলতে পারেনি। গত রাতটা শনিবারের রাত ছিল বলে আজ সে কখন ঘুম থেকে ওঠে এর ঠিক নেই। এ ছাড়া রোববারের দিনটা সে সাধারণত অলসভাবে কাটায়। সোমবার থেকে তার আবার ক্লাস।

গত রাতে নদী মায়ের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ মেসেঞ্জারে কথা বলেছে। রাত বারোটা থেকে দুইটা পর্যন্ত। মায়ের একটা সুখবর আছে। অবশ্য একটা নয়, দুটি। প্রথমটা, মা সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর থেকে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হয়েছেন। দ্বিতীয়টা অবশ্য মায়ের জন্য খুবই আনন্দের খবর। তিনি কুমিল্লার গোমতি সাহিত্য সংসদ থেকে সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এক লাখ টাকার চেক ও একটা গোল্ড ক্রেস্ট। এ ছাড়া তাকে আগামী মাসে কুমিল্লা জেলা হলে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।

মায়ের ভালো লাগা সব সময়ই নদীর নিজস্ব ভালো লাগা হয়ে ওঠে। অনেক সময় তার এই ভালো লাগা তার মাকেও ছাড়িয়ে যায়। সে এখন পর্যন্ত কাউকে এই সুখবরটা বলেনি। নদী প্রথম রাকিবকে বলতে চায়।

নদী ভাবল, রাকিব ভাই নিশ্চয়ই মায়ের এই সুখবরটা শুনে বেশ খুশি হবেন। তিনি বরাবরই মায়ের কবিতার বেশ প্রশংসা করেন। ব্যক্তি-মানুষ হিসেবেও মাকে রাকিব ভাইয়ের অনেক পছন্দ।

আজকাল রাকিব বেশ কবিতা লিখছে। নদীর অবশ্য তার সব কয়টা কবিতা পড়া হয়নি। ব্যস্ততা তাদের প্রতিদিন কেমন যেন পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। নদী ক্লাস-অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত। রাকিব ব্যস্ত অফিস ও অফিসের ওভারটাইম নিয়ে। নয়তো প্রতি শনিবারে ওয়াইকাটো নদীর তীরে পাশাপাশি হাঁটার যে আনন্দ, সে আনন্দ কী আর কোথাও বলে-কয়ে বা চেয়ে পাওয়া যায়? রাকিবের হাতে নতুন কবিতা। আর নদীর চোখে সেই নতুন কবিতা শোনার মুগ্ধতা...!

নদী শরীরের আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘুম তো ভেঙেছে সেই কখন। এতক্ষণ সে এমনিই শুয়েছিল। নদী ঘড়ি দেখল। সবে সাড়ে নয়টা বাজে। বিছানা ছেড়ে উঠেই নদী প্রথমে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিল। আজ বাইরে রোদ উঠেছে বেশ। আকাশের অনেক দূরে দূরে পাতলা ছেঁড়া মেঘ। দিঘল ফিন্সলি স্ট্রিটের কোথাও কোনো গাড়ি নেই। দৃষ্টির ভেতর শুধু অপরিসীম নিঃসীমতা।

ঘুম ভাঙার পর থেকে নদী টের পাচ্ছে বাসাটা আজ বেশ নিস্তব্ধ। নদী ভাবল, আজ কী বাসায় কেউ নেই? মাঝে-মধ্যে কোনো কোনো রোববারে নাজমুল আহসান ও শিমুল ভাবি ছেলেমেয়েদের নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরতে যান। কখনো কখনো নদীকে তাদের সঙ্গে যেতে অনুরোধ করেন। নদী দুই-তিনবার যায়নি, তা নয়। তবে বেশির ভাগ সময় সে না করে দেয়। কোথাও ঘুরতে গেলে তার রাকিবকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেই ভালো লাগে।

নদী জানে, রাকিবের সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে বের হলে প্রতিটা মুহূর্তকে ভাগ করা যায়। তার প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ্য হয়ে ওঠে।

নদী বাথরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে বের হয়ে লাউঞ্জে এসে দেখল, বাসাটাকে সে খালি ভেবেছিল, তা নয়। নিঝুম লাউঞ্জের কার্পেটে পা ছড়িয়ে বসে ক্লিক ক্লিক করে প্লে–স্টেশন প্রোতে গেম খেলছে। নদী ভেবে পায় না, এই ছেলেটা সারা দিন কত গেম খেলতে পারে!

নদী কিচেন-করিডর যত দূর দেখা যায় সবটুকু দেখে কোথাও শিমুল ভাবি ও নিরালাকে দেখল না।

নদী একটা সোফা ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে নিঝুমকে জিজ্ঞেস করল, নিঝুম, ভাবি কোথায়?

নিঝুম টিভির স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, মা তো বেবুন আন্টির সঙ্গে চার্টওয়েল মার্কেটে গেছেন।

: আর নিরালা?

: নিরালাও মার সঙ্গে গেছে।

নদী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ও। বলেই সে আর সেখানে দাঁড়াল না। নিজের রুমে ঢুকতে ঢুকতে বেবুন ভদ্রমহিলার কথা ভাবল। মাঝখানে বেশ কিছুদিন তিনি এ বাসায় আসেননি। কী কারণে আসেননি, নদী ঠিক জানে না। আজকাল তিনি আবার এ বাসায় ঘন ঘন আসা যাওয়া শুরু করেছেন। শেয়ারউড সাবার্বে আরও দুজন বাঙালি বাড়ি কিনেছেন। দুজনেই পরিবার নিয়ে আছেন। ওদের একজন তিতাস দাশ। ভদ্রলোক ডাক্তার। তার স্ত্রীও ডাক্তার। তাদের ছোট ছোট দুটো ছেলে। ছেলে দুটোর নাম বেশ সুন্দর। প্রাণ ও প্রিয়।

অপর বাঙালি ভদ্রলোকের নিজস্ব ক্লিনিং বিজনেস আছে। আশিক চৌধুরী। স্বামী-স্ত্রী দুজনই সেই ক্লিনিং বিজনেস চালান। তাদের একটা মাত্র মেয়ে।

নদী এই বাঙালি পরিবার দুটোকে দেখেছে। তারা নাজমুল আহসান ও শিমুল ভাবির বাসায় এসেছিলেন। পরিবার দুটো বেশ ভদ্র। কথাবার্তা ও চলাচলতিতে বেশ অমায়িক। শিমুল ভাবি ডেকে এনে নদীকে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তারা নদীর সঙ্গে বেশ আন্তরিক ব্যবহার করেছেন।

কিন্তু সেই পরিবার দুটোর অমায়িক ব্যক্তিত্ব ও আন্তরিক ব্যবহারে বেবুন ভাবির যত গা জ্বালা...! বেবুন ভাবি এ বাসায় এলেই ফিসফিস করে সারাক্ষণ শুধু ওদের বদনাম করে বেড়ান। শিমুল ভাবিও খুব মনোযোগ দিয়ে শোনেন। বেশ মনোযোগ দিয়েই শোনেন বললে ভুল হবে, তিনি সেই পরিবার দুটোর সঙ্গেও এরই মধ্যে বেশ দূরত্ব সৃষ্টি করে ফেলেছেন।

নদী ভাবল, এ এক আশ্চর্য মানুষ শিমুল ভাবি। সবকিছু বোঝেন। সবকিছু শোনেন। সবকিছু করেন। আবার তিনি কিছুই বোঝেন না, কিছুই শোনেন না, কিছুই করেন না। এই যে নিঝুম সারা দিন টিভির সামনে বসে প্লে-স্টেশনে প্রোতে গেম খেলে যাচ্ছে। বাইরে কোনো খেলাধুলা করে না। এতে শিমুল ভাবির কিছুই যায় আসে না। নিরালা যে এত দুষ্টু। দুষ্টামি করে কখনো গ্লাস, কখনো প্লেট, আবার কখনো কোনো শো-পিস ভেঙে ফেলছে। এতেও তিনি রা করেন না। নাজমুল ভাই বাসি বা ফ্রিজে রাখা কোনো কিছু খেতে পারেন না। তার প্রতিবেলাতেই নতুন রান্না করা তরকারি বা একটা ডিম ভাজি হলেও চাই। শিমুল ভাবি এতে কোনো কষ্ট বোধ করেন না। দিনের তিন বেলাতেই তিনি নতুন কিছু রান্না করে দেন।

তবে শিমুল ভাবি মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভালো। ভেতরে ও বাইরে বেশ সরল। কিন্তু বেবুন ভাবি? নদী স্পষ্ট বুঝতে পারে, বেবুন ভাবি শিমুল ভাবিকে রীতিমতো ব্যবহার করছেন। কোথাও যেতে তার কোনো সঙ্গী দরকার, তখন তিনি শিমুল ভাবিকে এখানে-সেখানে নিয়ে যান। নদীর দৃঢ় বিশ্বাস, শিমুল ভাবিও তা বুঝতে পারেন। কিন্তু তিনি কখনই মুখ ফুটে তা বলেন না। যেখানে নিয়ে যেতে চান সেখানেই যান। বেবুন ভাবি কোনো অপমানমূলক কথা বললেও তিনি গা করেন না।

এই আশ্চর্য সরল মানুষটাকে নদী অবশ্য বেশ পছন্দ করে। কিন্তু নদীর ভয়টা অন্যস্থানে। এই বেবুন ভাবি না আবার কোনো কূটকৌশল চালিয়ে শিমুল ভাবির সঙ্গে তার সম্পর্কের একটা গ্যাঁড়াকল লাগিয়ে দেন!

বেবুন ভাবি যে এমনটা চেষ্টা করেননি, তা নয়। একবার-দুবার সামনাসামনিই চেষ্টা করেছেন। আড়ালের কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল। কিন্তু শক্ত মনের হলেন নাজমুল আহসান। তার কাছে বেবুন ভাবি মোটেও পাত্তা পাবেন না। বরং নাজমুল আহসান বেবুন ভাবিকে একদম সহ্য করতে পারেন না। যদিও একই সাবার্বের প্রতিবেশী বলে অনেক কিছু মেনে নেন। এ ছাড়া শিমুল ভাবিও স্বামীকে বড্ড ভয় পান। সমীহ করেন। মুখের ওপর কোনো দ্বিতীয় কথা বলেন না।

মাঝখানে একদিন এ বাসায় নদীর সঙ্গে বেবুন ভাবির বেশ কথা-কাটাকাটি হয়েছিল। বেবুন ভাবির যে কী সমস্যা, নদী জানবে দূরের কথা মনে হয় স্বয়ং বিধাতাও জানেন না। তিনি যখন-তখন যাকে-তাকে ছোট করে কথা বলেন। একবার শিমুল ভাবির সামনে নদীকে কী একটা বিষয় নিয়ে এমন ছোট করে কথা বললেন। এতে নদী খুব ক্ষেপে যায়। নদী ভুলে যায়, সে শিমুল ভাবির বাসায় পেইংগেস্ট হিসেবে আছে। সে বেবুন ভাবির মুখের ওপর বলে বসে, ভাবি, আপনি যদি কথা বলা না শিখে থাকেন, তাহলে আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবেন না। ফার্স্ট ইউ হ্যাভ টু লার্ন হাউ টু টক উইথ আদার পিপল, দ্যান ইউ কাম টু টক উইথ মি, প্লিজ...!

কথাটা যেন বাজের মতো বেবুন ভাবির কানে ঢোকে। তিনি এমন বীভৎস দৃষ্টিতে তাকান যে মনে হচ্ছিল যেন তিনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। তিনি বসা থেকে দাঁড়িয়ে যান।

শিমুল ভাবি পাশেই বসে ছিলেন। তার চেহারাও সঙ্গে সঙ্গে বিব্রত হয়ে টকটকে লাল হয়ে যায়।

নদী তখনই বুঝতে পারে, এ বাসায় থাকার দিন তার শেষ। কিন্তু না, পরবর্তীতে সে দেখে, শিমুল ভাবি এ ব্যাপারে একটুও মুখ খোলেননি। নাজমুল আহসান তার কথা শুনে আরও উল্টো তাকে সমর্থন দেন।

তারপর থেকেই হয়তো বেবুন ভাবি কিছুদিনের জন্য এ বাসায় আসা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখন তিনি এ বাসায় এলেও নদীর সঙ্গে কথা বলেন না। কেমন পোছমের মতো চোখ গোল করে তাকান। পোছম নিউজিল্যান্ডের একটা ক্ষতিকারক প্রাণী। ওরা এখানকার কৃষকের ফলের বাগান নষ্ট করে। চোখগুলো একেবারে গোল। দৃষ্টিটা কেমন জটিল!

আর নদীও বেবুন ভাবির এসব দেখে না দেখার ভান করে পাশ কেটে চলে যায়।

নদী নিজের রুমে ঢুকে রুমের এদিক-ওদিক তাকাল। রুমের কোণায় একটা ছোট্ট ফ্রিজ। নাজমুল আহসান ফ্রিজটা কিনে দিয়েছেন। নদী সাধারণত পুরো এক সপ্তাহের রান্না একদিনে করে ছোট ছোট কন্টেইনারে করে ফ্রিজটাতে রেখে দেয়। এটা সে শিখেছে রাকিবের কাছ থেকে। আর মজার ব্যাপার হলো, সে রান্না করে শনিবার, আর রাকিব রান্না করে রোববারে।

নদী মাঝেমধ্যে রোববারে ওই বাসায় গিয়ে রান্নায় ভাগ বসায়। তবে একটা কাজ সে ওই বাসায় গিয়ে খানিকটা শিখেছে। সে রাকিবের কাছ থেকে রান্নাটা শিখে ফেলেছে। পুরোপুরি নয়, বেসিক রান্নাটা।

নদী বরাবরই শনিবার রান্না করলেও গতকাল শনিবার হওয়া সত্ত্বেও সে রান্না করতে পারেনি। আজকেও তার রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। ফ্রিজের ভেতর প্রায় প্রতিটা কন্টেইনারই খালি।

নদী ফ্রিজটা খুলে আবার বন্ধ করে দিল। ফ্রিজের ওপর ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল আছে। ফ্রিজের ভেতর কন্টেইনার ভর্তি ব্লু-টপ দুধ আছে। কালই সে এনেছে।

নদী একবার ব্রেকফাস্ট সিরিয়ালের দিকে হাত বাড়াল। পাশ থেকে একটা বাটিও নিল। কিন্তু তার সকালের নাশতা করতে ইচ্ছে করছে না। এখন বাজে প্রায় দশটা। আরও দুই-আড়াই ঘণ্টা। সে লাঞ্চের পরই হ্যামিল্টন ইস্টে যাবে বলে কথা দিয়েছে। এই দুই-আড়াই ঘণ্টা সে কী করবে? লাইব্রেরিতে যাওয়া যায়, নয়তো বাসে করে সিটি সেন্টার ঘুরে আসতে পারে। সে এখনো গাড়ি কেনেনি। এক দুই মাসের মধ্যেই গাড়ি কিনবে বলে তার পরিকল্পনা। আর সামান্য কিছু টাকা জমলেই হয়। নদী রাকিবের কাছ থেকে গাড়ি কেনার জন্য কিছু ধার করতে পারে। কিন্তু রাকিবের কাছে হাত পাততে তার কী রকম সংকোচবোধ হচ্ছে। এত তো জরুরি নয় যে এখনই গাড়ি কিনতে হবে?

নদী সিদ্ধান্তহীনভাবে কিছুক্ষণ তার খাটে বসে রইল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে অযথাই এলোমেলো নম্বর টিপল কিছুক্ষণ। একবার তার রাকিবকে ফোন দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সে ইচ্ছেটা দমিয়ে নিল। ভাবল, কী দরকার? ঘণ্টা দু-এক পর তো দেখাই হচ্ছে।

দেয়াল ঘড়িটা চলছে টিক টিক টিক টিক। ছোট্ট ফ্রিজটার শব্দ হচ্ছে, ওঁম-ম-ম, ওঁম-ম-ম। বাইরে বেশ রোদ উঠেছে। তার রুমটাতে এক ধরনের নরম শীতল ভাব।

নদীর ভালো লাগছে না। কিছুতেই ভালো লাগছে না। তার সময়টা যেন যেতে চাচ্ছে না। মাত্র সাড়ে দশটা বাজে!

নদী উঠে দাঁড়াল। খাটটা শব্দ হলো ক-য়-ট, ক-ট। নদী সিদ্ধান্ত নিল, আপাতত সে শাওয়ারে ঢুকবে। কিছুক্ষণ শাওয়ারের নিচে মাথাটা ভেজাবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেবে সে কী করবে।

নদী কাপড়-চোপড় নিয়ে শাওয়ারে গিয়ে ঢুকল। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>