যাক অবসাদ বিষাদ কালো, জ্বালাও আলো!

দীপাবলিতে আলোর উৎসব
দীপাবলিতে আলোর উৎসব

ছোটবেলায় জানতাম কালীপূজা। একটু বড় হয়ে জানলাম, কালীপূজার সন্ধ্যায় যে আলোর উৎসব তাই দীপাবলি। যার অর্থ প্রদীপের সমষ্টি। অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে শুভ শক্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার উৎসব।

দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।
যাক অবসাদ বিষাদ কালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো-
জ্বালাও আলো, আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে।।

দুর্গাপূজার উচ্ছ্বাস মিলিয়ে যাওয়ার আগেই দীপাবলি আসে। ভাসানের বিয়োগ বিধুর চেতনার আবিষ্ট মন, দীপাবলিতে আত্মাকে আলোকিত করে।

কানাডীয়রা যখন অল সোলস ডে যাপিত করছে মানে হ্যালোউন ডে, তখন বাংলার আকাশে আকাশপ্রদীপ জ্বালিয়ে, পিতৃপক্ষে মর্ত্যে নেমে আসা পূর্বপুরুষদের স্বর্গে ফিরে যাওয়ার রাস্তা দেখানো হয়। বিশ্বাস করা হয়, ত্রেতা যুগে শ্রী রামচন্দ্র, রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ জয় করে চৌদ্দ বছর বনবাস শেষে অযোধ্যায় ফিরলে প্রজারা প্রদীপ জ্বালিয়ে শব্দ বাজী করে তাঁকে অভ্যর্থনা জানায়।

কালীপূজায় ভক্তরা
কালীপূজায় ভক্তরা

ওই দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক নরাকাসুর বধের স্মারক হিসেবে একে নরক চতুর্দশীও বলা হয়ে থাকে এবং ভক্তরা আলোর উৎসব পালন করেন। বুদ্ধদেবের গৃহত্যাগ স্মরণে বৌদ্ধরা আলোক উৎসব করেন। জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর ৫২৭ অব্দে এই দিনে মোক্ষ লাভ করেন। এই দিনে সম্রাট জাহাঙ্গীরকে পরাজিত করে শিখ ধর্মগুরু হর গোবিন্দজি; গোয়ালিয়র দুর্গ থেকে বাহান্ন হিন্দু রাজাকে মুক্ত করে অমৃতসর ফিরে আসেন। তাই শিখরা একে বন্দী ছোড় দিবস হিসেবে পালন করেন।

বাংলাদেশে কার্তিকি অমাবস্যায় কালীপূজা এবং কোনো কোনো স্থানে লক্ষ্মী পূজাও হয়ে থাকে। এই উপলক্ষে অলক্ষ্মীকে বিদায় জানাতে এবং লক্ষ্মী বরণ করে নিতে দীপ জ্বালানো হয়। এই হলো বাঙালির কালীপূজা ও দীপাবলি, যা এখন স্টার প্রজন্মের কাছে দিওয়ালি। দেশে-দেশে অঞ্চল ভেদে ভিন্ন নামে ও ভিন্ন বিশ্বাসে পালিত হয়।

টরন্টোতে হিমের রাতে দীপাবলির ডাক এসেছে; প্রতি বছর যেমন আসে ব্যস্ততার অবকাশে। অবশ্য জবা (এ দেশের হাইবিস্কাস), মাটির প্রদীপ, পান্না লাল আর ধনঞ্জয়ের রাম প্রসাদী নিয়ে উৎসাহ খুব একটা চোখে পড়ে না। পূজা মানেই একটা ভারতীয় ফ্লেভার চাই। যে মন্দিরে যত নাম-ডাকওয়ালা শিল্পী সেই মন্দিরে ভিড় তত বেশি। যা হোক, সারা বছরের মালিন্য আলোকের রোশনাইয়ে ঝলসে ওঠে। এটাই একমাত্র পার্বণ যখন রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলো বাড়ে। ভোলা নাথের প্রসাদে নেচে ওঠে মর্ত্যের মানুষ। নিশিরাতে স্নাত ভক্তরা মেতে ওঠেন কালো মেয়ের স্তবে কী দেশে কী বিদেশে।

যে বৌদি আমার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে উপদেশ দিয়েছিলেন ডেলিভারির কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে বেশি করে কমলার জুস খেতে, যাতে বাচ্চার গায়ের রং কমলা বর্ণ হয়; তিনিও নিমজ্জিত এই রাতে কালো মেয়ের আরাধনায়।

কালীপূজায় ভক্তরা
কালীপূজায় ভক্তরা

‘আমার সর্ব অঙ্গে লিখে দে মা কালী-কালী নাম।’ তবে ছেলের বউ খুঁজতে দুধে আলতা রং চাই!

মাতৃপক্ষ থেকে কার্তিকি অমাবস্যা মাতৃ আরাধনা করব কিন্তু সংসারে মেয়ে চাই না; পুত্রং দেহী! সংসারে মেয়ে থাকলেই যত ঝামেলা দুবেলা ভাত দাও, কাপড় দাও, বিয়ের জোগাড় কর, শ্রীধর, মিজান, হারানদের কবল থেকে বাঁচাও সুতরাং পুত্রং দেহী।

এই রাতে নির্বসনা মেয়েকে দেখে কামনা জাগে না; ভক্তিতে মাথা ঠেকে কালো মেয়ের পায়ের আলোর নিচে।

কিন্তু পুজো দেখতে বেরিয়ে, কৃষ্ণকলি, বাহির পানে হানি যুগল ভুরু, ভয়ে কাঁপে তাঁর বুক দুরুদুরু; মিজান শ্রীধর হারানরা নেয়যে পিছু-পিছু। এভাবে পুজো দেখতে যখন শহরে-গ্রামে যৌন হয়রানির শিকার হয় মেয়েরা; তখন কৃষ্ণকলিদের বসন নিয়ে হয় ময়নাতদন্ত। নিশিরাতে শক্তির বর মেগে বলীয়ান ভক্তকুল, ধরিত্রীর এই নরকাসুরদের বিরুদ্ধে নির্বিকার। যেচে কী দরকার, জড়াতে ঝামেলায়? তার চেয়ে মন তুই পড়ে থাক শ্যামা মায়ের পায়ের জবায়।

ঈশ্বরের সৃষ্টি প্রেম আর আমাদের সৃষ্টি ঠকানো। আমরা যা জানি তার কতটুকু মানি? সবাই তা কম বেশি বুঝি। ভক্ত আর ভক্তির স্বআরোপিত দ্বিচারিতায়, ‘ছিন্নমস্তা চণ্ডী, রণদা সর্বনাশী জাহান্নামের আগুনে পুড়িয়া হাসে পুষ্পের হাসি’।

তবু প্রতি বছর কল্যাণীয়া দীপাবলি আসে মাতৃগর্ভের মতো। আমার হৃদয়ের প্রদীপখানি স্মৃতিকে রাস্তা দেখায় সেই পুকুর পাড়ে যেখানে নারকেলের খোল কিংবা কলা গাছের খোলে প্রদীপ ভাসানোতে মেতে উঠতাম। তুলসী মঞ্চের সামনে চোদ্দটি মাটির প্রদীপে, তেলে সলতে চুবিয়ে প্রজ্বলন করতেন মা কিংবা বড় বৌদি-মেজ বৌদি। স্থির আলোয় স্বর্গের রাস্তা দেখাত পূর্বপুরুষদের।

মণ্ডপ
মণ্ডপ

জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্য নির্ধারিত বাঁশটিকে ব্যবহার করা হতো দোকানের সামনে; সমান্তরাল বেঁধে সারিবদ্ধভাবে জ্বালানো হতো মোমবাতি। চারপাশ জুড়ে পেত চার্চের স্নিগ্ধতা।

নিশির ছমছমে শ্মশানে পূজিত হতেন কালী রক্ত জবায়; তখনো জেগে থাকতেন পান্না লাল-ধনঞ্জয়। ছিন্ন মুণ্ডুর মালা পরিহিতা শ্যামার দিঘল কালো কেশ, জিহ্বায় গাঢ় রক্ত। সেই দীপাবলি কালীপূজার শুভকামনা সবাইকে।

শুধু বর্ণময় আলোর উৎসব নয়, আমাদের আত্মার আলো প্রজ্বলিত হোক, মনের তমস ঘুচে যাক, মায়ের জাতের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির উন্নতি হোক! আগামী বছর আবার হবে কালো মেয়ের পায়ের নিচে আলোর নাচন। আলোর মতো সাথি আর কে আছে! যে নিয়ে যায় অন্ধকারকে নতুন দিনের কাছে।
...

হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব: লেখক, সংগঠক ও সাংস্কৃতিক কর্মী। টরন্টো, কানাডা।