দুষ্টু ছেলের দল-দুই

বাদাম খেতে খেতে পাড়ু বলল, আজ আর কোনো চুরির মধ্যে যাচ্ছি না। তার চেয়ে চল সবাই মিলে নিহার বাবুর পুকুরে গোসল করতে যাই। এমনিতেই চুরি করতে গিয়ে প্রায় ধরা পরে গিয়েছিল ওরা, তাই আর কেউ পাড়ুর প্রস্তাবে না করল না।

শুধু সালাম বলল, আমাকে কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। না হলে কাকা আমার পিঠে কঞ্চি ভাঙবে।

শুনে পোবো বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, আগেতো পুকুরে গিয়ে নামি তারপর ভাবা যাবে।

বিদ্যুৎ বলল, আমাকেও একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। কারণ, দোকানে বাবার জন্য ভাত নিয়ে যেতে হবে।

তারপর তারা বাঁশের ঝোপ থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে না গিয়ে মাঠের মধ্যে খেতের মধ্যে দিয়ে সোজাসুজি নিহার বাবুর পুকুরের দিকে হাঁটা শুরু করল।

বাড়াদি গ্রামটা অনেক বড়। সেই মঙ্গলবাড়ি থেকে শুরু করে একেবারে জগতি পর্যন্ত বিস্তৃত। বাড়াদির পূর্ব দিকে উদিবাড়ি, চৌড়হাস, জগতির উত্তর দিকে মঙ্গলবাড়ি আর দক্ষিণে জগতি। গড়াই নদীটা বাড়াদিকে শুরুতে উদিবাড়ি থেকে পরবর্তীতে চৌড়হাস ও জগতি থেকে আলাদা হয়ে বয়ে চলেছে। আর পশ্চিম দিকে রয়েছে অবারিত মাঠ, যেখানে সারা বছরই চলে বিভিন্ন ফসলের আবাদ। বাড়াদি আর মাঠের মধ্যে ব্যবধান তৈরি করেছে গড়াই কপোতাক্ষ প্রকল্পের একটা খাল, যেটা স্থানীয়দের কাছে ক্যানাল নামেই বেশি পরিচিত। এ ছাড়া, গ্রামের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকটা বাড়িতেই একটা করে পুকুর আছে। যেটাকে কুষ্টিয়ার স্থানীয় ভাষায় পুষ্করিণী বলে। তবে কয়েকটা পুকুর আছে যেগুলোকে সবাই নামে আলাদা করে চেনে।

মন্টু চাচার পুকুর, নিহার বাবুর পুকুর, আবুল মিঞার ইটভাটার পুকুর। আবুল মিঞার ইটভাটার পাশেই একটা বিশাল পুকুর। অবশ্য সেটাকে পুকুর না বলে বড় একটা খাল বলাই শ্রেয়। এই কিশোরের দল মাসে দু-একবার আবুল মিঞার পুকুরে যায় গোসল করতে। তা ছাড়া বেশির ভাগ দিনই নিহার বাবুর পুকুরে গোসল করে। অবশ্য সেটাকে গোসল না বলে জলকেলি বলাই শ্রেয়। তাদের প্রতিভা বিকাশের অন্যতম জায়গা হচ্ছে এই নিহার বাবুর পুকুর। সমবয়সী এই কিশোরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নিহার বাবু পুকুরে কঞ্চিসহ বাঁশের মাথা ফেলে রেখেছেন। কিন্তু তাতেও এই কিশোরদের নিরস্ত্র করা যাচ্ছে না।

নিহার বাবুর পুকুরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ওই পুকুরের পূর্ব পাড়ে যেটা আসলে রাস্তার পাড়ে আর উত্তর পাড়ে যেটা তাদের বাড়ির সঙ্গে লাগানো, দুই দিকে দুটো শানবাঁধানো ঘাট আছে। কিশোরের দল পুকুরে এসে নামলে তাদের আর সময় জ্ঞান থাকে না। তারা সোজা লাফ, ঘুরে লাফ, সোজা ডিগবাজি, উল্টো ডিগবাজি ছাড়াও খুব সুন্দর করে ডাইভ দিয়ে পানিতে লাফিয়ে পড়ে। এতে করে পুকুরের পাড় ক্ষয় হতে শুরু করেছে। যেকোনো সময় হয়তো ভেঙে পড়তে শুরু করবে। তাই নিহার বাবু মাঝেমধ্যে একটা লাঠি নিয়ে উত্তরপাড়ের ঘাটে এসে বসে থাকেন। অবশ্য এতেও কিশোরের দল নিরস্ত্র হয় না। তারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে যেই কোনো কাজে তিনি উঠে একটু বাড়ির মধ্যে যান, সঙ্গে সঙ্গে তারা আবার দল বেঁধে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাঝেমধ্যে নিহার বাবুর ছোট মেয়ে যাকে তারা পিসি বলে ডাকে, তিনি এসে বসেন। তখন অবশ্য কিশোরের দল চুপ হয়ে যায়। কারণ তারা জানে পিসি দেখতে যতটা সুশ্রী, মনের দিক দিয়ে ঠিক ততটাই কঠিন।

নিহার বাবুর পুকুরের পশ্চিম পাশে জাহিদ নানাদের আর পাশাপাশি গোপাল ও পিন্টুদের বাড়ি। আর দক্ষিণ পাশে জান্টুদের বাড়ি। পুকুর ঘাটের দুপাশেই কঞ্চিসমেত বাঁশ থাকাতে সেদিন কিশোরের দল শুধু এ ঘাট থেকে ও ঘাট সাঁতার কেটেই সময় কাটল। বর্ষাকালে অবশ্য জাহিদ নানাদের বাড়ির ছাদ থেকেও ওরা পুকুরে লাফিয়ে পড়ত। তখন পানির স্তর নেমে যাওয়াতে লাফ দিয়ে ঠিকই পানিতে পড়ে কিন্তু এক হাঁটু কাদার মধ্যে গেঁথে যেতে হয়। তাই ছাদ থেকে লাফ দেওয়া থেকে ওরা নিজেদের নিরস্ত্র করেছে।

অবশেষে পোবোই বলল, ধুর এইভাবে আর কতক্ষণ ভালো লাগে, চল ডাইভ দিই। শুনে সালাম বলল, কিন্তু দুপাশেই তো বাঁশ। কোথায় ডাইভ দিবি তোরা। বিদ্যুৎ বলল, ঘাটের একটু কোনাকুনি ডাইভ দিলে আর কঞ্চিতে বাধবে না। পাড়ু বলল, সবইতো বুঝলাম, আগে ডাইভ দেবে কে? আমি আর এবার আগে যাচ্ছি না। এমনিতেই সকালবেলা তোরা আমাকে রেখে ভেগে গিয়েছিলি। পোবো বলল, ঠিক আছে আমি সবার আগে ডাইভ দেব। এরপর বিদ্যুৎ আর সালাম। সবশেষে দিবি তুই। পাড়ু বলল, ঠিক আছে তাহলে শুরু কর। ওরা তিনজন একে একে ডাইভ দিয়ে সাঁতরে পূর্ব পাড়ের ঘাটে গিয়ে উঠল।

পাড়ু ডাইভ দিয়ে পানিতে পড়ার মুহূর্তেই মনে হলো ওরা মাথাটা কোনো কিছুর সঙ্গে ঠুকে গেল। কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সে সাঁতরে অন্য ঘাটের দিকে এগিয়ে চলল। অন্য ঘাট থেকে পোবো, বিদ্যুৎ ও সালাম সবাই ঘাটের নিচে পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে চিৎকার ওকে কী যেন বলছে। কিন্তু পানির শব্দে পাড়ু শুনতে পারল না। কিন্তু ওর মনে হচ্ছে, কানের মধ্যেও রেলগাড়ির সাইরেন বাজছে। ঘাটের কাছাকাছি আসতেই পোবো ওর ডান হাতটা বাড়িয়ে পাড়ুর ডান হাতটা ধরে এক ঝটকায় পানি থেকে তুলে ফেলে তাড়াতাড়ি বাম হাতে পাড়ুর কপালের ডান পাশ চেপে ধরল। পাড়ু জিজ্ঞেস করল, তুই এমন উতলা হচ্ছিস কেন, আমি ঠিক আছি। শুনে পোবো পাড়ুর মুখটা ঘুড়িয়ে পুকুরের দিকে করে দিল। তখন পাড়ু দেখল ওই ঘাট থেকে এই ঘাট পর্যন্ত একটা ছোট লাল আভা ছড়ানো। ইতিমধ্যে রক্তে পোবোর হাত ভিজে পাড়ুর শরীরে রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে।

পাড়ুদের দলের আচরণে তাদের অভিভাবকেরা এতটাই ত্যক্ত বিরক্ত ছিল যে, পাড়ুর বাবা জোর গলায় ঘোষণা দিলেন পাড়ুর এই কাটা জায়গাটাতে সেলাই করাবেন না। যাতে পাড়ু বড় হয়ে উপলব্ধি করতে পারে আসলে তারা ঠিক কতটা দুষ্ট ছিল। এভাবে পরবর্তী কিছুদিন পাড়ু শুধু পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপিটা আর করল না। তা ছাড়া সব রকমের দুষ্টুমিতে অন্যদের সঙ্গ দিল।

লক্ষ্মীপুজোর দিন রাতে পোবোদের বাড়িতে বসে ওরা পরিকল্পনা করে ফেলল অসীমাদের গাছের বাদাম চুরি করার। সমস্যা হয়ে দাঁড়াল অসীমার নানি, যাকে ওরা সবাই দিদা বলে ডাকত। অসীমার মায়ের একটা অদ্ভুত অসুখ আছে। তিনি সকাল থেকে উদাস দৃষ্টিতে সারা পাড়াময় ঘুরে বেড়ান। কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। কিন্তু পাড়ার বাইরে কোথাও যান না। এই কিশোরের দল তাকে কোনো এক অজানা কারণে ভয় পায়। অসীমাই পরিবারের সবচেয়ে ছোট। তার সবচেয়ে বড় ভাই বিপ্লব। তারপর বড় বোন অনিতা। অবশ্য অসীমাকেও ওরা ভীষণ ভয় পায়। কারণ, অসীমা অনেক বেশি ঝগড়াটে। আর কথায় কথায় ছেলেদের সঙ্গে মারামারিও শুরু করে দেয়। একাই সে তিন চারজন ছেলেকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

চুরির পরিকল্পনা করে তারা অপেক্ষা করছিল, কখন দিদার ঘরের কেরোসিনের বাতি নেভে। ততক্ষণ সবাই পোবোদের ঘরে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ জুড়ে দিল। হঠাৎ বিদ্যুৎ প্রস্রাব করার কথা বলে বাইরে বেরিয়ে গেল। ফিরে এসে জানাল দিদার ঘরের বাতি নিভেছে। তখন আবার সবাই উঠে বাইরে চলে এল। এদিন রাতে সবাই মোটামুটি ব্যস্ত থাকে। তাই এই কিশোরের দল কী করছে সেদিকে কারও খেয়াল নেই। অসীমাদের বাদামের গাছটা ওদের বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া পুকুর পাড়ে। পুকুর পাড় থেকে গাছটা ধীরে ধীরে পুকুরের মধ্যে ঝুলে পড়ছে। গাছতলায় এসে পোবো বলল, পাড়ু তুই গাছে উঠে পড়। পাড়ু বলল, না আমি এবার উঠব না আর। সবে আমার মাথার ঘা সেরেছে, এখন যদি আবার এমন কিছু করে ধরা পড়ি তাহলে আব্বা এবার মেরেই ফেলবেন।

অগত্যা পোবোকেই উঠতে হলো। কারণ রাতেরবেলা বলে সালাম আসেনি। তা না হলে পোবো ঠিকই সালামের ঘাড়ে চাপিয়ে দিত। পোবো গাছে ওঠার আগে বলল, আমি পেড়ে তোদের ক্যাচ দেব, কিন্তু আমি গাছ থেকে না নামা পর্যন্ত তোরা গাছের তলা থেকে যাবি না কিন্তু। পোবো গাছে উঠে অন্ধকারে হাতড়ে হাতের কাছাকাছি যেটা পেল সেটাই তাড়াতাড়ি পেড়ে নিচে ফেলে দিল। বিদ্যুৎ আর পাড়ু মিলে সেটাকে ধরতে গিয়ে পুকুরের পানিতে ফেলে দিল। ততক্ষণে পোবো গাছ থেকে নেমে এসেছে। পোবো বলল, বিদ্যুৎ তুই পানিতে নেমে বাদামটা নিয়ে আয় কারণ আমি গাছে উঠেছিলাম, আর পাড়ু তো পানিতে নামলেও সাঁতরাতে পারবে না, ওর কপাল কাটা। বিদ্যুৎ বাধ্য হয়ে পানিতে নেমে গেল। বাদাম নিয়ে এসে পুকুর পাড়ে বসেই সেটা সাবাড় করে দিল। তারপর বাদামের খোলাগুলো পুকুরের পানিতে ফেলে যে যার বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।

সকালবেলা পাড়ুর ঘুম ভাঙল শোরগোল শুনে। অসীমার দিদিমা তারস্বরে চিৎকার করছেন তাদের গাছের বাদাম কারা যেন চুরি করে খেয়ে আবার খোসা পানিতেই ফেলে গেছে। চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি অসীমাদের বাড়ি গিয়ে দেখে, সেখানে আগে থেকেই পোবো আর বিদ্যুৎ হাজির। হঠাৎ পোবোর ছোড়দা যাদব তাদের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, এরা চুরি করেনিতো? শুনে ওরা নিজেদের চোখ বন্ধ করে ফেলল। যেন ওদের কেউ দেখছে না আর। এ সময় হঠাৎ অসীমার কণ্ঠ শুনতে পাওয়া গেল। সে বলল, আমিতো কালকে অনেক রাত পর্যন্ত ওদের সঙ্গে লুডু খেলেছি। তারপর ওরা যে যার বাড়িতে চলে গেছে। এরা অবশ্যই চুরি করেনি। ওরা তখন হাফ ছেড়ে বাঁচল। ধীরে ধীরে ভিড় পাতলা হতে শুরু করল। শুধু অসীমার দিদিমা অচেনা চোরের উদ্দেশ্যে অবিরাম অভিসম্পাত দিয়ে গেলেন। সবাই সরে যাওয়ার পর ওরা অসীমার দিকে তাকাল। অসীমা বলল, আমি জানি তোরা চুরি করেছিস কিন্তু তোদের এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিলাম শর্ত একটাই, এখন থেকে আমাকে তোদের সব অভিযানে সঙ্গে রাখতে হবে। ওরা তিনজন একসঙ্গে ঘাড় নেড়ে সায় দিল।


মো. ইয়াকুব আলী, মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: 
দুষ্টু ছেলের দল