সবুজ মেঘের ছায়া-ছয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সপ্তাহ দুই আগে নদী আর রাকিবের মাউন্ট পিরংগিয়া থেকে নারোটো লেকে আসার কথা ছিল। কিন্তু নদী অপ্রত্যাশিতভাবে মাউন্ট পিরংগিয়াতে তার এক চাচাতো ভাই ও ভাবি পেয়ে এত উচ্ছ্বসিত হলো যে সেদিনের পরে নারোটো লেকের প্রসঙ্গটা প্রায় চাপাই পড়ে যায়। ফেরার পথে রাকিব একবারও নারোটো লেকের প্রসঙ্গ তোলেনি।

আজও নদীকে নিয়ে নারোটো লেকে আসবে, রাকিবের এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। শনিবারে আজকাল রাকিব কোথাও যেতে পারে না। শনিবারে রাকিবকে একটা পর্যন্ত অফিস করতে হয়, কখনো পাঁচটা পর্যন্ত। কেমব্রিজের প্রজেক্টের ঝামেলাটা এখনো শেষ হয়নি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাকে প্রতি শনিবারেই ওভারটাইম করতে হচ্ছে। তাই নদীকে নিয়ে প্রতিটা পরিকল্পনা সে রোববারের জন্য রেখে দেয়।

কিন্তু আজ শনিবার রাকিব নদীকে নিয়ে নারোটো লেকে ঘুরতে এসেছে। হয়তো নদী দুটোর দিকে ফোনটা না দিলে এমন হুট করে সিদ্ধান্তটা নেওয়া হতো না। আজ তার একটা পর্যন্ত অফিস ছিল।

এদিকে ডে-লাইট সেভিংস শেষ হয়ে যাওয়াতে ছয়টা-সাড়ে ছয়টার মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে যায়। দুপুরটা যেমন-তেমন, বিকেলটা যেন হুট করেই শেষ হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালের মতো দীর্ঘ কোনো বিকেল পাওয়া যায় না।

তারা যখন টিয়াওমুটু শহরটা পাশ কেটে নারোটো লেকে এল, ততক্ষণে সত্যিকারের বিকেল নেমে এসেছে। বিকেলের হেলে পড়া রোদের সম্পূর্ণটাই যেন হুমড়ি খেয়ে বিস্তৃতভাবে নারোটো লেকে পড়েছে। লেকের জলেও দিঘল রোদের সোনালি আবরণ। বেশ কয়েকটা হাঁস লেকের জলে ঢেউ তুলে এলোমেলো সাঁতার কাটছে। লেকে কোনো স্রোত নেই, থাকার কথাও নয়। কিন্তু ঢেউ আছে। বেশ ছোট ছোট ঢেউ। সেই ছোট ছোট ঢেউ পাড়ে এসে যখন আঘাত হানছে, তখন ঢেউয়ের শব্দ হচ্ছে ছলাৎ ছলাৎ, ছলাৎ ছলাৎ।

শরৎ শেষ হয়ে শীতের সবে শুরু। শীতের হিন হিন বাতাস লেকের বিস্তৃত জল পেরিয়ে তাদের দিকে আসছে। রাকিব শার্টের ওপর একটা ভারী জ্যাকেট পরে এসেছে। নদীও ফতুয়ার ওপর একটা ভারী কার্ডিগান চাপিয়েছে। কমলা-সবুজ মিশ্রণে নদীর কার্ডিগানটা দারুণ লাগছে। বিকেলের রোদটা যেন সেই কার্ডিগানটার ওপর থমকে রয়েছে।

রাকিব নদীর দিকে ভালো করে তাকাল। নরম বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নদীর কপালের ওপর কয়েকটা চুল উড়ছে। নদী বরাবরই মাঝখানে একটা সিঁথি করে চুল আঁচড়ায়। কখনো সে চুলগুলো ছেড়ে রাখে, কখনো ক্লিপ আটকে একটা খোঁপা করে।

নদী কখনো সাজে না। হয়তো চোখে একটু-আধটুকু কাজলের টান দেয়। রাকিবের মাঝেমধ্যে নদীর সাজ দেখতে ইচ্ছে হয়। অন্তত কপালে একটা লাল টিপ, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। মুখে হালকা প্রসাধনী। কিন্তু আজ প্রায় নয়-দশ মাস হয়ে গেছে তাদের পরিচয় ও কাছে আসা। কিন্তু সে কখনই নদীকে এ কথা বলতে পারেনি।

নদী মুগ্ধ হয়ে লেকের দিকে তাকিয়ে আছে।

লেকটা আসলেই সুন্দর। খুব যে বড়, তা নয়। আবার একেবারে ছোটও নয়। তবে রাকিবের দেখা অন্যান্য লেকের চেয়ে এই লেকটা একটু ব্যতিক্রম এ জন্য যে, এই নারোটো লেকের চারপাশে কোনো বসতি গড়ে ওঠেনি। নিউজিল্যান্ডের বেশির ভাগ ছোটবড় শহরগুলো গড়ে উঠেছে কোনো লেক বা নদীকে কেন্দ্র করে। অথবা কোনো সমুদ্রের তীরে।

এই নারোটো লেকের পাড়ে বসতি গড়ে না ওঠার কারণটা রাকিব বুঝতে পারল না। তবে লেককে কেন্দ্র করে চারপাশে দিগন্ত সবুজ বিস্তৃত খামার গড়ে উঠেছে। অনেক দূরে দূরে কৃষকের বাড়িগুলো।

রাকিব নদীকে জিজ্ঞেস করল, লেকটা সুন্দর না?

নদী বলল, সুন্দর বললে ভুল হবে। অসাধারণ সুন্দর। লেকটার চারপাশে এত সবুজ! একটা জিনিস দেখেছেন?

: কী জিনিস?

: লেকের পাড়ে কোনো সভ্যতা গড়ে ওঠেনি।

রাকিব বলল, বাহ, তুমি শব্দটা সুন্দর বলেছ, সভ্যতা! আমিও কিছুক্ষণ আগে এ ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি। এমন একটা সুন্দর লেকের পাড়ে কেউ বাড়ি করেনি। চারদিকে সবুজ ভূমির ছোট্ট ঢাল নেমে এসেছে। অথচ এমন একটা লেকের পাড়ে অনেক বাড়িঘর ওঠার কথা। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।

নদী জিজ্ঞেস করল, আপনি এই লেকে আগে কখনো এসেছেন?

রাকিব বলল, না। আজই প্রথম। তবে আমি এই লেকের ইতিহাসটা জানি।

: আপনি এত কিছু জানেন কীভাবে?

: নদী, আমি তোমাকে আগেই বলেছি, কোনো জায়গায় ভ্রমণ করতে গেলে তুমি সেই জায়গাটা সম্বন্ধে ভালোভাবে জেনে যেও। তাহলে ভ্রমণে আনন্দ পাবে। আমি আসার আগে টাইনই ট্রাইবের ইতিহাসটা পড়তে গিয়ে নারোটো লেকটা সম্বন্ধে জেনেছি। মাউন্ট পিরংগিয়া সম্বন্ধেও সেখানে লেখা আছে।

: সেই সুগন্ধি মাখা পর্বত?

রাকিব মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ।

নদী বলল, সেই সুগন্ধি মাখা পর্বত আমার জীবনেও সুগন্ধ বয়ে এনেছে।

: সেটা কেমন?

: ওই যে, সেই পর্বতের চূড়ায় আমি আমার এক কাজিন ও তার পরিবারকে খুঁজে পেলাম।

রাকিব আবার মৃদু হাসল। বলল, বেশ বলেছ।

নদী বলল, হ্যাঁ, আমি কিছুক্ষণ আগে নারোটো লেকটা দেখতে দেখতে ওই যে দূরের মাউন্ট পিরংগিয়া দেখছিলাম। আপনি দেখেছেন, এখান থেকেও যে মাউন্ট পিরংগিয়া দেখা যায়?

রাকিব বলল, হ্যাঁ, দেখেছি। ওই তো।

নদী বলল, আপনি এমনভাবে বললেন যে, মাউন্ট পিরংগিয়া যেন এখানে। সেটা কত দূর জানেন?

রাকিব বলল, মাস্টারের ওপর মাস্টারি, তাই না?

নদী শব্দ করে হেসে ফেলল, হি হি, হি হি। বলল, হ্যাঁ, এখান থেকে মাউন্ট পিরংগিয়া বিশ-বাইশ কিলোমিটার।

: হয়েছে, তোমাকে আর কিলোমিটারে হিসাব দিতে হবে না। এই নারোটো লেকের ইতিহাসটা জানো? তুমি এর ইতিহাস জানলে কিন্তু ভয় পেয়ে যাবে।

: থাক, ভয়ের হলে আর বলার প্রয়োজন নেই।

রাকিব বলল, আচ্ছা।

নদী বলল, আপনি আছেন না, ভয়ের কী?

রাকিব হাসল। তবে শব্দহীন হাসি। বলল, তুমিই দেখি রাম, তুমিই দেখি শ্যাম...!

নদী আবার শব্দ করে হেসে উঠল।

রাকিব বলল, তাহলে নারোটো লেকের ইতিহাসটা শোনো। নিউজিল্যান্ডে ইউরোপিয়ানদের বসতির আগে মাউরি আদিবাসীদের নিজেদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও শেষ যুদ্ধটা হয় এই লেকের পাড়ে। আঠারো শতকের প্রথম দিকে পুরো চার বছর এই যুদ্ধটা হয়েছিল। এই যুদ্ধের নাম হিংগাকাকা যুদ্ধ বা ব্যাটেল অব হিংগাকাকা।

নদী বলল, এই নামগুলোর সঙ্গে না কেমন একটা চাইনিজ বা জাপানিদের নামের মিল আছে।

: তাই নাকি? মাউরি আদিবাসীরা পলিনেশিয়ান তো, তাই হয়তো। আচ্ছা, যুদ্ধের গল্পটা শোনো না।

: সরি, বলুন।

: হিংগাকাকা যুদ্ধের একপাশে ছিল ওয়াইকাটো-টাইনই, তারানাকি-মানিয়াপুটু ট্রাইব। যাদের প্রধান সেনাপতি ছিলেন টি রাঙ্গা। ওরা যুদ্ধ করেছিল নিজেদের জলভাগ ও ভূমি রক্ষার জন্য। আর অন্যদিকে ছিল নাটি টোয়া ট্রাইব। নাটি টোয়া ট্রাইবের অনেকগুলো ভাগ ছিল। নাটি কৌফাটা, নাটি রোয়াকাওয়া, নাটি রাওনিসহ আরও অনেক। সব নাটি টোয়া ট্রাইবের সর্দার ও যোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিল নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য। তাদের প্রধান সেনাপতির নাম ছিল পিকোটি রাঙ্গি।

: নিজেদের অধিকার বলতে কী?

: ওই তো, ওরা মনে করত, ওয়াইকাটো-টাইনই ও তারানাকি-মানিয়াপুটু ট্রাইবের সর্দার ও লোকজন অতীতে নাটি টোয়া ট্রাইবদের ভূমি ও জলভাগ দখল করে তাদের রাজত্ব গড়েছে। তাই সমস্ত নাটি টোয়া ট্রাইব একত্রে মিলে দখলকৃত ভূমি ও জলভাগ পুনরুদ্ধারের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।

: নাটি টোয়া টাইব কি তাদের জল ও স্থলভাগ পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল?

: আরে না। ওয়াইকাটো-টাইনই ট্রাইব ও তারানাকি-মানিয়াপুটু ট্রাইব খুব শক্তিশালী ছিল। তবে যুদ্ধটা চার বছর দীর্ঘ হয়েছিল। যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা প্রচুর হয়। দীর্ঘ যুদ্ধে ওয়াইকাটো-টাইনই, তারানাকি-মানিয়াপুটু ট্রাইবের বিশাল জয় হয়। অন্যদিকে নাটি টোয়া ট্রাইবের যোদ্ধারা খুব বাজেভাবে হেরে যায়। হেরে কেউ কেউ পালিয়ে যায়। কেউ কেউ বন্দী হয়। তবে বেশির ভাগ যোদ্ধার লাশ পড়ে এই প্যাটারান্ডি-পিরংগিয়া-নারোটো অঞ্চলে। যুদ্ধ জয়ের পর ওয়াইকাটো-টাইনই ও তারানাকি-মানিয়াপুটু ট্রাইবের সর্দার, লোকজন এই লেকের পাড়ে এক বিশাল উৎসবের আয়োজন করে।

: এই নারোটো লেকের পাড়ে?

: হ্যাঁ, এখানে। আমাদের আশপাশে এই বড় বড় গাছগুলো দেখ না, এই গাছগুলো ইতিহাসের সাক্ষী।

: সেটা কেমন?

: আমি সেটা বলছি। আগে পুরো কাহিনিটা শোনো। তাদের বেশ কয়েক দিনব্যাপী এই উৎসব চলে। উৎসবে ওয়াইকাটো-টাইনই ও তারানাকি-মানিয়াপুটুর হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে। উৎসবে খাওয়া-দাওয়ার কোনো কমতি ছিল না। একে তো নাটি টোয়া ট্রাইবের পরাজিত যোদ্ধাদের অনেক লাশ ছিল। লাশের তাজা মাংস ও তাজা রক্ত ছিল। ওয়াইকাটো-টাইনই ও তারানাকি-মানিয়াপুটু যোদ্ধা ও লোকজন সেই লাশগুলো দিয়ে প্রথমে ভোজন ও উৎসব শুরু করে। তবে তারা সব লাশ খেয়ে শেষ করতে পারে না। লাশে পচন ধরলে তারা সেগুলোকে ওয়াইপা নদীতে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসে।

নদী আঁতকে উঠে বলল, বলেন কী, মানুষের মাংস ও রক্ত খেয়ে যুদ্ধ জয়ের উৎসব?

রাকিব বলল, ওটা তো মাউরি আদিবাসীরা আজ থেকে এক শ-দেড় শ বছর আগেও করেছে। মাউরি যোদ্ধারা যখন ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে আঠারো শ চল্লিশ বা চুয়াল্লিশ সালে যুদ্ধ শুরু করে এবং সেই যুদ্ধ আঠারো শ বাহাত্তর সাল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়, তখন তারা একজন ইউরোপিয়ান সৈন্য মারতে পারলে বা বন্দী করতে পারলে সেই ইউরোপিয়ান সৈন্যটার তাজা রক্ত ও তাজা মাংস খেত। উনিশ শ দশ-বারো সালের দিকেও এমন ঘটনা অহরহ ঘটেছে।

: এ জন্য মাউরি আদিবাসীদের দেখলে আমার ভয় লাগে। ওরা দেখতেও অসুরের মতো।

: না না, ওগুলো তো এক শ-দেড় শ বছর আগের ঘটনা। ওরা এখন সভ্য জাতি। ওরা বেশ আগেই সভ্য হয়েছে। এমনটা শুধু মাউরি আদিবাসী না, প্রশান্ত মহাসাগরের প্রতিটা দ্বীপ রাষ্ট্রের আদিবাসীদের এই চরিত্র ছিল। এক শ-দেড় শ বছর আগেও ওরা মানুষের মাংস উৎসব করে খেত। পাপুয়া নিউগিনির পাহাড়ি অঞ্চলের ট্রাইবদের মধ্যে এখনো নাকি কোনো কোনো ট্রাইব উৎসব করে মানুষের মাংস খায়।

: জি, আমি জানি। পাপুয়া নিউগিনির সরকার সে সব ট্রাইবের লোকজনের জন্য স্যানিটারি পায়খানা ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু ট্রাইবের সর্দার তা মেনে নিতে না পেরে সব স্যানিটারি পায়খানা ভেঙে দেয়। সব ইলেকট্রিক খাম্বা ভেঙে দিয়ে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তারা নাকি তাদের অতীত সংস্কৃতি ধরে রাখতে চায়। আধুনিকতা চায় না।

: হ্যাঁ, আমি শুনেছি। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরাও মরুভূমির ছোট ছোট গ্রামগুলোতে এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে সে দিক দিয়ে মাউরি আদিবাসীরা অনেক উন্নত ও অনেক আধুনিক। তুমি ইউরোপিয়ান আর মাউরি আদিবাসীদের জীবনব্যবস্থায় খুব একটা পার্থক্য পাবে না। ওরা এখন সবক্ষেত্রে ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমানে সমান এগোচ্ছে। এক শ-দেড় শ বছর আগের মাউরি আদিবাসী আর এখনকার মাউরি আদিবাসীদের মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য।

নদী মাথা ঝাঁকাল। একটু এদিকওদিক তাকাল। তারা বাদেও আরও কিছু মানুষ লেকের পাড়ে ঘুরতে এসেছে। দুটো ক্যারাভ্যানও আছে। তবে পরিবেশটা একেবারেই নিস্তব্ধ। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। লেকের জল থেকে মাঝেমধ্যে সম স্বরে হাঁসের ডাক আসছে-প্যাঁক-প্যাঁক, প্যাঁক-প্যাঁক।

নদী তাদের পাশের শত শত বছরের পুরোনো গাছগুলোর দিকে তাকাল। লেকের এপাশটাতেই শুধু গাছ। গাছের অনেকগুলো ডালা লেকের দিকে ঝুঁকে আছে। এ ছাড়া লেকের জলে একটা কাঠের ডক নেমে গেছে।

নদী কী ভেবে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা রাকিব ভাই, আপনি না বললেন, গাছগুলো ইতিহাসের সাক্ষী। এই গাছগুলো ইতিহাসের কি সাক্ষী?

রাকিব মৃদু হেসে বলল, ও, হ্যাঁ। মাউরি আদিবাসীদের হিংগাকাকা যুদ্ধের গল্পটা তো শেষ করিনি। ওয়াইকাটো-টাইনই ও তারানাকি-মানিয়াপুটু যুদ্ধ জয়ের পর যে উৎসব শুরু করে, সেই উৎসবের একপর্যায়ে লাশের তাজা মাংস খাওয়া শেষ হয়ে যায়। লাশগুলোতে পচন ধরলে তারা সেগুলো পাশের ওয়াইপা নদীতে ফেলে আসে। কিন্তু তারা এত তাড়াতাড়ি তো উৎসব শেষ করতে রাজি নয়। তাই তারা এবার নাটি টোয়া ট্রাইবের পরাজিত বন্দী যোদ্ধাদের একে একে আট-দশজন করে ধরে নিয়ে এসে রশি দিয়ে গাছে টানিয়ে মারে। মারার পর সেই বন্দী যোদ্ধাদের মাংস ও তাজা রক্ত দিয়ে তারা আবার ভোজন ও উৎসব করে। এই উৎসব মাসব্যাপী হয়।

নদী চোখ বড় বড় করে বলল, তারা তো আসলেই বর্বর ছিল।

রাকিব বলল, নদী, তুমি বর্বরতার কী শুনেছ? তারা লাশগুলো কীভাবে খেত জানো, তারা একেকটা লাশকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করত। এটা শুধু ওয়াইকাটো-টাইনই বা তারানাকি-মানিয়াপুটু ট্রাইবের ক্ষেত্রেই নয়। পরাজিত যোদ্ধাদের লাশ ভাগ করে খাওয়ার মধ্যে সব আদিবাসী মাউরিরাই একটা সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করত। লাশের মাংস খেত সাধারণ মানুষজন। বিজয়ী যোদ্ধারা খেত লাশের ফিনিক দেওয়া তাজা রক্ত। লাশের তাজা কলিজা খেত যোদ্ধাদের যে প্রধান। আর বিজয়ী সর্দাররা খেত লাশের মাথার মগজ। যে সব লাশের মগজ খাওয়া হতো না, সেই লাশের মাথাগুলো বর্শায় গেঁথে বিজয়ের প্রতীক হিসেবে উৎসবস্থলের চারপাশে সারি সারি করে খাঁড়া করে রাখা হতো। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1564460