হঠাৎ স্বর্ণকেশী!-সাত

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পা বাড়ালাম বটে, কিন্তু পা বড্ড ভারী ঠেকল। এগোতে চাইল না যেন। ভাবলাম, একবার পেছন ফিরে দেখি লতা ঠিকমতো রাস্তা পেরোতে পারল কিনা। কিন্তু সেতো ভাঙে, তবু মচকায় না গোছের মেয়ে। অন্তত এতক্ষণের পরিচয় থেকে যেটুকু বুঝেছি। ক্রাচ নিয়ে রাস্তা পার হওয়া লতার কাছে হাতের তুড়ি। ঠাস করে আমাকে চড় মারার আগে যেমন তুড়ি বাজিয়েছিল, তেমন তুড়ি। মনে হতেই হাত চলে গেল গালে। কী শক্তি দিয়ে মেরেছিল বাপস। এখনো যেন জ্বলছে। কিন্তু, আশ্চর্য, অপমানে না, অন্য কিছুতে। ধরতে পারছি না। ধরতে পেরে কাজ নেই। নিজেকে কষে বকা দিলাম—‘হুরর অনীক মিয়া, বেশি ন্যাকামি হচ্ছে। পুতুপুতু আউট। শিনা টান ইন। আগে বাড়ো, জওয়ান। লিঙ্কস-রেখস্ট, লিঙ্কস-রেখস্ট, লেফট-রাইট, লেফট-রাইট।’

পা চালাতে চালাতে মনে মনে সকালে কাজের যে একটা ফর্দটা করেছিলাম, সেটাকে ডাকলাম। ডাকামাত্র আলাদিনের চেরাগ ফুঁড়ে দৈত্যের মতো ইয়া লম্বা চওড়া এক লিস্টি বেড়িয়ে এল। বেয়াড়া রকম বেড়ে যাওয়া চুল কেটে কদম ছাঁট করা, সাত দিনের দাঁড়ি কামিয়ে তিন দিনের দাঁড়িতে নামিয়ে আনা, গোটা তিনেক ফরমাল শার্ট কেনা, সঙ্গে কয়েকটা স্যান্ডো গেঞ্জিও, বাংলাদেশি দোকানে গিয়ে কাজলি মাছের জন্য হানা দেওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি মামুলি কাজের সুদীর্ঘ তালিকা। মনে মনে তাতে চোখ বোলাচ্ছি।

এ সময় বাঁধ সাধল বাঘ আকৃতির এক জার্মান শেফার্ড। ফুটপাথের সমান্তরালে সাইকেলের জন্য রাখা সরু লেন দিয়ে তার মালিক ফুরফুরে মেজাজে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। আর শেফার্ড। সাহেব কেশর ফুলিয়ে ফুটপাথ দিয়ে ছুটছে তার পিছু পিছু। চোখে পড়ল, কুকুরটার মুখে মাজল পড়ানো। মানে এখনো ঠিক নতুন মালিকের বশে আসেনি পুরোপুরি। ঘ্যাক করে কামড়ে দেওয়ার আশঙ্কায় এই ব্যবস্থা। কালো আর ঘিয়া মেশানো এই প্রকাণ্ড প্রাণীটাকে দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। দৌড়ানোর ভেতর এক ধরনের বন্যতা আছে।

কিন্তু, একি! কুকুরটা যেন খুব ক্ষেপে গিয়ে এলোপাতাড়ি ভঙ্গিতে ছুটে এসে আচমকা ধাক্কা দিয়ে প্রায় গায়ের ওপরে উঠে যাচ্ছে। ধাক্কা খেয়ে আমি লাটিমের মতো বাঁই বাঁই করে বার কয়েক ঘুরপাক খেয়ে দেয়াল ধরে কোনোমতে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে কুকুরটা অস্ফুট গর্জন তুলে সাঁই সাঁই করে নেই হয়ে গেছে। জার্মান শেফার্ড বলে কথা। তার ওপর আবার আধা পোষ মানা। যাক বাবা, খুব বেঁচে গেছি। ঘাড় মটকে দেয়নি, এই বেশি।

চকিতে কী যেন মনে হলো। অতীন্দ্রিয়ের মতো কিছু একটা কাজ করল বোধ হয়। পেছন ফিরে তাকাব, তার আগেই ঠন করে ধাতব কিছু আছড়ে পড়ার শব্দে অজানা আশঙ্কায় জমে গেলাম। মুহূর্তের অসাড় ভাব কাটিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম, লতার ক্রাচ উড়ে গিয়ে মাঝ রাস্তায় পড়েছে। আর কুকুরটা দূরে বিন্দু থেকে বিন্দুতর হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। আর...আর, লতা এলোমেলোভাবে ফুটপাথে পড়ে আছে। নিঃসাড়। একটা হাত প্রায় রাস্তার ওপরে। কোনো কিছু না ভেবে নিজের অজান্তেই লতা বরাবর ছুটতে লাগলাম। সিগনাল লাল কী সবুজ, জানি না। হঠাৎ বিশাল একটা ট্রাকের শেষ মুহূর্তের প্রচণ্ড ব্রেকের তুমুল আর্তনাদে থমকে দাঁড়ালাম। ঘ্যাচচচ্...! (চলবে)

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানি।

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: