হৃদয়ের কান্না

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তোর স্বভাব খারাপ। এ জন্যই তোর বউয়ের পোলাপান হয় না। নইলে দশ বছর হইছে, ছেলেমেয়ের মুখ দেখবি না ক্যান? পথে ঘাটে টাকার দরবার করছ!

হারু মিয়ার কথা শুনে বরফ হয়ে যায় শাহিন। কীসের মধ্যে কী! দুই বছর আগের টাকা, চাইতেও পারবে না? নিজেকে সামলে নিয়ে শাহিন বলে, ছেলেমেয়ে দেওয়ার মালিক আল্লা, এখানে মানুষের কী করার আছে?

: হ, সব দোষই তো এখন আল্লার। আচার আচরণ ভালো কর, মানুষের দোয়া দরকার।

: কী খারাপ আচরণ করছি, হারু কাকা?

: রাস্তা-ঘাটে টাকা চাস!

: দুই বছর আগের টাকা, আমি সমস্যায় আছি। শীলাকে নিয়া ঢাকায় যাব, টাকা দরকার।

: কী কারণে ঢাকায় যাবি?

: গাইনি বিভাগের ভালো একটি ডাক্তারের খোঁজ পাইছি...।

শাহিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই হারু মিয়া বলে, লাভ হবে না, খালি খালি টাকা নষ্ট।

এবার আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না শাহিন। প্রচণ্ড রকম ক্ষেপে গিয়ে বলে, আপনার কাছে টাকা পাই, টাকা দেবেন। এত কথার দরকার নাই। অনেক সম্মান দেখিয়েছি, আর না!

: এত বড় কথা! করবি কী তুই হারামজাদা?

হারুর অবস্থা দেখে নিজেকে আবার সামলে নেয় শাহিন। হারু মানুষ ভালো না, তার কোনো সম্মানের ভয় নাই। হয়তো বলে বসবে, শাহিন আমাকে ঘুষি দিছে।

আর কোনো কথা না বলে বাড়ির দিকে চলে আসে শাহিন। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে বলে, আপনার বিচার আল্লা করবে। হাশরের মাঠে এই টাকা নেব, দাবি ছাড়ব না।

শাহিনের কথা শুনে হাসে হারু। তার বুকে আল্লার ভয় নেই। বলে, হাশরের মাঠেই তোরে টাকা দিমু, আর চাবি না।

মনটা ভীষণ খারাপ, বাসায় এসে চুপচাপ বসে আছে শাহিন। এত খারাপ মানুষ হয়! অকারণে এত বড় কষ্ট দিয়া কথা বলে। চোখে পানি আসে শাহিনের। দূর থেকে দেখে শীলা। শীলা জানে, তার জন্যই শাহিনের কথা শুনতে হয়।

কথা শীলাও কম শোনে না। কিন্তু মেয়ে মানুষের ধৈর্য বেশি। হাসি মুখে অনেক কিছুই সহ্য করে নিতে হয়। তা ছাড়া আজকাল শীলা বাড়ির বাইরে যায় না বললেই চলে। কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়নি প্রায় দুই বছর। কোথাও গেলে, শীলাকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। সব সহ্য করা যায়, কিন্তু কথার কাঁটা সহ্য করা বড় কঠিন।

কেউ কেউ মুখ বাঁকা করে বলবে, পোলাপান না হইলে মাইয়াগো দাম কী!

শাহিনের কাছে এসে শীলা বলে, তুমি পুরুষ মানুষ তোমাকে তো বাইরে যেতে হয়। আমি বলি কী তুমি আর একটা বিয়া করো।

রাগে, কষ্টে চোখ দুটি লাল হয়ে যায় শাহিনের। চিৎকার করে বলে, ফালতু কথা বলবা না শীলা। দরকার হলে তোমারে নিয়া দূরে সরে যাব, আল্লা যেদিন সন্তান দেবে সেদিনই হবে।

সেদিন খুব কাঁদে শীলা। শাহিনও দুই দিন ধরে বাইরে যায় না। তাদের যে সন্তান হয় না, সেটা শীলা, শাহিন দুজনেই মেনে নিয়েছে। মন খারাপ হয় ঠিক, কিন্তু আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা তাদের। হয়রত জাকারিয়া (আ.)–র কথা স্মরণ করে। আল্লাহ তাকে অনেক বয়সেও একজন পুত্র সন্তান দান করেন। সেই ছেলের নাম ছিল ইয়াহিয়া। তাঁর স্ত্রীও বন্ধ্যা ছিলেন।

কদিন ধরে মন ভালো নেই শাহিনের। সকালে গিয়ে দোকানে বসে। সন্ধ্যায় সোজা বাসায় চলে আসে। কোথায়ও দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয় না। আজও দোকান থেকে বাড়িতে ফিরছে।

মাগরিবের আজান হয়েছে। এলাকার মসজিদে নামাজ পড়ে বাসায় ফিরবে শাহিন। এরই মধ্যে দেখা হয় ইমরান উকিলের সঙ্গে। উকিল আর ডাক্তারদের সব সময় এড়িয়ে চলে শাহিন। উকিলরা বিনা কারণে কথায় প্যাঁচ খাটায়। আর ডাক্তারেরা চেহারার মধ্যেও রোগ দেখতে পায়। হয়তো স্থির চোখে তাকিয়ে বলবে, মনে হয় তোমার জন্ডিস হয়েছে।

তবে আজ কিছুতেই রাগ করবে না শাহিন, মন শক্ত করে নিয়েছে। ইমরান উকিল বলছে, কই যাও?

শাহিন বলে, বাসায়।

: এই সন্ধ্যায় বাসায়?

: ভালো লাগছে না।

: হ, ভালো লাগবে কী করে, বুঝলা ভাই, ছেলেমেয়ে হচ্ছে সুখ। বাবা বলে ডাকলে মন এমনিই ভালো হয়ে যায়।

: জ্বি, আর কিছু বলবেন? আমি যাব।

: তয় কী করলা?

: কীসের কী করব?

: আমার কাছে ভালো একজন ফকির আছে, টাকা পরে নেবে।

: ধুর মিয়া ফালতু কথা বলেন, ঢাকায় গিয়া বড় ডাক্তার দেখাব।

: কিচ্ছু হবে না। ডাক্তার এর কিছুই করতে পারবে না।

: দরকার নাই আমার ছেলেমেয়ের, আমি ভাবছি...।

: কী ভাবছ?

: ভাবির তো বছর বছর হইতেছে, ওখান থেকেই একটি আনব। চলেন।

: কোথায়?

: আপনার বাসায়, কমাস আগেও আপনার একটি মেয়ে হয়েছে, নাম যেন কী? হেনা। চলেন।

: ফালতু কথা বলবা না। যাও কাজে যাও।

: আমার কোনো কাজ নাই, হেনাকে আমি পালক নেব। আপনার তো অনেকগুলি, অত দিয়া কী করবেন।

কি বলবেন বুঝতে পারছেন না ইমরান উকিল। আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়লাম তো, মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে নাকি?

শাহিন বলে, ভাই চলেন। আমি হেনাকে না নিয়ে বাসায় যাব না।

: তুমি বললেই হবে।

প্রায় চিৎকার করে ওঠে শাহিন, আমি বললেই হবে। এখনই আপনার বাসায় যাব।

: ভাই তোমার কী হইছে, এমন করতেছ কেন?

: আপনার মেয়েকে দিলে তো অসুবিধা নাই, আবার সামনের বছর একটা বানাতে পারবেন। চলেন।

: আমার কাজ আছে...প্রায় দৌড়াতে শুরু করেন ইমরাম।

তার পেছনে শাহিন। সে বলে, ভাই দাঁড়ান।

ইমরান বলেন, এই পেছনে আসবা না।

বাসার দিকে হাঁটতে থাকে শাহিন। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে। চোখে পানি আসে। শীলা ঘরবন্দী, এখন তারও ঘরবন্দী হতে হবে! তারা বাঁচবে কী করে?

কোথায়ও যেতে পারছে না তারা। সব জায়গাতেই একই কথা, কেউ ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের এখনো পোলাপান হয়নি? আর নিন্দুকেরা তো কথার কাঁটা ফোটাতেই থাকে সারা দিন।

তারা কী কোনো দিন বুঝবেন না, যে মানুষটির সন্তান হচ্ছে না, তিনি কতটা কষ্টে থাকেন? মানুষ যেন মানুষকে কষ্ট দিতেই ভালোবাসে।

তার দুই দিন পরে এক রাতে বাসা থেকে বের হয় শাহিন আর শীলা। ওদের হাতে থাকে একটি ব্যাগ। আর বেশ কিছু টাকা। শাহিন তার ব্যবসা রেখে যায় ওর ভাতিজার কাছে। সন্তানই যদি না থাকে, তাহলে টাকা-পয়সা, ব্যবসা-বাণিজ্য দিয়ে কী হবে।

শীলা জিজ্ঞেস করে, আমরা কোথায় যাব?

শাহিন বলে, চিটাগাং চলে যাব। সেখানে আমার এক বন্ধু আছে। আমাদের কেউ চিনবে না সেখানে। মানুষের যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না।

ওরা হাঁটতে থাকে। বারবার পেছনে তাকায় শীলা। চোখ মোছে, কান্না চাপাতে গিয়ে বুক ছিঁড়ে শব্দ বেরিয়ে আসে। কতগুলো বছর ধরে সব নিজের হাতে গড়েছে। রান্না ঘর, উঠোনের পাশে সবজির বাগান, শিউলি ফুলের গাছ, আমলকি গাছ...। পোষা কুকুরটি হাঁটছে ওদের পিছু নিয়ে। কুকুরটির চোখে পানি, বারবার শীলার পায়ের কাছে এসে মুখ দিচ্ছে।

কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শাহিন বলে, বাড়ি দেখিস। আর কবে ফিরে আসি জানি না। এলে দেখা হবে।

কুকুরটি ফিরে যায়। শব্দ করে কেঁদে ওঠে শীলা। ওর বুকের কষ্ট অন্ধকার মিলিয়ে যায় না, বাতাসের গায়ে ভেসে জমা হতে থাকে পৃথিবীর সব বন্ধ্যা মেয়ের বুকে।

একটু দূরে গিয়ে বিবশ চোখ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে কুকুরটি।
...