জানিস আমি কে?

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। মনে আছে নিশ্চয়ই আপনাদের সবার। একজন নারী ভুল জায়গায় গাড়ি পার্ক করেও কর্তব্যরত পুলিশের সঙ্গে অন্যায়ভাবে তর্ক করে যাচ্ছে। তার তর্ক-বিতর্কের মূল যুক্তিই ছিল তিনি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী পরিবারের মেয়ে। তাই তার সাত খুন মাফ। পুলিশের কত বড় সাহস যে, তাকে আইন দেখায়, আইন মানতে বলে। সেই দুই পয়সার পুলিশ কি জানে তিনি কে? অর্থাৎ তিনি কত ক্ষমতাবান। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে আজ এ সব ভিডিও মানুষ দেখতে পাচ্ছেন। ঘৃণা জানাচ্ছেন। জনগণের তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদের কারণে বাধ্য হয়ে দু-একটি ঘটনার বিচারও হচ্ছে। এটাই আশার কথা। কিন্তু আমরা অনেকেই কি কম বেশি এসব আচরণ বা ঘটনার সঙ্গে পরিচিত না? আমাদের যার যতটুকু ক্ষমতাই আছে অনবরত সেই ক্ষমতা দেখিয়ে আমরা কি দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছি না? আইনের শাসনকে ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছি না? আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা ছিল প্রতিদিন ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার একটি।

আরেকটি ভাইরাল ফেসবুক ভিডিওর কথা ভাবলে আমি শিউরে উঠি। একজন এমপি মহোদয় গিয়েছেন এক মেয়েদের স্কুলে। এমপিসহ গণ্যমান্য অতিথিরা বসে আছেন এক সারি চেয়ারে। তাদের সামনে পূজা দেওয়ার মতো করে সেই স্কুলের ছাত্রীরা মালা হাতে সারি বেঁধে আসছে। একের পর এক অতিথিদের সামনে যাচ্ছে। হাঁটু গেঁড়ে বসছে। মাথা নোয়াচ্ছে। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। চোখে না দেখলে কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না। কেউ যদি বলে না দেন, তাহলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে মাথায় স্কার্ফ পরা এই মেয়েগুলো ওই চেয়ারে বসা লোকগুলোকে পূজা করছে। সেই সঙ্গে গান হচ্ছে ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’ আসলেই তো এমন দেশ বিরল, যেখানে ক্ষমতাশালীদের দুর্বলেরা আক্ষরিকভাবে পূজা করে। মাথায় যেহেতু স্কার্ফ আছে, ধরে নেওয়া যায় এই মেয়েগুলো মুসলিম, যে ধর্মে আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে মাথা নোয়ানো নিষেধ। তাদের এই কাজে বাধ্য করার অধিকার স্কুলকে দিল কে? এই কাজের মাধ্যমে এই শিশু বয়সেই মেয়েগুলোর মনে কী পরিমাণ হীনমন্যতা তৈরি হয়, সেটা ভাবলেই আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়।

সম্প্রতি জানতে পেরেছি, সৌদি আরবে নাকি নিয়ম আছে, রাজ বংশের কেউ যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটান, তার কোনো বিচার হবে না। এমনকি তার দোষে যদি কেউ প্রাণও হারান তবুও তার কোনো শাস্তি হবে না। এটা সে দেশের আইন। আমার জানা মতে আমাদের দেশে এ রকম কোনো লিখিত আইন নেই। কিন্তু অলিখিত অবস্থাতো সৌদি আরবের রাজপরিবারের চেয়ে খুব একটা ভিন্ন নয়। বরং ওখানে এই সুবিধা পায় শুধু রাজ পরিবার। আর আমাদের দেশে ক্ষমতাবান অনেকে।

আমাদের দেশে ক্ষমতাশালীদের ছায়ায় থেকে ধর্ষণ, খুন, জবরদখল আর ছোট বড় কত অন্যায় করে যুগের পর যুগ অনেকে পার পেয়ে গেছেন। লেখার শুরুতে যে ভিডিওটির কথা বললাম, সেটায় অনুপ্রাণিত হয়ে আরেক পুলিশ আবার কিছুদিন আগে ভিডিও করেছেন রাত্রিবেলায় তল্লাশি করা এক নারী যাত্রীর। তারও হয়তো মনে আশা ছিল এই ভিডিওর সূত্র ধরে তিনিও হয়ে যাবেন জনপ্রিয়। কিন্তু তার হিসাবে একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল। পুলিশ হলেও তিনি কিন্তু আইনের বাইরে না। তারও দায়িত্ব আছে জনগণের সঙ্গে আইনের মধ্যে থেকে ভদ্রভাবে ব্যবহার করার। তিনি নিজেকে অতিরিক্ত ক্ষমতাবান ভেবে যেসব ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা অত্যন্ত আপত্তিকর ও আইন লঙ্ঘনকারী। হাস্যকর হলো, একপর্যায়ে তিনি যাত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছেন, 'বলেন আপনার কে আছে, আপনি কে?’ এ সব কথা ‘জানিস আমি কে?’ ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহারকেই প্ররোচিত করে।

বাংলাদেশের অনেক নাগরিকই হয়তো জীবনে কখনো না কখনো এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা নেতাদের কথামতো কাজ না করায় বদলি করে দেওয়া হয়েছে সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা বা স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের। টেন্ডার হাতছাড়া হয়ে চলে যায় কত ক্ষমতাশালীদের হাতে। ভালো স্কুল-কলেজে যেখানে আসন খুব সীমিত, সেখানেও হয়তোবা দেখা যায় অনেক কম মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের নেওয়া হয় সেই ক্ষমতারই অপব্যবহার করে। আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের চাকরি নিয়ে যখন হাজার হাজার বেকার যুবকের প্রতিযোগিতা, তখন কী হয়? বচনই হয়ে গেছে মামা-চাচার জোর ছাড়া চাকরি পাওয়া কঠিন। ক্ষমতাশালী কর্তৃক অন্যায়ভাবে জমি দখল, ভিটা বাড়ি থেকে উচ্ছেদ এগুলো ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা নয়। নতুন বাড়ি করতে গেলে মাস্তানদের চাঁদা দেওয়ার ভয় সবারই থাকে। দোকান বা ব্যবসা থেকে চাঁদার নামে বখরা দিয়েও অনেকে চুপচাপ থাকেন প্রাণভয়ে। পরিবারের উঠতি বয়সী সুন্দরী মেয়ের ওপরে যদি নজর পড়ে এলাকার কোনো ক্ষমতাশালীর ছেলে বা তার ছত্রচ্ছায়ায় থাকা মাস্তানের, তাহলে মেয়েটির জীবন সেখানেই শেষ। হেনস্তা, ধর্ষণ, কপাল ভালো থাকলে জোর করে বিয়ে কোনো কিছুই বিচিত্র নয়। আর এই সব কিছুর পরেও তাদের আসতে যেতে সালাম দিতে হবে, সমস্ত অন্যায় মেনে নিয়ে মুখ বুঁজে থাকতে হবে। কারণ তারা প্রথমেই জানিয়ে দেবে তারা কে, কতখানি ক্ষমতাশালী।