স্বর্গের সিঁড়ি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সগিরুদ্দিন সাহেবের মনটা এমনিতেই কয়েক দিন হলো ভালো নেই। তার মধ্যে সাত সকালে ফোনটা পেয়ে অজানা এক আশঙ্কায় মনটা আরও বিষিয়ে উঠল। ব্যাপারটি যদি অন্য কারও ক্ষেত্রে হতো তাকে এতটা ভাবতে হতো না। ফোনটা এসেছে ওয়ালিউল্লাহর বাসা থেকে। ফোন করেছে ওয়ালিউল্লাহর ছোট মেয়ে চামেলি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ওয়ালিউল্লাহ পা ফসকে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর তার ডান পাসহ শরীরের পুরো ডান পাশ প্যারালাইজ হয়ে গেছে। দেখ তো কী কাণ্ড। তা বলি, এই বয়সে কী সাবধানে চলাফেরা করতে পারিস না। কে শোনে কার কথা। সগিরুদ্দিন সাহেব বিড়বিড় করতে থাকেন মনে মনে। তুই প্যারালাইজ হয়েছিস তাতে আমার কী?

কিন্তু ব্যাপারটা তো অন্যখানে। সগিরুদ্দিন চিন্তিত কী এমনিতেই। গত চল্লিশ বছর ধরে এই সমস্যায় ভুগছেন সগিরুদ্দিন। যখনই ওয়ালিউল্লাহর শারীরিক কোনো সমস্যা হয়, সেটা সগিরুদ্দিন সাহেবেরও হয়। তবে সাধারণত এক মাস পর। বিগত চল্লিশ বছরে সগিরুদ্দিন সাহেব এই রহস্যের কোনো কুল কিনারা করতে পারেননি। সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়েছে। একবার দুবার নয়, অসংখ্যবার। যখনই ওয়ালিউল্লার সর্দি কাশি, ঠিক এক মাসের মাথায় সগিরুদ্দিনের কাশি শুরু হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবার ওয়ালিউল্লাহর সে কী প্রচণ্ড জ্বর। এক শ চার পাঁচ চলল প্রায় সাত দিন। ওয়ালিউল্লাহর জন্যে বিভাগে গিয়ে দুই দুজন শিক্ষককে বিশেষভাবে অনুরোধ করতে হলো পরীক্ষা পেছানোর জন্য। পরীক্ষা পেছানো হলো ঠিকই। কিন্তু ঠিক এক মাস পর সগিরুদ্দিন সাহেবও জ্বরে পড়লেন। একই জ্বর। সে যে কী কাঁপুনি। সগিরুদ্দিনের সময়ে আর ওয়ালিউল্লাহ কোনোভাবেই পরীক্ষা পিছিয়ে নিতে পারল না। পরে অবশ্য শিক্ষককে অনেক অনুরোধ করে সগিরুদ্দিনের পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

ব্যাপারটি সগিরুদ্দিন সাহেব তখন খুব একটা আমলে নেননি। একবার দুবার, এক বছর দুই বছর। কী আর এমন। এটাতো হতেই পারে। কিন্তু না, ব্যাপারটা অতটা সহজ না। একটি ব্যাপার যখন বছরের পর বছর ধরে একইভাবে ঘটতে থাকল তখন থেকেই সগির সাহেবের ভাবনা শুরু। কিন্তু কোনোভাবেই এই রহস্যের কুল কিনারা খুঁজে পাননি সগিরুদ্দিন সাহেব। ওয়ালিউল্লাহ যদিও ব্যাপারটা কখনোই খুব একটা আমলে নেয়নি। কিন্তু সগিরুদ্দিন সাহেবের আমলে না নেবার কোনো কারণ নেই। এই বিষয়টি নিয়ে তিনি অনেক পড়ালেখা ও গবেষণা করেছেন। দেশের দু-একজন নামকরা মনোবিজ্ঞানীরও শরণাপন্ন হয়েছেন একাধিকবার। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি। সবার একই কথা। ব্যাপারটা কাকতালীয়। শুধু একজনই ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবতেন, উদ্বিগ্ন থাকতেন। তিনি হলেন সগিরুদ্দিন সাহেবের স্ত্রী। তিনি বিগত হওয়ার পর এই বিষয়টি নিয়ে সগিরুদ্দিন সাহেব আসলে কারও সঙ্গে আর শেয়ারও করতে পারেননি। ছেলেমেয়েরা আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক। তারাতো বিষয়টি শুনে বরাবর বাবাকে পাগলই ভেবেছে।

বড় ছেলে অবশ্য একবারই এই ব্যাপারটিকে কিছুটা পাত্তা দিয়েছিল। কিন্তু পরে নানারকম ব্যাখ্যা দিয়ে যুক্তির মারপ্যাঁচে অন্যদিকে প্রবাহিত করেছে। সেটাও সাত বছর আগের কথা। ওয়ালিউল্লাহ সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাম পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে ফেলে। বলতে গেলে অনেকটা পঙ্গু হওয়ার জোগাড়। সগিরুদ্দিন যথারীতি এই ঘটনার পর বলতে গেলে ভয়ে গাড়িতে ওঠা বন্ধই করে দিয়েছিলেন। কিন্তু যা ঘটার তা তো ঘটবেই। ঠিক এক মাসের মাথায় যখন নিজের পায়ের লিগামেন্ট না ছেঁড়াতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছিলেন, ঠিক সেই সন্ধ্যাতেই ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে উল্টে পড়ে গিয়ে বাঁ পায়ের দুই পাশের লিগামেন্টই ছিঁড়ে যায়। যেটা এখনো পুরোপুরি রিকভারি হয়নি। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার পর বড় ছেলেও বাবা সগিরুদ্দিনের সঙ্গে চিন্তায় পড়ে যায়। কিন্তু সেটা মাত্র কয় দিনের জন্য। ছেলে ঠিকই বাবাকে এই বলে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, এমন ঘটনার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে সগিরুদ্দিন সাহেব কত কী না করেছেন। যদিও ওয়ালিউল্লাহ দেখতে মোটেও তার মতো নয়, তবুও বারবার জানতে চেষ্টা করেছেন ওয়ালিউল্লাহর সঙ্গে তার পারিবারিক কোনো বা জেনেটিক কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। বলাই বাহুল্য এমনটি হওয়ার কোনোই কারণ নেই, তবুও সগিরুদ্দিন সাহেব নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছেন।

এটা ঠিক, তাদের বন্ধুত্বের কোনো তুলনা হয় না। এমন বন্ধুত্ব তারা নিজেরাও খুব একটা দেখেননি। সুখ-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় দুজন সব সময় দুজনের কাছাকাছি থেকেছেন। তাদের জানামতে কখনোই তাদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়নি। বলতেই হয় নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব। দেশের দুই প্রান্ত থেকে আসা দুজন মানুষের মধ্যে কী করে যে এমন মিল হলো সেটা কেউই জানে না। শুধু যে খারাপ ব্যাপারগুলোই তাদের জীবনে একসঙ্গে ঘটেছে তা কিন্তু নয়। অনেক ভালো ভালো সুসংবাদ তাদের জীবনে একসঙ্গেই এসেছে। যেমন তাদের দুজনেরই বিয়ে হয়েছে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে। প্রথম ছেলে সন্তান হয়েছে কাছাকাছি সময়ে। আরও আগে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি, প্রমোশন, বিদেশ যাত্রা এমন অনেক কিছুই ঘটেছে। তাই সগিরুদ্দিন সাহেব ও ওয়ালিউল্লাহর এই জীবনে পরম্পরায় ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলো কখনো আনন্দের কখনো অনেক বেশি দুশ্চিন্তার ছিল। কিন্তু আজ যা ঘটেছে তা নিঃসন্দেহে ভয়ানকভাবেই দুশ্চিন্তার। বিশেষ করে সগিরুদ্দিন সাহেবের জন্য। ওয়ালিউল্লাহর সিঁড়ি থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, আর শরীরের ডান পাশটা প্যারালাইজ হয়ে যাওয়া, এটা কোনোভাবেই সগিরুদ্দিন সাহেবের জন্য সহজে মেনে নেওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। সগিরুদ্দিন সাহেব খবর শোনার পরে আর আর এক মুহূর্ত দেরি করেননি। প্রিয় বন্ধুর এই খারাপ সময়ে তার কাছে থাকাটা জরুরি। সেইসঙ্গে ঘটনার পরিক্রমা অনুধাবন করে সগিরুদ্দিন ভেতরে ভেতরে ঘামতে শুরু করেন। হাসপাতালের কক্ষে প্যারালাইজ বন্ধুর শয্যার পাশে বসে এক হাত বন্ধুর হাতে রেখে একদিকে যেমন সমবেদনা দেখাতে থাকেন, অন্যদিকে এই ঘটনা এক মাসের মাথায় নিজের জীবনেও ঘটবে এই দুশ্চিন্তায় অস্থির হতে থাকেন। আজ কেন যেন কোনো সান্ত্বনার বাণী মুখ থেকে বেরোচ্ছে না সগিরুদ্দিন সাহেবের। ঠিক এক মাস পরেই নিজের পালা। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে হাসপাতাল ত্যাগ করেন সগিরুদ্দিন।

হাসপাতাল থেকে বাসা, এটুকু আসতেই তার মনে দুনিয়ার চিন্তা ভিড় করে। কী এক জানা বা অজানা আশঙ্কায় মনটা ভারাক্রান্ত হতে থাকে। নিজের ভেতরে-ভেতরে ভয়ে কুঁচকাতে থাকেন সগিরুদ্দিন। নিজের ডান পায়ে বারবার হাত দিয়ে স্পর্শ করেন আর দেখেন ঠিক আছে কিনা। বাসায় ফিরে সোজা বাথরুমে ঢুকে আয়নায় নিজের মুখ দেখেন। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। মনে হয় তিনি আজ খুব একা। আশপাশে কেউ নেই তার। মনে হতে থাকে তার জীবনে যেন মাত্র একটা মাসই বাকি। একজন মানুষের পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকা আর মারা যাওয়ার মাঝে কী খুব একটা পার্থক্য থাকে? হয়তো থাকে। কিন্তু সেটা কতখানি? বাথরুম থেকে বের হয়ে লিভিং রুমের সোফায় বসে দেয়ালে টাঙানো নিজের স্ত্রীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। গভীর ভাবনায় ডুবতে থাকেন সগিরুদ্দিন। হঠাৎ পুত্রবধূর ‘বাবা’ ডাকে সংবিৎ ফিরে পান তিনি। পুত্রবধূ জিজ্ঞেস করতে থাকে ওয়ালিউল্লাহর অবস্থা। তিনি কোনোটা সঠিক অথবা কোনোটা উল্টোপাল্টা জবাব দেন। পুত্রবধূ তার এই অন্যমনস্কতার কারণ খুঁজে পায় না।

সগিরুদ্দিন সাহেবের মন তখন অন্যখানে, অন্য জগতে। ফেলে আসা জীবনটাকে তার আজ খুবই দুরূহ একটা বোঝা মনে হতে থাকে। এত দিন জীবনটাকে তিনি অনেকটাই সফল ও বর্ণিল ভেবেছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে আর তা মনে হচ্ছে না। জীবনের সফলতার ধাপগুলোকে এখন পেছন ফিরে তাকিয়ে অনেকটা মসৃণ মনে হলেও অনেকগুলো ধাপের মাঝে মাঝে তিনি কিছু কালো দাগ দেখতে পাচ্ছেন। সেই দাগগুলো তিনি ঠিকই বুঝতে পারেন। তিনি আজ সেগুলোকে পাপই বলবেন। নয়তো কী। ওগুলো কী পাপ নয়? নিজের সফলতার জন্য কত কিনা করেছেন। ফেলে আসা জীবনের ছন্দে ছন্দে লুকিয়ে আছে কত মানুষকে ঠকানো, বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার সকরুণ ইতিহাস। কেউ কী তা জানেন? না অনেকেই জানেন না। এমন অনেক কিছু তার নিজের স্ত্রীও জানতেন না। কিন্তু এসব তো আজকের এই দিনের আগে একবারও তার মনে পড়েনি।

এখন কেন মনে পড়ছে? বিধাতা কী তাকে শোধরাতে চান? নাকি তিনি নিজেই শুদ্ধ হতে চান? অথবা কোনো এক অজানা অথবা জানা আশঙ্কায়, ভয়ে তিনি নিজেকে শোধরাতে চান। যেটাই হোক। শোধরাতে হবেই। ফিরে যেতে হবে ফেলে আসা সুদীর্ঘ জীবনের ছন্দময় পথের এপাশ ওপাশে অনেক অন্ধকার বা আবছা অন্ধকার আঁকাবাঁকা জায়গাগুলোতে। হ্যাঁ, তিনি ফিরে যাবেন সেই জায়গাগুলোতে। তাকে যে যেতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? চাইলেই কী আর অতীতে ফিরে যাওয়া যায়? ওয়ান ওয়ে জীবনের তো শুধুই সামনে চলা। পেছনে ফেরার সমস্ত পথ বন্ধ।

তিনি চাইলেও আজ তার প্রথম চাকরি জীবনের প্রথম পিয়ন নিয়োগের জন্য নিজের ওপরের অর্পিত সমস্ত ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে সেই অযোগ্য কুষ্মাণ্ড যে ছেলেটাকে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তার পরিবর্তে কী সেই সুবোধ ছেলেটি যে কিনা ওই পদের সমস্ত যোগ্যতা নিয়েই এসেছিল। যে কিনা তার জীবনের করুণ গল্পটিও শেয়ার করে শুনিয়েছে, বোঝাতে চেয়েছিল চাকরিটি তার নিতান্তই দরকার ছিল। না টাকার বিনিময়ে চাকরিটা তিনি সেই কুষ্মাণ্ডকেই দিয়েছিলেন। যোগ্য ছেলেটির অশ্রুসজল সেই চোখ দুটো এখন তাকে বিব্রত করছে। সেই থেকে শুরু? তাই কী? আরও আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে? ওই যে সেই ঘটনাটি? নাহ, তিনি মনে করতে চান না।

আচ্ছা একটা তালিকা তৈরি করলে কেমন হয়? তারপর সেই তালিকা ধরে একটু একটু করে যদি আগানো যায়? সব কী আর মনে আছে? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন সগিরুদ্দিন। এবারে তিনি সত্যি সত্যি বিগত ত্রিশ বছরের একটা তালিকা তৈরি করতে বসলেন। মেমোরি থেকে লিখতে থাকলেন এক এক করে। এই তালিকায় কোনো সফলতার কথা স্থান পাবে না। শুধুই সেই সব ঘটনাগুলো যেগুলো তিনি ইচ্ছে করলেই সঠিক পথে প্রবাহিত করতে পারতেন। লোভ, ক্ষমতার লিপ্সা, মোহ এসবের জন্য কত কীই না তিনি করেছেন। বড় ছেলেকে বিসিএসআইআর-এ চাকরি দিয়ে সরকারি বৃত্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানো। তার বড় ছেলে তো আর তেমন মেধাবী ছিল না। শেষে পিএইচডি না করেই বিদেশে থেকে গেল। অথচ সেই তালিকায় কত মেধাবী ছেলেমেয়ে ছিল। সেটা না হয় নিজের ছেলের জন্য করেছেন। এর আগে পরে আরও অনেকবার কতজনকে...ছিঃ। ক্ষমতার বলে, অর্থের লোভে কত কীই না করেছেন। আর এসব বলে কী হবে। নিজের পরিবারের সঙ্গেও কী তিনি সদাচরণ করেছেন। নেহাতই ভালো মানুষ বলে তার স্ত্রী মুখ বুঁজে সারা জীবন সব সহ্য করে গেছেন। আসলে কোনো দিনও কী তিনি ভালো ছিলেন? না, এত বড় লম্বা তালিকা করার সময় তার এখন নেই। তিনি কোনো ঘটনাকেই এখন আর উল্টো পথে প্রবাহিত করতে পারবেন না। তালিকা করেই বা কী হবে? বড়ই আফসোস।

এভাবেই সাত দিন পার হয়ে গেল। সগিরুদ্দিন ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ দিয়ে চলেছেন। এর মধ্যে ওয়ালিউল্লাহকে দেখতে গিয়েছেন অনেকবার। বন্ধুর শয্যাপাশে বসে নিজে ভেতরে-ভেতরে কেঁদেছেন, বন্ধুর জন্য নয় বরং নিজের কথা ভেবে। আজকে মনে হচ্ছে, ওয়ালিউল্লাহ আর তার মধ্যে চরিত্রগত খুব একটা পার্থক্য ছিল না। দুজনেই প্রায় সমান ক্ষমতার অধিকারী থাকায় একে অন্যকে অনেকভাবে সহায়তা করেছেন অনেক খারাপ কাজে। কিন্তু আজকে তার নিজের যে বোধোদয় হচ্ছে সেটা কী ওয়ালিউল্লাহর হয়েছিল? এদিক দিয়ে কী তিনি সৌভাগ্যবান? নাহ ওয়ালিউল্লাহকে নিয়ে ভাবার সময় এখন তার নাই।

আর মাত্র একুশ দিন। এর মধ্যে যতখানি পারা যায় করতে হবে। কিন্তু কী করবেন তিনি। সাত দিনে তো কিছুই করা হলো না। আচ্ছা, ওই ছেলেটাকে কী কোনোভাবে খুঁজে বের করা যাবে? ওই যে ওই পিয়ন, যে চাকরির জন্য এসেছিল। কিন্তু কীভাবে? শুধুই নামটা মনে আছে। আরতো কিছুই মনে নাই। পঁয়ত্রিশ বছরে কত কী বদলে গেছে। সে কোথায় আছে কে জানে। যদি তাকে খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে তিনি কী করবেন? হাত জোর করে ক্ষমা চাইবেন? হুম, সেটা হতে পারে। অথবা ওই যে ভদ্রমহিলা, যার স্বামী মারা যাওয়ার পর স্বামীর পেনশনের ফাইল সই করতে এসেছিলেন। এই মুহূর্তে সগিরুদ্দিন সাহেবের হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে। সেই অসহায় ভদ্রমহিলাও তো বাদ যায়নি। তাকেও কতগুলো টাকা গুনতে হয়েছে। এই কাজটি তিনি নিজে করেননি, কিন্তু করিয়েছেন অন্যকে দিয়ে। অবশ্য সেই মহিলাকে তিনি চেনেন। তার কাছে গিয়ে কী ক্ষমা চেয়ে নেবেন? না এসব সম্ভব নয়। কোনোটাই সম্ভব নয়। তিনি আর তালিকা বাড়াতে চান না​।

সগিরুদ্দিন এখন অন্য উপায় খুঁজছেন। শান্তি খুঁজছেন। নিশ্চয়তা খুঁজছেন। কে বলতে পারবে কী করলে এখন থেকে ঠিক দুই সপ্তাহ পরে তিনি প্যারালাইজ হয়ে যাবেন না। ভয়ে এখন তিনি খাওয়া-দাওয়া প্রায় অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছেন। এখন তিনি সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে খুব ভয় পাচ্ছেন। খুব সাবধানে করছেন এই কাজটি। যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন আগামী দুই সপ্তাহ তিনি আর কোথাও বেরোবেন না। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করবেন না। এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে তার পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে। তারপরও কী ঘটে যেতে পারে ঘটনাটি? সগিরুদ্দিন লিভিং রুমে তার বিছানা পাতলেন। বাসার সবাই খুব অবাক হলো কিন্তু কেউ কিছু বলল না। শুধু বড় ছেলে আমেরিকা থেকে টেলিফোনে জানাল, বাবা, তুমি কী পাগলামি শুরু করলে আবার? ওয়ালি কাকা প্যারালাইজ হয়েছে বলে তোমারও হবে? কী যে করো না বাবা।

আজ হঠাৎ সগিরুদ্দিন সাহেবের মনটা খুবই উতলা। একবার কী ওয়ালিউল্লাহকে দেখতে যাবেন? না, ইচ্ছে করছে না। তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। লম্বা সময় নিয়ে নামাজ পড়লেন। দুই হাত তুলে মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে মোনাজাত করলেন। ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। সমস্ত কৃতকর্মের জন্য। সারা দিন তিনি নামাজ কালাম ইবাদত বন্দেগি করেই কাটিয়ে দিলেন। আজকের দিনটি কী একটু অন্য রকম? সব দিনের চেয়ে আলাদা? সন্ধ্যায় মসজিদে রওনা হলেন। অনেক দিন পর? হ্যাঁ অনেক দিন পর। একেবারে এশার নামাজ পরে বাসায় ফিরলেন। একটু কী অন্য রকম লাগছে? হয়তো, কিন্তু পার্থক্যটা বুঝতে হয়তো সময় লাগবে। আর মাত্র ১২ দিন। আচ্ছা তিনি কী আত্মীয়স্বজন সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবেন? না, সেটা কী ভালো দেখাবে?

অবশেষে সগিরুদ্দিন সাহেবের জীবনে ঘনিয়ে এল সেই দিন। আর মাত্র একদিন। এর মধ্যে অবশ্য তিনি নিজেকে একদম বদলে ফেলেছেন। অনেক কিছু বদলিয়েছেন তিনি। অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। সর্বক্ষণ আল্লাহকে ডেকেছেন। ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। যদিও যতই দিন ঘনিয়ে আসছে তার ভয় বেড়েছে অন্যদিকে মনে মনে কোথায় যেন একটা প্রশান্তির আভা পেয়েছেন হয়তো বা। কিন্তু ভয় কাটেনি। পঁয়ত্রিশ বছরের সব কৃতকর্মকে যদি মহান আল্লাহ ক্ষমা করেন তাহলে প্যারালাইজ হলেও খুব একটা অনুতাপের কিছু হয়তো থাকবে না। কিন্তু তিনি ক্ষমা পেয়েছেন কিনা সেটা জানবেন কীভাবে? জানার কোনো উপায় আছে কী? আজকে আছরের নামাজের পরে মসজিদের ইমাম সাহেবকে কী একটু জিজ্ঞাসা করবেন? না থাক।

সন্ধ্যা ফুরিয়ে রাত। সগিরুদ্দিন সাহেবের চোখে ঘুম নেই। রাত পোহালেই কিছু একটা ঘটবে। তিনি বাসার সবার সঙ্গেই টুকটাক কথা বললেন। মেজো ছেলেকে ডেকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিলেন। মেজো ছেলে তার কথার আগামাথা কিছু বুঝল কিনা কে জানে। ছেলের বউয়ের মাথায় হাত রেখে কাঁদলেন। টেলিফোনে বড় ছেলে, নাতি নাতনিদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদলেন। একমাত্র মেয়েকে ফোন করে বললেন, মারে আমাকে মাফ করে দিস।

তিনি মোটামুটি নিশ্চিত হলেন ঘুমিয়ে গেলেই বিপদ ঘটবে। ঘুম থেকে জেগে আর তিনি তার পা নাড়াতে পারবেন না। তাই না ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। সারা রাত ইবাদত করে কাটিয়ে দিলেন। ফজরের নামাজ পড়তে পড়তেই কেমন যেন ঘুমের মধ্যে হারিয়ে গেলেন তিনি। বহুদিনের ক্লান্তি তাই নিজেকে আর জাগিয়ে রাখতে পারলেন না সগিরুদ্দিন।

পরদিন শুক্রবার। সবাই বাসায়। মেজো ছেলের ‘বাবা’ ডাকে ধড়ফড় করে জেগে উঠলেন। মনে হলো যেন পাটা নাড়াতে পারছেন না। চিৎকার করতে গিয়েই থেমে গেলেন। আবারও পা নাড়ালেন। এইবার পা নড়ে উঠল। নিজের গায়ে চিমটি কাটলেন। এটা কী সত্যি? তিনি প্যারালাইজ হননি। তা কী করে সম্ভব। সোফা থেকে নামলেন। এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করে বারবার নিশ্চিত হলেন। এবারে চিৎকার করে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলেন অনেকক্ষণ। কান্না শুনে পুত্রবধূ, নাতি–নাতনিরা সব ছুটে এল। কী জানি এক অন্য রকম ভালো লাগায় মনটা ভরে উঠল। তার কাছে মনে হলো যেন এই জীবনটাই তিনি চেয়েছেন। আগের অতিক্রান্ত জীবনটি তার প্রত্যাশিত ছিল না। এই জীবন ফিরে পাওয়ার রহস্যটা তিনি জানেন না। শুধু এটুকু জানেন এমনিই হওয়ার কথা ছিল। কী যেন এক অজানা আনন্দে মনটা ভরে উঠল। এখন তিনি অনেক সময় পাবেন হয়তো নিজেকে শুধরে নেবার। হয়তো তিনি বিগত ৩৫ বছরে যা কিছু করে এসেছেন তা তিনি শোধরাতে পারবেন না। কিন্তু সামনে যত দিন বেঁচে থাকবেন নতুন করে বাঁচবেন ঠিক যেভাবে বাঁচার কথা। এবারে তিনি আস্তে আস্তে সেই তালিকাটি তৈরি করবেন। এবারে তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। প্রায় দুই সপ্তাহ ওয়ালিউল্লাহকে দেখতে যাননি তিনি। অনেক বড় অন্যায় করেছেন। নতুন এক উন্মাদনা নিয়ে জেগে উঠলেন সগিরুদ্দিন। ছুটে চললেন প্রিয় বন্ধু ওয়ালিউল্লাহকে দেখার জন্য।
...

নুরুল হুদা পলাশ: সাস্কাতুন, সাস্কাচেওয়ান, কানাডা। ইমেইল: <[email protected]>