রুটি চোর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রচণ্ড গতিতে ট্রেন ছুটে চলেছে। মালয়া এক্সপ্রেস। পুরোনো দিল্লি থেকে নরেশ পাণ্ডে উঠেছে। গন্তব্য পাঠানকোট। প্রায় বারো ঘণ্টার পথ। মাত্র তিন ঘণ্টা কেটেছে। আরও প্রায় নয় ঘণ্টা বাকি। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে নরেশের পেটের ক্ষুধা বেড়ে যাচ্ছে। নরেশ ওপরের মাথার ওপরের সিটে তিন বাঁকা হয়ে শুয়ে আছে। টিকিট ছাড়া এর চাইতে ভালো স্থান আশা করাও পাপ। চেকারের চোখ ফাঁকি দিতে এর চাইতে উত্তম কিছু হতে পারে না।

নরেশ উপুড় হয়ে ট্রেনের জানালা দেখতে চেষ্টা করল। শুধু মাঝে মধ্যে জোনাকি পোকার মতো আলোর ঝলকানি। অন্ধকারে আর কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না। নিচে এক পাশটায় সিটগুলো দখল করে আছেন একটা শিখ পরিবার। মনে হচ্ছে ধনী পরিবার। নরেশের মাথায় ঢুকছে না উড়োজাহাজ ছেড়ে তারা কেন রেল যাত্রা বেছে নিলেন। স্বামী-স্ত্রী আর পাঁচ কী ছয় বছরের ছেলে। তিনজন যাত্রী অথচ দুই পাশের পুরোটাই তাদের দখলে।

শিখ ভদ্রলোকটি টেবিলের ওপর পত্রিকার কাগজ বিছানোতে ব্যস্ত। খুব সম্ভবত রাতের খাবারের আয়োজন চলছে। টেবিলের এক পাশে চারতলা টিফিন ক্যারিয়ার। তার স্ত্রী বাচ্চাটিকে ঘুম থেকে ওঠাতে চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে ট্রেনের কামরা খাবারের গন্ধে ভরে গেছে।

নরেশের ক্ষুধা এখন অসহনীয় পর্যায়ের। শেষ খাবার খেয়েছিল সেই সকাল নয়টার দিকে। এখন কয়টা বাজে। নয়টা কী দশটা। দুপুরে স্টেশনে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েই মনে হলো পকেটমার হয়েছে। পনেরো রুপি ছিল। সারা দিন শুধু তিনবার পানি খেয়েছে। ব্যস অতটুকুই।

পাঠানকোট যেতে এখনো কত সময় লাগবে তার নিশ্চয়তা নেই । সর্দারজি তার চারতলা টিফিন বক্স খুলে টেবিলে বিছানো কাগজের ওপর রাখলেন। পাশেই একটা টর্চ লাইট। সবাই খাচ্ছে। নরেশ অন্ধকারে তাদের খাওয়া উপভোগ করছে। একটা বক্সে পরোটা, একটাতে আচার, একটাতে সবজি, আর একটাতে হালুয়া জাতীয় কিছু হবে।

নরেশ একবার ভাবল হাত বাড়িয়ে বলবে, ওখান থেকে একটা পরোটা তাকে দিতে। হাত অর্ধেক উঠিয়েও আবার অন্য হাত দিয়ে ওঠানো হাত নিজের কাছে ফিরিয়ে নিল। সেটা নেহাতই ভিক্ষাবৃত্তি হয়ে যেত। জীবনের এতটা পথ সে একা এসেছে কিন্তু কখনো ভিক্ষা করতে হয়নি। কিন্তু ক্ষুধা বলে কথা। নরেশ নিজেকে প্রশ্ন করল ধনী মানুষ কী কখনো ভুখা থাকে। সে মনে করতে চেষ্টা করল জীবনে কী আদৌ ক্ষুধার্ত ধনী মানুষ দেখেছে কিনা। কিংবা সুন্দরী ক্ষুধার্ত নারী। নাহ, কখনো দেখেছে বলে মনে হয় না। না দেখলেই বা কী। তার কী এত বড় জীবন হয়েছে সে সবকিছুই পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকবে। তবে অনেক মানুষকে রাগতে দেখেছে। আবার অনেক সুন্দরী কিন্তু দুঃখী নারীরও দেখা পেয়েছে।

একবার পুরোনো দিল্লির রেলস্টেশনে নরেশ এক নামকরা নায়িকাকে কাঁদতে দেখেছিল। নায়িকা স্টেশনের এক কোণে বসে কাঁদছে আর আশপাশের মানুষ জড়ো হয়ে দেখছে। তা দেখে যতটা না সে অবাক হয়েছিল তার চেয়ে বেশি ব্যথিত হয়েছিল। এত সুন্দরী নায়িকা তো সিনেমায় কাঁদবে। বাস্তবে কেন? আজও তার জানতে ইচ্ছে করে কী তার দুঃখ ছিল।

সর্দার পরিবার দ্রুত খাওয়া শেষ করে টর্চ লাইট বন্ধ করে দিলেন। ট্রেনের কামরা আবার অন্ধকারে হারিয়ে গেল। ঝপাক ঝপাক শব্দে ট্রেন বিদ্যুৎবেগে ছুটে চলল।

ক্ষুধার তাড়ায় নরেশের ঘুম হারাম। কখনো তন্দ্রাচ্ছন্ন, কখনো বাস্তবে, কখনো ঘুমের ঘোরে এলোমেলো স্বপ্ন দেখে। তার বেশির ভাগই খাবার সম্পৃক্ত। সে শুনতে পেল সর্দারজির স্ত্রী তার স্বামীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলছেন, আপনার বন্ধুকে খেতে বললেন না?

: কী বলছ! কোন বন্ধু? কোথায়?

: ওই যে ওপরে বাঁকা হয়ে শুয়ে আছেন, উনি।

সর্দারজি মাথা ঘুরিয়ে যেই ওপরে তাকাবেন তখন নরেশের ঘুমঘুম ভাব কেটে গেল। সে আসলে স্বপ্ন দেখছিল।

নরেশ পাণ্ডের দৃষ্টি ঝুলিয়ে রাখা টিফিন বক্সের দিকে। হাতের খুব কাছাকাছি। একবার হাতও উঠল। ভাগ্যিস অন্ধকার বলে কেউ তা দেখতে পায়নি। জীবনে বেশির ভাগ না পাওয়া জিনিসগুলো খুব কাছাকাছি থাকে। হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যায় কিন্তু কখনো ভোগ করা যায় না। ছোট থাকতে সে প্রায়ই পুরোনো দিল্লি বড় বাজারে মিষ্টির দোকানে সামনে দিয়ে যেত। কোনো কারণ ছাড়াই। স্তূপ করে সাজানো মিষ্টিগুলো গুনতে চেষ্টা করত।

কাচের দেয়ালের ওপাশে মিষ্টির স্বর্গ আর অন্যপাশে সে। অথচ দূরত্ব বলতে এক ফুটেরও কম। কত ক্ষুধার্ত মানুষ রাস্তার অন্যপাশে থেকে দেখে হুপাশ করে অথচ ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ক্ষুধার্ত নরেশের সবকিছুই এখন খাবার সংক্রান্ত। সর্দারজি দু–একবার এপাশ-ওপাশ করে নাক ডাকতে লাগলেন।

নরেশ খুব সাবধানে হাত বাড়িয়ে টিফিন বক্সটি ওপরে তুলে নিল। প্রথম বাটিটি খুলে দেখল সেখানে কয়েকটা পরোটা। সে নিঃশব্দে একটা পরোটা খেয়ে নিল। কোমর থেকে গামছা বের করে বাটি মুছে বক্সটি আবার নিচেঝুলিয়ে রাখতে গেল। হঠাৎ নিজের বাহুতে শক্ত কিছু অনুভব করল। ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টাও করতে যাবে এমন সময় অন্ধকারে ফিসফিস করে সরদারজি বলে উঠলেন, তোমার পেট ভরে গেছে? আরও খাবার কি খাবে?

: খানা নেহি চাইয়ে।

: আমরা যখন খাবার খাচ্ছিলাম তখন তুমি শুয়ে শুয়ে দেখছিলে?

: জি, বাবু

: তখন খাবার চাইলে না কেন?

: ভয় হচ্ছিল, যদি খাবার না দিয়ে চেকারকে ডেকে ধরিয়ে দাও।

: এখনো তো দিতে পারি?

: তা পার। তবে তোমার খাবার খেয়ে প্রাণ ফিরে পেয়েছি।

: নাম কি তোমার? কোথা থেকে উঠেছ? গন্তব্য কোথায়? কী পরিচয়?

একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন সর্দারজির।

: বাবু, নরেশ পাণ্ডে। পুরোনো দিল্লি স্টেশন থেকে উঠেছি। যাব পাঠানকোট। আমার শৈশব পুরোনো দিল্লির সাঁই বাবার আশ্রমে। ওখানেই বড় হয়েছি।

: সাঁই বাবার আশ্রমে ছোট লালকে চিনতে?

: জি বাবু, ও তো কুখ্যাত পকেটমার ছিল। এখন জেলে।

: পরের বারের খাবারও কি চুরি করে খাবে?

: না বাবু, আমার পকেটে পনেরো রুপি ছিল। কিন্তু দিল্লি স্টেশনে পকেটমার হয়েছে। সত্যি বলছি ক্ষুধার যন্ত্রণায় আর পারছিলাম না।

: পাঠানকোটে তোমার কে আছে? কার কাছে যাবে?

: আমার জীবনে পরিবার বলতে কিছুই নেই বাবু। দিল্লির পুরোনো স্টেশনে চায়ের দোকানে ঝুটা কাজ করি। যাত্রীদের ফেলে দেওয়া চায়ের কাপ ধুয়ে বিক্রি করে সারা দিন রুপি যা পাই তা দিয়েই পেট চালাই।

: থাক কোথায়?

রাত হলে স্টেশনের কোথাও ঘুমিয়ে পড়ি। পাঠানকোট যাচ্ছি ঘুরতে। শুনেছি ওখানে ঝুটা কাজ পাওয়া যায়। ভাগ্য পরীক্ষা করাতে। দেখি কিছু করতে পারি কিনা। অন্ধকারে দুজনের আলোচনা খুব বেশি দূর পর্যন্ত গড়াল না। সর্দারজি কথা বলতে বলতেই নাক ডাকা শুরু করলেন। নরেশ পান্ডে অন্য পাশে মাথা ঘুরিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

তার ঘুম ভাঙল ট্রেনের কোলাহল আর ঝাঁকুনিতে। তাকিয়েই দেখে সর্দারজি আর তার পরিবার নেমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। জানালার বাইরে স্টেশনের সাইন। বড় করে হিন্দিতে লেখা জলন্ধর। ট্রেনের জানালায় পোকামাকড়ের ছোটাছুটি।

: আমি সুরজিৎ সিং। জলন্ধরের যাত্রী। এই সেই স্টেশন আর এখানেই নেমে যাব। এই দু শ রুপি আর আমার বিজনেস কার্ড রেখে দাও। তবে বুক পকেটে না রেখে তোমার প্যান্টের পকেটে রাখ। পাঠানকোট পর্যন্ত খাবার কিনে খাবে। বাকিটা রেখে দিয়ো। পরে কাজে লাগবে...।

নরেশ পাণ্ডেকে এতগুলো রুপি দেওয়াতে তার স্ত্রী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সর্দারজি হাত উঠিয়ে ইশারা করলেন। স্ত্রী বড়বড় চোখ করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন। কিন্তু কোনো বাক্য ব্যয় হলো না।

তোমার নাম কি? পুরোনো দিল্লিতে কোথায় গেলে তোমাকে পাওয়া যাবে? সরদারজির প্রশ্ন।

: জি, বাবু, নাম নরেশ পাণ্ডে। স্থায়ী কোনো ঠিকানা নাই। ভগবতী শুদ্ধ ভজনালয় নামের যে রেস্টুরেন্ট আছে সেখানকার বাবুর্চি বা হোটেল বয় কাউকে বললেই হবে। পথের মানুষ হলেও অনেকেই আমাকে চেনে। আমি তোমার এই টাকাটাও একদিন দিয়ে দেব। আমি দেনা হিসেবে নিলাম।

: টাকা তোমাকে দিতে হবে না। সর্দারজি ধমকের স্বরে বললেন।

সুরজিৎ সিং স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে ওখানে নেমে গেলেন। বিদায় নেবার আগে তিনি স্ত্রীকে দিয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগে কিছু পরোটা, সবজি আর হালুয়া নরেশকে দিয়ে গেলেন। নরেশ কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সরদারজির বড় দুটি ব্যাগ মাথায় নিয়ে ট্রেনের কামরা থেকে বাইরে দিয়ে এল। দূর থেকে সুরজিৎ সিংয়ের স্ত্রী একবার পেছন ফিরে নরেশকে দেখে নিলেন। তারা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই হুংকার তুলে মালয়া এক্সপ্রেস ছেড়ে গেল।

: বুঝলে স্মিতা, আমি জানি তুমি কী বলতে চাচ্ছিলে। আমি কেন অপরিচিত আগন্তুককে এতগুলো রুপি দিলাম। তাও আবার রুটি চোরকে...।

: আমি আসলে।

সর্দারজি আবারও হাত ওঠালেন। এত বছর ঘর করার পর স্মিতা বেশ ভালো করেই জানেন স্বামীর হাত ওঠানোর মানে হচ্ছে তার কথা শেষ হয়নি। তিনি জানেন স্বামী গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা বলবেন। দুজনের দূরত্ব ঘোচাতে স্মিতা তার স্বামীর আরও কাছে এসে দাঁড়ালেন।

: আজ থেকে আটচল্লিশ বছর আগে আমি আর এই নরেশ পুরোনো দিল্লির সাঁই বাবার আশ্রমে বড় হয়েছি। ভাগ্যের কী পরিহাস। গত রাতে ট্রেনের ভেতর ও তোমার হাতে বানানো একটা পরোটা চুরি করে খেয়েছে। অথচ আশ্রমে থাকতে আমি অনেকবার ওর খাবারে ভাগ বসিয়েছি। কখনো কিছু বলেনি। ও আমাকে চিনতে পারেনি। কিন্তু আমি ঠিকই চিনেছি। সৃষ্টিকর্তা আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছেন কিন্তু ওর জন্য স্রষ্টার আশীর্বাদ আরও বেশি প্রয়োজন। ও এখনো অনাথ। ওর জন্য আমার একটা কিছু করতেই হবে।

পাথরসম স্বামীর চোখে স্মিতা এই প্রথম অশ্রুধারা দেখতে পেলেন। তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল বসে থাকা এক বৃদ্ধ ঋষির দিকে। গানের সুরে সুরে ভিক্ষা করছেন আর গাইছেন:

‘জিন্দেগি পেয়ার ক্য গীত হ্যায়
ইসে হার দিলকো গানা পারেগা।’

জীবন মানে শুধুই ভালোবাসার গান গাওয়া আহা! সব হৃদয়েই এই গান বেজে উঠুক জীবন তো দুঃখেরও এক মহাসাগর, হাসতে হাসতে পার হতে হয়। কোনোও কারণ ছাড়াই স্মিতার মন ভরে গেল। আহা, কী অপূর্ব মায়াবীয় এই পৃথিবী। অনেক বেশি দুঃখ, অল্প একটু সুখ, অল্প একটু পাওয়া আর অনেক বেশি না পাওয়ার জীবন। কত কত নতুন মানুষ বা মুহূর্তগুলো এসে পুরোনো সহস্র স্মৃতিকে বদলে দিয়ে চলে যায়। চলে যাক, যাক না। ক্ষতি কী!

রেল স্টেশনে হাঁটতে হাঁটতে তিন সদস্যের সর্দার পরিবার একটা ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। (চলবে)

জামাল সৈয়দ: মিনেসোটা, যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <facebook.com/Jamal.MN>