টরন্টোয় লিয়াকত আলী লাকীর সঙ্গে আড্ডা

টরন্টোয় লিয়াকত আলী লাকীর সঙ্গে আড্ডা
টরন্টোয় লিয়াকত আলী লাকীর সঙ্গে আড্ডা

নির্মল-রুচিশীল আড্ডার মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনের যুক্তিবাদের চর্চা হয়। চর্চা হয় রাষ্ট্র-সমাজ-রাজনীতি ও সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে; তাই আড্ডার প্রাসঙ্গিকতা অনিবার্য। গত সোমবার (২২ অক্টোবর) কানাডার টরন্টোর ডেনফোর্থের মিজান অডিটোরিয়ামে অন্যস্বর-অন্যথিয়েটার আয়োজন করে এক সৃজনের আড্ডা।

যাকে ঘিরে ছিল এই আয়োজন, তিনি একাধারে নাট্যকার, নির্দেশক, শিল্পী ও গীতিকার। বাংলাদেশের শিল্পের সকল শাখার বিকাশ, সকলের জন্য শিল্প সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার ব্রত নিয়ে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের, শিল্প সংস্কৃতি ঋদ্ধ সৃজনশীল মানবিক বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে যিনি দেশে-দেশে চষে বেড়াচ্ছেন, বাংলাদেশ শিল্পকলার মহাপরিচালক; শিল্পের ফেরিওয়ালা লিয়াকত আলী লাকী।

সন্ধ্যা ৮টায় নাট্য-নির্দেশক, আবৃত্তিকার, সংগঠক আহমেদ হোসেনের নেতৃত্বে অন্যস্বর-অন্যথিয়েটারের সদস্যদের উপস্থিতিতে তাকে সংবর্ধিত করা হয়।

১৯৮১ সালে তিনি গড়ে তোলেন লোকনাট্য দল। ১৯৮৩ সাল থেকে তার অন্যতম সহযোগীদের বেশ কয়েকজন বর্তমানে টরন্টোতে স্থায়ীভাবে বাস করছেন ও এই প্রবাসে বাংলাদেশি সংস্কৃতির বিকাশের উনুনে হাওয়া দিয়ে যাচ্ছেন। তারা হলেন গোলাম হিলালী, ইমামুল কিসলু, চয়ন দাস, অনুপ কুমার আর আহমেদ হোসেন; এদের সান্নিধ্য লাকী ভাইকে আপ্লুত করে তোলে।

লিয়াকত আলী লাকীর সঙ্গে আড্ডায় অংশগ্রহণকারীরা
লিয়াকত আলী লাকীর সঙ্গে আড্ডায় অংশগ্রহণকারীরা

লিয়াকত আলী লাকী বাংলাদেশের একজন স্বকীয় ধারার অন্যতম নাট্যনির্দেশক। তার নির্দেশিত রথযাত্রা, পদ্মানদীর মাঝি, বিধি ও ব্যতিক্রম, কঞ্জুস, তপস্বী ও তরঙ্গিনী, হেলেন, সোনাই মাধব, সিদ্ধিদাতা, মহাপ্রয়াণ, মধুমালা, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, মাঝরাতের মানুষেরা এবং শিশুদের নাটক সংহার, ববি, তাসের দেশ, বাজাও বিশ্ববীণা, সিনড্রেলা, আলী বাবা, রূপবদলের রূপকথা, লালু, আমাদের পৃথিবী, রাস্তার ছেলে প্রভৃতি নাটক বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে বিশেষ মাত্রা যোগ করে।

আমন্ত্রিত সংস্কৃতিপ্রেমীরা গোল ও ঘন হয়ে বসে আড্ডা শুরু করেন, সঙ্গে লিয়াকত আলী লাকী ভাই।

লেখক আকতার হোসেন যে কথার অবতারণা করেন তা চিন্তার বোধকে শাণিত করার মতো। আকতার ভাই বললেন, পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে মূলত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।

সত্যিই তো, ঠিক এই কাজটির আনজাম দিয়েছিলেন লিয়াকত আলী লাকী; গড়ে তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক দল।

১৯৮২ সালের ডাকসু নির্বাচনে স্বাধীনতার স্বপক্ষের প্যানেলের একমাত্র নির্বাচিত সাংস্কৃতিক সম্পাদক লিয়াকত আলী লাকী, তখনকার ভিসি ফজলুল হালিমের সহায়তায়, ৪৫০ জনের ডাকসু সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

লিয়াকত আলী লাকীর সঙ্গে লেখক
লিয়াকত আলী লাকীর সঙ্গে লেখক

আহমেদ-হিলালী-কিসলুর মতো আরও অনেক সহযোদ্ধাদের নিয়ে শুরু করেন পথ নাটক, কিংবদন্তি জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, কাজী আরিফ ও ডালিয়া আহমেদ, নাসিম আহমেদ, আনিসুজ্জামানদের নিয়ে শুরু করেন আবৃত্তি আন্দোলন। একে-একে তথ্যগুলো উঠে আসছে। মাঝে-মাঝে তাল কাটছে, এরই মধ্যে ঢাকা থেকে স্কাইপেতে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আবৃত্তিকার ডালিয়া আহমেদ, আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত হচ্ছেন। ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ মনুমেন্ট নিয়ে কথা বলেছেন ম্যাক আজাদ। কিছু প্রস্তাবনা এনেছেন কবি পারভেজ চৌধুরী। উপস্থিত হয়ে আয়োজনকে সমৃদ্ধ করেছেন সুকন্যার কর্ণধার অরুণা হায়দার, কল্পলোকের কবি মেহরাব রহমান, থিয়েটার ফোকসের নয়ন হাফিজ, সবিতা, উদীচী কানাডার সুমন সায়ীদ, অভিনেত্রী সাবিনা বারী লাকি, কুমার অনুপ, ঢাকা পদাতিকের হাসনা হেনা, আরণ্যকের শাকিল ভাই, টরন্টো ফিল্ম ফোরামের রবিন ও জগলুল আজিম রানা, মনীশ রফিক ও এনায়েত করিম বাবুল।

আবার আলোচনায় ফিরলেন লাকী ভাই। এক ফাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, অনেকের সঙ্গে এনায়েত করিম বাবুলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম আন্দোলনের কথা।

এবার প্রসঙ্গগত উঠে এল, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে, লিয়াকত আলী লাকী কী করেছেন এবং কী করার স্বপ্ন দেখেন!

তিনি জানালেন ৬৪ জেলার ৪৪টিতে শিল্পকলা একাডেমি ছিল, বাকিগুলোর কাজ তিনি করছেন। ৪৯২টি উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির কাজ হাতে নিয়েছেন যার মধ্যে ১১টি সম্পন্ন হয়েছে, ৬২টি প্রক্রিয়াধীন। ১২ জন মনীষীদের নিয়ে হচ্ছে কালচারাল কমপ্লেক্স। এদের মধ্যে আছেন শচীন দেব বর্মণ, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, সুচিত্রা সেন, অতুল প্রসাদ, রজনীকান্ত সেন, মহাকবি কায়কোবাদ, সৈয়দ শামসুল হক, রাধারমণ দত্ত ও বাউল আবদুল করিম প্রমুখ। এই স্থাপনাগুলো এক সময় হয়ে উঠবে প্রজন্মের কাছে আমাদের শেকড়ের একমাত্র বাতিঘর।

এবার তাল কাটা নয়, জুড়ে দেওয়া হলো। আয়োজনকে সুরেলা করে তুলতে, লালনগীতি গেয়ে শোনালেন অন্যস্বর-অন্যথিয়েটারের নিয়মিত শিল্পী ফারহানা শান্তা।

লিয়াকত আলী লাকীকে স্মারক উপহার দেন আড্ডার আয়োজকেরা
লিয়াকত আলী লাকীকে স্মারক উপহার দেন আড্ডার আয়োজকেরা

শিশুদের পরিচর্যা করলে জাতির উন্নতি হবেই, শিশু নাট্য আন্দোলন ও লাখো-লাখো শিশু লিয়াকত আলী গড়ে উঠুক বাংলার ঘরে-ঘরে; লিয়াকত আলী লাকী তাদের কাছে শিল্পের আলোকবর্তিকা। সেই আলোয় একদিন তারা হবে আলোকিত, মানবিকতার সৃজনশীল বাংলাদেশে। কথাগুলো বলছিলেন এই শহরের নির্মল আড্ডার পুরোহিত আমাদের সকলের প্রিয় ভাই ও কবি দেলওয়ার এলাহী।

কর্মদিনে স্বল্প নোটিশে যুক্ত হওয়ার জন্য সকলে ধন্যবাদ জানান আহমেদ হোসেন এবং হল দেওয়ার জন্য মিজান ভাই ও শায়লা ভাবিকে কৃতজ্ঞতা জানান লাকী ভাই নিজে।

প্রবাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক দলের প্রাক্তনীরা, শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে যার-যার জায়গা যে কাজগুলো হচ্ছে এর মেলবন্ধনে, অনলাইন লিংক হতে পারে বলে, গুরুত্ব আরোপ করেন লিয়াকত আলী লাকী। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন টরন্টোতে অন্যস্বর-অন্যথিয়েটারের আহমেদ হোসেন, নিউইয়র্কে এ্যানি আপা বিপা নিয়ে কাজ করছেন, ডালাসে বাংলা থিয়েটার করেছেন জিয়া আলপনা, ভ্যানকুভারে সৃজনশীল কাজে যুক্ত আছেন অনিতা, মুখোশ নামের সংগঠন নিয়ে।

শিগগিরই ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশি কালচারাল অনলাইন নেটওয়ার্ক বাস্তবতায় রূপ নেবে, আশা নয় ক্ষুদ্র সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে এ আমার বিশ্বাস।

সৃজনের এই মিলনমেলাকে, স্মৃতি অম্লানের ফ্রেমে বেঁধেছেন রনি মজুমদার ও আমাদের সবার ভালোবাসার বিদ্যুৎ দা।
...

হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব: সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠক।