উত্তর আমেরিকায় নজরুল সম্মেলন

ওয়াশিংটন ডিসিতে ১৭তম নজরুল সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন খিলখিল কাজী
ওয়াশিংটন ডিসিতে ১৭তম নজরুল সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন খিলখিল কাজী

কাজী নজরুল ইসলামের ওপর সম্মেলনে যোগ দিতে এ নিয়ে আমার দ্বিতীয়বার আমেরিকাতে যাওয়ার সুযোগ হলো। প্রথমবার শুধু ক্যালিফোর্নিয়া গিয়েছিলাম, আরেকটা নজরুল সম্মেলনে বহু বছর আগে। তবে এবার আমেরিকার পূর্বদিকে আসার প্রথম সুযোগ হলো ওয়াশিংটন ডিসিতে ১৭তম নজরুল সম্মেলনে যোগ দিতে। দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলন গত ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়।

নজরুল প্রেমিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক কবির কিরণ আমাকে ও নজরুল শিল্পী সালাহউদ্দিন আহমেদকে আমন্ত্রণ জানান উত্তর আমেরিকা নজরুল কনফারেন্স কমিটি এবং এবারের ওয়াশিংটন ডিসির যৌথ আয়োজক ‘ধ্রুপদ’ সাংস্কৃতিক দল ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকার আহ্বায়কদের পক্ষ থেকে। অতি অল্প সময়েই আমরা তৈরি হয়ে গেলাম আমেরিকাতে কাজী নজরুল ইসলামের ওপর যারা কাজ করছেন তাদের সঙ্গে যোগ দিতে।

১৭তম নজরুল সম্মেলন ছিল একটি অনন্য অনুষ্ঠান। এই বিশাল আয়োজনের মান উঁচু রাখার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন ধ্রুপদের হিরণ চৌধুরী। তিনি অত্যন্ত গুণী ও উৎসাহী মানুষদের সহায়তায় সাফল্যের সঙ্গে উপহার দিতে পেরেছেন একটি আন্তর্জাতিকমানের সম্মেলন। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকার সদস্যরা শাফি আহমেদ কাজলের নেতৃত্বে আর্থিক, সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন সাংগঠনিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। উত্তর আমেরিকা নজরুল কনফারেন্স কমিটির চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতার মাধ্যমে তার কমিটির সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দেন।

উল্লেখ, গত ২৮ বছর ধরে বিভিন্ন শহরে কাজী নজরুল ইসলামের ওপরে সম্মেলন করে তারা এখানে নজরুল চর্চাকে উৎসাহিত ও বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের রোকেয়া হায়দার, ইকবাল বাহার চৌধুরী ও মাসুমা খাতুনসহ এই সংগঠনের অনেকের উপস্থিতি ও সহযোগিতা ছিল আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বিশেষ করে ভয়েস অব আমেরিকার আনিস আহমেদের কর্মতৎপরতায় অনুষ্ঠিত নজরুল সেমিনার ছিল অসাধারণ। বাংলাদেশি নজরুল গবেষক, লেখক, চট্টগ্রামের হাবিবুল্লাহ বাহার ও শেরওয়ানি পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগের ওপর ভিত্তি করে অনেক অজানা তথ্য সমন্বয়ে সেমিনারটি ছিল অত্যন্ত উপভোগ্য। আমেরিকান নজরুল গবেষক, লেখক ও বোস্টন শহরের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসের সাবেক উপাচার্য ড. উইনস্টন ল্যাংলি ও নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রেচেল মাকদেরমটের প্রতিবেদন ছিল অনবদ্য। পশ্চিমা দেশের অবাঙালি মানুষের নজরুলকে জানার ও সম্মানের স্থানে বসানোর এই প্রচেষ্টা আমাকে মুগ্ধ করেছে। ড. গুলশন আরা কাজী তার গবেষণায় দেখিয়েছেন নজরুলের লেখনি থেকে কীভাবে জাতিসংঘের মানবতার মেনিফেস্টো তৈরি হয়েছে। অধ্যাপক মুস্তাফা মুনির ও অধ্যাপক শেলি সাহাবুদ্দিন ইংরেজিতে নজরুলের মানবাধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা ও মূল্যবোধের ওপর আলোচনা করেছেন। সকলেই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কাজী নজরুল ইসলামের অসাধারণ সৃষ্টিসমূহ নিয়ে প্রাসঙ্গিকতার ওপর আলোকপাত করেন।

দুই দিনব্যাপী সম্মেলনে প্রধান মঞ্চে সংগীত, আবৃত্তি, নাটক ও নৃত্য পরিবেশন করেন আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে আগত শিল্পী এবং বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক গুণী শিল্পীরা। তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ থেকে ফাতেমা তুজ জোহরা, নাশিদ কামাল, মেহের আফরোজ শাওন, সালাহউদ্দীন আহমেদ এবং নৃত্যশিল্পী ওয়ার্দা রিহাব ও তার দল। ভারত থেকে ছিলেন ওস্তাদ তুষার দত্ত, রিদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, জগন্নাথ রায়, বিপ্রদাস দত্ত, রিনি বিশ্বাস ও বিদিশা রায় দাস প্রমুখ। আমেরিকা থেকে অনেকের মধ্যে ছিলেন শিল্পী সামিয়া মাহবুব ও শর্মিষ্ঠা ব্যানার্জী। আবৃত্তিতে ইকবাল বাহার চৌধুরী, এ কে এম খায়রুজামান, আনিস আহমেদ, কামাল মুস্তাফা, ডরোথি বোস, অদিতি সাবিহা রহমান, সিলিকা কণা, ফকির সেলিম, সাবরিনা চৌধুরীসহ অন্যরা। এ ছাড়া ছিল আলোচনা ও জীবন নিয়ে ডকুমেন্টারি (ডা. জিয়াউদ্দীন)।

কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে বারবার বিভিন্নভাবে উপস্থাপন ও সম্মান দেখানো হয়। উপস্থিত অগণিত নজরুল প্রেমিকের ভালোবাসা ও আগ্রহে নজরুল যেন জ্বলে ওঠেন সুদূর উত্তর আমেরিকার এই অনুষ্ঠানে। উত্তর আমেরিকা নজরুল কনফারেন্স কমিটির সভায় এই অনুষ্ঠানের সফলতার জন্য দুই স্বাগতিক সংগঠনকে ধন্যবাদ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শহরে নজরুলের ওপর অনুষ্ঠান বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়া নজরুলের সৃষ্টিকে ইংরেজি ভাষায় আমেরিকান কবি দিয়ে অনুবাদ করার গুরুত্ব আরোপ, ভবিষ্যতের অনুষ্ঠানে সেমিনারে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমকে আরও বেশি প্রাধান্য দিয়ে অবাঙালি ও নতুন প্রজন্মদের কাছে নজরুলকে পরিচিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। আলোচনা হয় বাংলাদেশ ও ভারতের নজরুল সংস্থার সঙ্গে একযোগে কাজ করার বিষয় নিয়ে। উত্তর আমেরিকাতে যারাই নজরুলের ওপর কাজ করছেন তাদেরকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদানেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

ওয়াশিংটন ও এর আশপাশে বাংলাদেশিদের ভালোবাসায় আমরাও মুগ্ধ হলাম। সংগীত শিল্পী ডা. শাহনাজ রহমান সুমি ও তার স্বামী প্রকৌশলী রবিনের গৃহের আতিথেয়তায় ও সম্মানে আপ্লুত ছিলাম। পরে পেনসিলভানিয়া স্টেটের ফিলাডেলফিয়া শহরে আমাকে নিয়ে এক নজরুল সন্ধ্যার আয়োজন করেন নজরুল কনফারেন্স কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও নজরুল গবেষক ডা. জিয়াউদ্দীন আহমেদ। সমাবেশে গুণী ও জ্ঞানী মানুষেরা কাজী নজরুলকে নিয়ে আলোচনা, সংগীত ও আবৃত্তির মাধ্যমে নজরুলের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। তারাও নজরুলের সৃষ্টিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার প্রয়াস এবং প্রজন্ম ও বিশ্ববাসীর জন্য সেমিনারে ইংরেজি বেশি ব্যবহারের গুরুত্ব আরোপ করেন।

নিউইয়র্কে নজরুল একাডেমির সভাপতি সৈয়দ টিপু সুলতান ও তার দল আমাকে এক নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করে সেখানে নজরুলকে নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা করেন। তাদের নজরুলের ওপর বিভিন্ন প্রচারমূলক অনুষ্ঠান ও কর্মকাণ্ডের কথা সত্যি অনেক আশার সঞ্চার করেছে। ৭ অক্টোবর নিউইয়র্কে কবির কিরণ তার সংগঠন ‘শতদল’–এর পক্ষ থেকে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। উত্তর আমেরিকা নজরুল কনফারেন্স কমিটি এতে অংশগ্রহণ করে। আয়োজনে ছিল শিশু–কিশোরদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গুণীজনের নজরুল সেমিনার ও স্থানীয় বিভিন্ন শিল্পীর পরিবেশনা। অনুষ্ঠানে আমি কাজী নজরুলের পরিচিতি ও তার মূল্যবোধকে ধারণ করার জন্য আমার নিজস্ব উদ্যোগের ওপর আলোচনা করি এবং নজরুল সংগীতও পরিবেশন করি। নজরুলপ্রেমী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস ও অনুপ্রেরণা আমাকে অভিভূত করে। পরিশেষে শিল্পী সালাহউদ্দিন আহমেদের অনবদ্য পরিবেশন অনুষ্ঠানকে আরও মনোরম করে তোলে।

এক নজরুলপ্রেমী কবির কিরণ ও তার স্ত্রী ছন্দা ভাবি বেশির ভাগ সময় তাদের গৃহে আতিথেয়তার মাধ্যমে আমাদের সম্মান দেখিয়েছেন। আলাদাভাবে শিল্পী সালাহউদ্দিন আহমেদ ওয়াশিংটনের ব্যবসায়ী ও সাংস্কৃতিক সহায়ক আনিস খানের ঘরোয়া আয়োজনসহ ফ্লোরিডাতে সংগীত পরিবেশন করেন।

উত্তর আমেরিকাতে আমাদের এবারের সফর কাজী নজরুল ইসলামের অসাধারণ সৃষ্টি এবং বিশ্বমানবতা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচার ও প্রসারিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। অবাক লাগে উত্তর আমেরিকা নজরুল কনফারেন্স কমিটি ২৮ বছর ধরে সম্মেলনের মাধ্যমে নজরুল প্রচারে উৎসাহ জাগাচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ড. গুলশন আরা কাজী ও তার স্বামী কাজী বেলালের বহু বছরের সাধনায় বেশ কয়েক বছর থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার স্টেট কলেজে নজরুলের বক্তৃতামালা প্রচলন হয়েছে। তারা এখন ইউনিভার্সিটি অব কানেকটিকাটে ‘নজরুল চেয়ার’ বা কাজী নজরুলের ওপর বিদেশিদের পড়াশোনা করার দ্বার উন্মোচন করতে চলেছেন। তা ছাড়া তারা নিয়মিতভাবে আমেরিকার নতুন সব নজরুল গবেষক ও বাংলাদেশ নজরুল ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তাদের সঙ্গে ড. সাজেদ কামালের নজরুল অনুবাদ অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে। আমেরিকাতে নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন শহরে বহু উৎসাহী সাংস্কৃতিক কর্মী ও তাদের সংগঠনের ভালোবাসার জন্য কাজী নজরুল ইসলামের সংগীত, কবিতা ও তার বক্তব্যে মানবতার জয়গান এবং অসাম্প্রদায়িকতার বাণী আজকে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করছে। অবাক হয়ে দেখেছি কীভাবে এ দেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠার পরও কিছু প্রজন্ম কী চমৎকার নজরুল সংগীত পরিবেশন করছে। আমার বিশ্বাস এই নজরুল জাগরণ আমার দাদু কাজী নজরুল ইসলামের বিশ্বমানবতার বাণী, সংগীত ও কবিতার অনুরণন উজ্জীবিত করবে বিশ্বের ঘুমিয়ে থাকা অনেক মানুষকে।
...

খিলখিল কাজী: লেখক, গবেষক ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের পৌত্রী।