অন্তঃপুরে ক্যান কান্দে সুন্দর মেয়ে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কনে রাঙা বিকেল, ফসলের মাঠ, গাছগাছালি আর বুনো লতা মেতেছে অন্য-আদরে। আমি, মাধবী, জুঁই আর চামেলি বউচি খেলায় ব্যস্ত। বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে কয়েকটা দিন দাদির বাড়িতে থাকব বলে, সারা বছর ধরেই মনে চলত আনন্দ আয়োজন। পিঠাপুলি, বিন্নি ভাত, নয়া পানির মাছ, এগুলোও টানত খুব। দাদি মাগুর মাছ একটু ঝোল ঝোল করেই রান্না করতেন। আমি শুকনো তরকারি খেতে পারি না। ভাত যেন ঝোলের ভেতর ডুবে থাকে, নইলে সঙ্গে ডাল। দাদির রসভরা গালগল্প আর আদরের সঙ্গে আমার যত্ন-আত্তির একটা শাহি ব্যবস্থাপনা অন্য ভাইবোনদের মনে কিঞ্চিৎ ঈর্ষা ছড়াত!

সেই গাঁয়ে ছিল রাঙা বউ। চার বেহারার পালকিতে চড়ে, বেনারসি, সোনার কঙ্কণ আর ভাত-ঘরের স্বপ্ন নিয়েই রাঙাবউ শ্বশুরবাড়িতে এসেছিলেন। বিশাল জায়গা জমিন, মেয়ের দুধ-ভাতের জীবন, রাঙা বউয়ের মা-বাবাকে বেশ আকৃষ্ট করেছিল বিয়েতে রাজি হতে।

রাঙাবউয়ের স্বামী জমির উদ্দিন গ্রামীণ মাতব্বরি, বিচার আচার আর জমিজমা দেখাশোনা করেই সময় কাটাতেন। ভোটের দিনে পুরো বাড়িজুড়ে চা আর টোস্ট বিস্কুটের ব্যাপক আয়োজন ছিল, সঙ্গে মুরুব্বিদের জন্য আয়েশি খেদমত। বিকেলে বাজারের এক রেস্তোরাঁ ফ্রি করা ছিল ভোটারদের আপ্যায়ন আর আড্ডার জন্য। খেতের আইল, বিলের পানিতে কোষা নৌকা আর ঝড়বৃষ্টির তাণ্ডব উপেক্ষা করে ঘরে ঘরে চেয়ারম্যান প্রার্থীর পরবর্তী কার্যবিবরণী প্রচার, তিন সন্ধ্যায় উঠোন ঘরের চৌকিতে অসহায় নারীদের মুক্তি ও পুনর্বাসন নিয়ে বৈঠক; গভীররাতে সামাজিক কূটচাল আর অনৈতিক ভাবনায় ব্যস্ত থাকা জমির উদ্দিনের ভয়ে সদ্য বিবাহিত লাল বউগুলোও পালিয়ে বেড়াত।

তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার সুন্দর বউ দেখার বাতিক ছিল। এখনো আছে। সুন্দর মেয়েদেরই তো জামাই গয়নাগাটি, শাড়ি চুড়ি কিনে দেন, সেই ভাবনায় নিত্য চলত আয়নার সামনে নিজের সৌন্দর্য পরীক্ষা। কাঁচা হলুদ মাখামাখি, হুন্দা-মেন্দির গন্ধ তো আছেই। ‘বউ’ সাজব বলেই না পৃথিবীতে এসেছি। অবশ্যই রাঙাবউ! তাই প্র্যাকটিসের জন্য এক দৌড়ে রাঙাবউয়ের কাছে হাজির হতাম। এক প্যাঁচে হলদে শাড়ি, দুই হাত ভর্তি কাচের চুড়ি, সোনারোদে দুলতে থাকা নাকছবি আমাকে তিতাস পাড়ের বাঁশিওয়ালার বউ বানিয়েই ছাড়ত!

আহা, বউ, রাঙাবউ! দুই চোখ ভরা স্বপ্ন, চারচালা ঘর, গোলাভরা ধান, ঢেঁকিঘরে আতপের ঘ্রাণ, পিঠেল মৌ মৌ! সন্ধ্যায় গঞ্জ থেকে ফেরা জামাইয়ের জন্য লাল চালের ভাত আর জিয়ল মাছের ছালুন! সরতা দিয়ে সুপারি কাটা, কুপির আলোর নোলকের ঝলকানি। হিজল পুকুরে স্নান শেষে উঠোনের তারে হলুদ বোঁটায় বাসন্তী শাড়ি মেলে দিয়ে, ভেজা চুল, নাকে জমে ওঠা ফোটা ফোটা ঘাম! তড়িঘড়ি করেই মরিচ বাঁটায় পান্তা আর হেলেঞ্চা শাক নাকেমুখে পুড়ে পাড়ার অন্য বউদের সঙ্গে ঢেঁকি ছাটাছাটি, গোপন আলাপন! রাতভর ছটফটানি, মাঘের শীতেও এপাশ-ওপাশ, জামগাছের আগায় ভূতের বাসর, তবুও বুকজুড়ে বয়ে যায় অনন্ত গহন; বাঁশি আর বাঁশরিয়ার!

রাঙাবউ পুথি পড়তেন। নকশিকাঁথায় গাঁথতেন বঞ্চিত জীবনের প্রাচীন-কাব্য। সেলাইয়ের প্রতি ফোঁড়েই সম্ভাবনাময়ী একঝাঁক পাখির দল গতরাতে বটবৃক্ষের আঁচলে নেতিয়ে পড়া লতাগাছের স্বাধীন জীবন প্রার্থনায় বৈঠকি আসরে নতুন প্রাণ সঞ্চার করত। রাঙাবউ বেঁচে উঠতেন! বাঁচতে চাইতেন কৌশলী নির্যাতনের আদিম-অচেনা কারাগার থেকে। নতুন শাড়ি আর দুই হাতে সোনার বালা পরে নাইওর যাওয়া হলো না। হলেই কী হতো, কপালের দোহাই দিয়ে পুনরায় জামাইয়ের বাড়িতেই পাঠানো হতো। বংশের সুনাম আছে না!

অবাক বিস্ময়ে ভাবতাম রাঙাবউয়ের স্বামী এত ধনী অথচ শহরে নিয়ে ভালো ডাক্তারও দেখাল না। কখনো রেগুলার হেলথ চেকআপও হয়নি। ইতিমধ্যেই অযত্নের হৃৎপিণ্ডে ঘুণ ধরেছে। হৃদয়েরও। অসুখটুকু মন ছাপিয়ে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। সময়কে সময় না দিলে শেষ রক্ষাও হয় না। অন্য ঘর যেন কারও জন্য তৈরিই থাকে। ঘর-গেরস্থালির কাজ আর বিলাসব্যসন ঠিকমতো হচ্ছে কী না জামাইবাবু রক্তচক্ষু নিয়েই তা পর্যবেক্ষণ করতেন।

রাঙাবউয়ের বাড়ির পাশ দিয়ে আমি আজও হাঁটি। সেই লাবণ্য, পানপাতা-মুখশ্রী, কাজলা চোখ, যুগল ভ্রু, গল্পকথার পানসি নদী, আর নেই, আর নেই!

সময় গড়িয়ে যায়, ম্যাপল পাতা ফোটে আর ঝরে। হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত শেষে জানলায় উঁকি দেয় কয়েকটা শুভ্র তুষার ফুল। ওই তো সামনেই সোনাদিঘি। আমার মন পবনের নাও ভাসে। হেসে ওঠে জীবনের মাছগুলো।

পঞ্চবটির ঘাটে খেয়া পারাপার, এ যাত্রায় ফিরে যাওয়া পাখিরাও পেছন ফেরে। এক অমোঘ টান। ঘরে ফেরার। মাটির পিঞ্জিরায় ময়নার ছটফটানি! লগ্নের অপেক্ষায়...।

তবুও উত্তরীয় বাতাসে হু হু কান্নার রোল!

দূর বহুদূরে...বুকের গহিন জমিনে পতপত উড়তে থাকে স্বাধীন পতাকা।

বিজয় তো এল!

তবুও...

অন্তঃপুর ক্যান কান্দে, সুন্দর মেয়ে!

মুক্তা মাহমুদা: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।