নীল আকাশের নিচে

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

সকাল থেকে রাত অবধি কী বৈচিত্র্যময় আকাশ রে বাবা! মাথার ওপর একটা চোখ থাকলে ভালো হতো। কত আর ঘাড় বেঁকিয়ে দেখা যায়! ক্যালগেরির আকাশ এত গাঢ় নীল। বাংলাদেশে ঢাকার আকাশ মাঝে মাঝে এমন নীল হতো। বেশির ভাগ সময়ই থাকত আকাশি নীল রং। আর কালো ধোঁয়ায় ঢেকে থাকলে তো আকাশ দেখাই যেত না।

আহির গর্জে ওঠে, তোমার সবকিছুতে বাংলাদেশকে টানতেই হবে! আকাশ দেখছ দেখো, এখানে আবার বাংলাদেশ কেন?

: আমার অস্তিত্বের সবটাতে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। তাই সারাক্ষণই তা চলে আসে, আমি বাদ দিতে পারি না। তোমার সমস্যা কী, তুমি কখনো দেখেছ ভালো করে তাকিয়ে? অভিমানী গলায় স্বাতী প্রশ্ন করে।

: আর তুমি বুঝি খুব দেখ, তুমি তো ঘর থেকে বেরই হও না। যদিও বা বের হও তো মাথা মুখ এমন করে পেঁচিয়ে নাও, চোখের সাধ্য কী কিছু দেখে! গরমের দিনেও তোমার মাথায় হুডি চাই।

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

: ঝগড়া বাদ দাও তো, আকাশ দেখ। যেমন পরিষ্কার নীল আকাশ, তেমনই দেখ, সবুজে ঘেরা রাস্তাগুলোও কী পরিষ্কার করে রেখেছে লোকজন। আমি অবাক হয়ে যাই, এই যে প্রতিটি মানুষ চেষ্টা করছে সবকিছুর যত্ন করতে, সেই একই মানুষ বাংলাদেশে কেন এত অযত্ন, অবহেলা করে। অথচ এখানে প্রকৃতি কত বৈরী, কতই না কঠিন সবকিছু ঠিকঠাকভাবে করে চলা। মাইনাস চল্লিশ তাপমাত্রাতেও জায়গা মতো ময়লাগুলো রেখে আসতে কিন্তু ঠিকই যাই। আর দেশে রান্নাঘরের জানালা বা বারান্দা দিয়ে পেছনের ঝিলে ময়লা ফেলে দিতে কারওরই বাঁধে না। দিনে দিনে জমে ওঠে বিশাল স্তূপ। হাতির ঝিলের একটা এক্সটেনশন ছিল আমাদের বাড়ির পেছন দিকে। আশপাশের বাড়িগুলো থেকে ময়লা ফেলে ওটার পাড় বোঝাই হয়ে যেত। বড় ভাই আর তার বন্ধুরা মিলে লোক নিয়ে বছরে একবার পরিষ্কার করতেন। ধরে রাখা যেত না কিছুতেই, আবার সেই ময়লা বোঝাই।

: আইন, আইনের প্রয়োগ। ঠ্যালার নাম বাবাজি! বুঝলে, আহির ব্যঙ্গ করে। তা ছাড়া আমাদের গরিব দেশ, জনসংখ্যা এত বেশি। সবকিছু মিলিয়ে আমরা পেরে উঠি না।

: সেটাই তো আমার চিন্তায় ঘুরপাক খায়। সমস্যাটা কোথায়? আইন, আইনের প্রয়োগ, অর্থনৈতিক নাকি সঠিক শিক্ষার অভাব! একটা বিষয় মনে হয়, এখানে রুক্ষ প্রকৃতিতে কঠোর পরিশ্রম করে মাত্র দুই মাস মানুষ ফসল তুলতে পারে ঘরে। বাকিটা সময় বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে যুঝে যুঝে সবকিছু করে চলা। তাই কী মানুষ সময় আর পরিশ্রমের মূল্য দিতে শেখে! চেষ্টা করতে থাকে নব নব আবিষ্কারের, রক্ষা করতে চায় প্রকৃতিকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর মধ্যেও দেখি কী চমৎকার সচেতনতা। তাদের কোনো একটা খারাপ কাজের ফলাফল অন্যের ক্ষতি করবে ভেতর থেকে তা তারা মানতেই পারে না। এই যে ময়লা ফেলার নতুন নিয়ম হয়েছে, তিনটা আলাদা আলাদা বিন। ঘরে-বাইরে এসব নিয়ম রক্ষা করতে অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন। ঠিকই স্কুলে স্কুলে বাচ্চাগুলোকে শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কেন এই ব্যবস্থা। কোনটা কোন বিনে যাবে। গার্বেজ জমা করার ল্যন্ডফিলগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তাই গার্বেজ আর পচনশীল জিনিসগুলো আলাদা করে ফেললে দুভাবে উপকৃত হই আমরা ও ভবিষ্যৎ নাগরিক—তাই এ ব্যবস্থা। এখনো কত দেরি, অথচ কত বছর আগে থেকেই উদ্যোগ নিয়েছে। পচনশীল জিনিসগুলো থেকে সার বানিয়ে চাষাবাদের কাজে লাগাবে আর ল্যান্ডফিলও আর একটু দেরিতে ভরাট হবে। তত দিনে নতুন ল্যান্ডফিল কীভাবে কোথায় বানানো যায় চিন্তা করা যাবে।

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

আমাদের বাড়ির পেছনের যে ঝিলের কথা বললাম না একটু আগে, তার কী হয়েছে জানো, বুঁজে ফেলা হয়েছে। কী নাকি এক রাস্তা হবে! স্বাতীর কণ্ঠে হতাশা। আর এখানে কোনো রকম ডোবা থাকলেও তা ঠিক রেখে তবেই অন্য কাজ, ছোট্ট এক টুকরো জলাধারও কেউ নষ্ট করতে পারবে না, কঠিন আইন!

দুঃখ হয়! আমার কী মনে হয় জানো, এরা ছোটবেলা থেকেই অন্যকে সম্মান করতে শেখে, মানুষকে, প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শেখে—পরিবার ও স্কুল থেকে। দায়িত্ব নিতে শেখে, পরিশ্রম করতে শেখে, তাই সত্যিকার অর্থেই পরিশ্রমের গুরুত্ব বোঝে। আমাদের দেশে ঠেকায় না পড়লে ছোট বাচ্চাদের কোনোরকম দায়িত্ব নিতে শেখানো হয় না।

: এত মন খারাপ কর না, স্বাতীকে কাছে টেনে নেয় আহির। বাংলাদেশেও এখন অনেকে অনেক কাজ করছে, ধীরে ধীরে এগোতে হয়। আমিতো শুনলাম রিসাইক্লিং নিয়ে দারুণ কাজ হচ্ছে। আমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের কাজটুকু যদি দায়িত্ব নিয়ে করি, অন্যরা অনুপ্রাণিত হবে। সবুজে ঘেরা বাংলাদেশের রাস্তাও একদিন এমন পরিচ্ছন্ন থাকবে, নীল আকাশ থাকবে কালো ধোঁয়ামুক্ত।
...

আফরিন জাহান হাসি, ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা