আত্মহনন রোধে প্রয়োজন হতাশা নিরাময়কেন্দ্র

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমাদের অর্থাৎ মানুষের আমিত্ববাদের ইতিহাসের অতি পুরোনো। আমি কত সুখী, আমি তোমায় ভালোবাসি, আমি ক্ষমতাবান, আমি তোরে মজা দেখাচ্ছি ইত্যাদি হাজার হাজার রূপে আমরা আমাদের উপলব্ধি করছি প্রতিনিয়ত। বাস্তব আমি কী আসলেই আমি? আমি আসলে কে? চিন্তায় হারিয়ে নিজেকে এমন উদ্ভট প্রশ্ন করলে নিজেকে আসলে পাগলই মনে হবে। তখন আবার প্রশ্ন উঠবে, আমি কী পাগল? মনে হয়, আমি আসলে আমার না, একইভাবে আপনি নিজেও আপনার না।

সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই মা দাবি করেন সন্তানটি আমার। বাবারও একই দাবি। চাচা বলেন আমার ভাতিজা আর মামা বলেন আমার ভাগনে। কত শত আমার দাবিতে শিশু আলালেরা দুলাল হয়ে ওঠে। জন্ম নিবন্ধনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ তথা দেশ ও দাবি করে এই সন্তান আমার। সময়ের সঙ্গে সন্তানটিও আস্তে আস্তে সব আমার জিনিসের দাবিগুলো শিখে যায়। বাস্তবে এভাবেই হয় অদৃশ্য সামাজিক চুক্তি।

আমি কী আসলে আমার? না মনে হয়, সব আমিই নিছক আমার নয়। আমার আমিতে অধিকার আছে মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, সমাজ, দেশ ও এই পৃথিবীর।

আমার আমিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে বাচ্চা শিশুটিকে ‘আমার’ আবেগ, ভালোবাসা, কষ্ট, টাকাপয়সা খরচ করে ঠিক আমার মতো করে বড় করে তোলার কত চেষ্টা মা-বাবা, সমাজ বা দেশের। অসংখ্য আমি প্রতিনিয়ত জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলার সংগ্রামে জয়ী হয়, কেউবা লড়ে যায়। আর কিছু আমি একটু পথ পাড়ি দিয়েই হোঁচট খায়। সকল চিন্তা-ভাবনা ও অনুভূতি এসে যখন একটি সমস্যার গোড়ায় এসে থেমে যায়, ওই সব আমিকে তখন স্বার্থপরের মতো অর্থহীন মনে হয়। সোজা ভাষায় সাময়িকভাবে জীবনকেই অর্থহীন মনে করে, বেঁচে থাকার পথ বের না করে অবিবেচকের মতো শরীরের শিরা উপশিরায় প্রবহমান রক্তের মতো প্রাণের স্পন্দন আমিদের দুঃখের সাগরে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

প্রতি বছর স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থী প্রেমে ব্যর্থ বা ভালো ফলাফলে ব্যর্থ হয়ে অথবা সাময়িক বেকারত্বে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। গত কয়েক বছর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের মাঝে বেকারত্বের হতাশায় আত্মহত্যার হার চোখে পড়ার মতো।

কয়েক মাস আগে সংবাদপত্রে পড়েছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তরুণ হোসেনের আত্মহত্যার কারণ ছিল দারিদ্র্যের সঙ্গে ইনফিরিয়র কমপ্লেক্সিটি। বেশ কিছুদিন আগে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন এমবিএর ছাত্র তানভীরের একাডেমিক ভবনের ১০ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা যেমন হৃদয়বিদারক, তেমনি কয়েক দিন আগে ওই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের মুশফিকের ছাদ থেকে পড়ে আত্মহত্যার খবরও সত্যি কষ্ট পাওয়ার মতো। এত গেল আমার জানা মতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র কয়েকজন শিক্ষার্থীর ঘটনা। সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরব্যাপী আত্মহত্যার সংখ্যা হিসাব করলে সংখ্যায় প্রচুর হবে।

লেখক
লেখক

প্রেমের সম্পর্কে বিচ্ছেদের জের ধরেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেকগুলো আত্মহত্যা দেখেছি। পড়াশোনার ভালো ফলাফল না করতে পারায় আত্মহত্যা করার ব্যাপারটা তেমন ঘটেনি। এখানে এসে প্রথম শুনেছি, আমেরিকার নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী পড়ার চাপ সামাল দিতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। ইমোরি, এমআইটি, হার্ভার্ড, ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ও ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়াসহ আরও অনেক নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফল সেমিস্টারে হর হামেশাই গ্র্যাড স্টুডেন্টের আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টা হয়ে থাকে।

পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের গত কয়েক বছরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট ও গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা হয়—২০১৫ সালে ৯টি, ২০১৬ সালে ২৩টি আর ২০১৭ সালে ২টি। ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় সেমিস্টারেই ২-১ জন করে আত্মহত্যা করত। এরপর থেকে শিক্ষার্থীদের ডিপ্রেশন কমাতে সেন্টার ফর হেলদি লিভিং নামে একটি হতাশা নিরাময়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতি সেমিস্টারের মাঝামাঝিতে যখন মিড সেমিস্টার পরীক্ষার গ্রেড হাতে আসে, ঠিক তখনই হতাশাকেন্দ্রটির কার্যক্রম জোরালো ভাবে শুরু হয়।

প্রায় নভেম্বরেই ফাইনালের আগে আর মিড-সেমিস্টারের দিকে বেশ কিছু শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আত্মহত্যার লক্ষণগুলো বিস্তারিত বর্ণনা করে এই লক্ষণগুলো কারও মধ্যে পরিলক্ষিত হলে সহপাঠী বা যে কেউ নিজেই হতাশা কাটাতে তাদের কাছে যাওয়ার জন্য বারংবার অনুরোধ করা হয়। প্রয়োজনে কাউন্সিলরেরা বাসায় পর্যন্ত আসেন শুধু হতাশায় যাতে কোনো জীবনের অপচয় না হয়।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো সক্রিয় মানসিক স্বাস্থ্য বা হতাশা নিরাময়কেন্দ্র আছে বলে মনে হয় না। যার কারণে প্রতি অসংখ্য শিক্ষার্থীর অকালে প্রাণ ধ্বংসের খবর শোনা যায়। এত ছাত্র মরে যায় তবু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টনক নড়ে না। আমি মনে করি, আত্মহনন রোধে আমাদের দেশে বিশেষ করে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন করা প্রয়োজন হতাশা নিরাময়কেন্দ্র।

আমাদের বিশেষত শিক্ষাকালে ও শিক্ষা শেষে আসলেই নানামুখী অপ্রাসঙ্গিক চাপে থাকতে হয় এক শ্রেণির অবিবেচক অভিভাবক গোষ্ঠীর জন্য। যাদের সব সময়ের দাবি আমার ছেলেটা ক্লাসে প্রথম হোক, আমার মেয়েটি চ্যানেল আই সুপার স্টার হোক, আমার ছেলে বুয়েটিয়ান বা ঢাবিয়ান হোক বা বিসিএস ক্যাডার হোক।‘আল্লাহ! বাবা তুমি এ প্লাস পাওনি’, ‘ভাবি আপনার ছেলের রেজাল্ট কী’, ‘আপা আপনার মেয়ের বিয়ে দেবেন না?’ ‘এই বিসিএসেও তুমি চান্স পাওনি’—এসব বলা আংকেল-আন্টিদের বোধোদয় হোক।

কেউ কেউ হয়তো মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থী, বছরে ১০০ জন আত্মহত্যা করলে তেমন সমস্যা নেই। আবার অনেকে মনে করেন, দেশে অনেক মানুষ। কিছু মানুষ আত্মহত্যা করলে টের নাও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মানুষের জীবন তো একটাই, সেই জীবন অবহেলায় অপচয় করলে সেই আমার আমিকে বাঁচাবে কে?

আসুন আমরা সবাই সচেতন হই। আত্মহত্যা না করে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকি। ক্লাসে প্রথম না হলে জীবন শেষ হয়ে যায় না। বিসিএস ক্যাডার না হলে জীবনের সব স্বপ্ন নষ্ট হয়ে যায় না। এক বছর দেরিতে বিয়ে হলে যৌবন পালিয়ে যায় না।

আমি মরলে কী আংকেল আন্টিদের মূল্যবান তত্ত্বকথা বলা কী বন্ধ হবে?
...

রেজাউল হক নাঈম: পিএইচডি শিক্ষার্থী, পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়েস্ট লাফায়াতে, ইন্ডিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <facebook.com/nayeee1 m>