ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

ক্যানসার শব্দটির সঙ্গে ঠিক কবে প্রথম পরিচয়, আজ আর মনে পড়ে না। খুব ছোটবেলায়, ছোট ভাইয়ের এক বন্ধুর বাবা মারা গিয়েছিলেন ক্যানসারে। এই রোগের সঙ্গে ওই পরিবার কীভাবে যুদ্ধ করেছিল সেটা দেখিনি। তবে বড় হয়ে সেই ছোট ভাইটিকে বলতে শুনেছি, ‘ক্যানসার শুধু একজন রোগীর জীবন নাশ করে না, সঙ্গে সঙ্গে একেকটি পরিবারকেও শেষ করে দিয়ে যায়।’ ব্যয়বহুল চিকিৎসা এবং রোগীর মানসিক ও শারীরিক অসহনীয় কষ্ট পুরো পরিবারের ওপর দুর্যোগ নিয়ে আসে। ধার দেনা করে চিকিৎসা করতে গিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে পরিবার সেই ঋণের বোঝা কাটিয়ে উঠতে পারে না কিছুতেই।

বিয়ের পরে দেখা করতে গিয়েছি এক খালা শাশুড়ির সঙ্গে। শুনতে শাশুড়ি হলেও বয়সে তরুণী। প্রতিমার মতো দেখতে সেই নারী সদ্য স্বামী হারিয়েছেন। দেখে খুব খারাপ লাগছিল। তার জন্য যে আরও কষ্ট অপেক্ষা করছিল সেটা কিন্তু কেউ জানত না। কয়েক মাসের মধ্যেই তারও ধরা পড়ল ক্যানসার। স্তন ক্যানসার। নিঃসন্তান এই সদ্য বিধবা তরুণীকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলো জীবনযুদ্ধে। বেশির ভাগ ক্যানসারের ক্ষেত্রেই দুটো বিষয় খুব জরুরি, কোন স্টেজে ধরা পড়েছে আর রোগীর বয়স কেমন, শারীরিক অবস্থা কেমন। তার বয়স কম থাকায় ও প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়ায় তিনি অপারেশন ও থেরাপির মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের মধ্যে স্তন ক্যানসার সাধারণত নিরাময় করা সম্ভব, যদি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে। সেই প্রথম আমি একজন ক্যানসার জয়ী যোদ্ধাকে দেখলাম। আজ প্রায় বিশ বছর কেটে গেছে। তিনি সুস্থ জীবনযাপন করছেন।

আমরা সচেতন হব, সুস্থ থাকব। প্রতীকী ছবি
আমরা সচেতন হব, সুস্থ থাকব। প্রতীকী ছবি

বিদেশে এসে দেখলাম এখানেও ক্যানসার আছে অনেকেরই। তবে আমি যেটা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি সেটা হলো, এখানে ক্যানসার শুনলেই মানুষ সঙ্গে সঙ্গে ধরে নেন না, এখনই মরে যাবেন। মানুষ বেশ ঠান্ডা মাথায় চিকিৎসা করান। হয়তোবা এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত বলে। হয়তোবা তারা মানসিকভাবে আমাদের চেয়ে শক্তিশালী বলে। আমার ছেলে তখন ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়ে। একদিন ওর সঙ্গে ওর একটা বন্ধু আমাদের বাসায় এল। নতুন বন্ধু। ফুটফুটে একটা ছেলে। প্রাণশক্তিতে ভরপুর হাসিখুশি এক কিশোর। কয়েক ঘণ্টা পড়ে ছেলেটির মা ওকে নিতে এসে কথায় কথায় খুব স্বাভাবিকভাবে জানালেন, ছেলেটির কিছুদিন আগে পায়ে ক্যানসার ধরা পড়েছিল। অপারেশন করে পায়ের কিছু অংশ বাদ দিতে হয়েছে। ওকে নিয়মিত ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে রাখতে হয় দেখার জন্য, ক্যানসার যেন ফিরে না আসে। মাকে খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। ছেলেটিও পরে গল্প করেছে আমার ছেলের কাছে। এ দেশে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের অনেকে ওদের কোনো স্বপ্নের জায়গায় ঘুরিয়ে আনে। ছেলেটি গিয়েছিল ডিজনিল্যান্ডে। আত্মবিশ্বাসী ও স্বপ্নে ভরপুর কিশোর। ভালোই আছে এখন পর্যন্ত।

কিন্তু সবার গল্পই ওই ছেলের মতো সুখের হয় না। বাঙালি এক ভাইকে দেখেছি অতি অল্প বয়সে বছর দু-এক আগে রোগ ধরা পড়ার কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যেতে। যেহেতু অসুখটা ধরা পড়েছিল অনেক দেরিতে, উন্নত চিকিৎসাও কিছুই করতে পারেনি। বিদেশের মাটিতে আত্মীয় পরিজনহীন ছোট ছোট চারটি বাচ্চা আর তরুণী বধূ রেখে তিনি যেদিন চলে গেলেন, সেদিন মনে হয়েছিল সেই ছোট ভাইটির কথা—‘ক্যানসার একেকটি পরিবারকে শেষ করে দিয়ে যায়।’ এক বন্ধুর বোনের কথাও শুনলাম এ রকম অকস্মাৎ। এই আমেরিকাতেই। বন্ধুর বোনের স্বামী ডাক্তার। তিনি নিজেও ডাক্তার, বয়সও পঞ্চাশের এপারেই। তারপরেও যখন অসুখ ধরা পড়েছে বড় দেরি হয়ে গেছে। কয়েক মাস ধরে ছোট তিনটি বাচ্চা, ডাক্তার স্বামী, শ্বশুর বাড়ি, বোন, মা সবাই মিলে যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা গেল না তাকে।

ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ
ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ

ক্যানসার নিয়ে অন্য ধরনের কিছু গল্প শুনেছি। আবার কিছু নিজের চোখে দেখেছি। আমার এক আমেরিকান বান্ধবীর বোন ভালোবেসে বিয়ে করেছেন ক্যানসারের এক রোগীকে। ছেলেটির অসুখের কথা জেনে শুনেই তিনি প্রেমে পড়েছেন এবং স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে বিয়ে করেছেন। কতটা ভালোবাসা ও সাহস থাকলে কেউ এই কাজ করতে পারেন। শুধু তাই নয়, তাদের এখন তিনটি বাচ্চা। তার স্বামী যেকোনো সময় মারা যাবেন। ডাক্তার সময় দিয়ে দিয়েছেন। পুরো পরিবার শান্তভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে মনে মনে আর চেষ্টা করছে শেষ সময়টা যতটা সম্ভব ভালোভাবে কাটাতে।

কিছুদিন আগে বেড়াতে গিয়েছি আরেক আমেরিকান সহকর্মীর বাসায়। তার স্বামীর বয়স পঁয়ষট্টি। মাথায় দেখি ব্যান্ডেজ করা। আমার সহকর্মী খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, তার স্বামীর চামড়ার ক্যানসার ধরা পড়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য মাথায় ব্যান্ডেজ করা। কিছুদিন আগে আমার আরেক সহকর্মীর স্ত্রীরও ক্যানসার ধরা পড়েছে। অত্যন্ত কম বয়স মেয়েটির। ওদেরও তিনটি সন্তান। প্রথম ধাক্কাটা অবশ্যই খুব কঠিন। তবে মনোবল ব্যাপারটা যেকোনো অসুখেই খুব জরুরি। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই খুব ভেঙে পড়েছিলেন শুরুতেই। আমরা সবাই মিলে সাহস দিচ্ছি।

এই যুদ্ধকে জয় করেছে এ রকম কেউ এ সময়ে পাশে থাকলে মনে হয় মনোবল বাড়ে। এ জন্য এ দেশে অনেক সংগঠনও আছে। আমাদের মা-খালাদের জেনারেশনের অনেকেরই এখন স্তন ক্যানসার ধরা পড়েছে। তাদের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসার কষ্ট নিয়ে, বিশেষ করে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপির অসহনীয় কষ্ট নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে এই যুদ্ধে জয় অসম্ভব নয়। মানুষ এই দুরারোগ্য ব্যাধিকে একদিন সম্পূর্ণ রূপে জয় করবে, আমি সেই দিনের স্বপ্ন দেখি। হয়তো সেই দিন আর বেশি দূরে নয়। সামনে ক্রিসমাস আসছে। গত পরশু দিন অফিসের এক অনুষ্ঠানে একজন অচেনা ক্যানসার রোগী, সদ্য যার রোগ ধরা পড়েছে তার জন্য ক্রিসমাস কার্ড লিখেছি, এই আশায় যে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একজন যোদ্ধার পাশে আছি আমি। তাকে হেরে যেতে দেব না, এই প্রার্থনা করি।