কিছু পাওয়া, কিছু চাওয়া

লেখিকা
লেখিকা

আমার চার বছর বয়সের কন্যা নার্সারি স্কুলে পড়ে। সেদিন তাকে স্কুল থেকে আনতে গেছি, তার টিচার গম্ভীর স্বরে আমাকে জানালেন, আমার সঙ্গে তার জরুরি কথা আছে। আমাকে অপেক্ষা করতে বলে তিনি ভেতর থেকে কয়েকটি পেপার নিয়ে এসে আমাকে বললেন, তোমার মেয়ের ডান গালে একটা নীল রঙের দাগ দেখতে পাচ্ছি। আমরা জানতে চাই এটা কী?

আমি বললাম, পরশু বাসায় খেলার সময় পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। এই বয়সের বাচ্চারা তো একটু চঞ্চল হয়। সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে, এটা-সেটা করে আর ব্যথা পায়। তেমন সিরিয়াস কিছু না।

কন্যার টিচার বললেন, হয়তো তোমার কথাই ঠিক, হয়তো এটা সামান্য ব্যথাই, কিন্তু যেহেতু একটা দাগ কাজেই এটা আমাদের সিরিয়াসলি নিতে হবে। এই ফরমটা তোমাকে পূরণ করতে হবে...প্লিজ এটা পড়।

কাগজগুলো হাতে নিলাম। বাচ্চা কখন কোন মুহূর্তে কীভাবে ব্যথা পেয়েছে, ব্যথা পাওয়ার পর সে কতটা কেঁদেছে, ব্যথা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাগ পড়ে গেছে নাকি পরে পড়েছে, পরে হলে কত পরে, ব্যথা পাওয়ার সময় বাড়িতে ছিল না বাইরে, আমরা (অভিভাবক) কে কে তখন উপস্থিত ছিলাম, আমরা তখন তাকে কী ওষুধ দিয়েছি, ডাক্তারের কাছে নিতে হয়েছে কিনা, ডাক্তারের কাছে নিয়ে থাকলে ডাক্তার তাকে দেখে কী বলেছেন বা কী পেসক্রাইব করেছেন ইত্যাদি নানান ধরনের প্রশ্ন। সবগুলোর উত্তর লিখে সই করে টিচারের হাতে দিলাম। মেয়ের হাত ধরে চলে আসার সময় ভদ্রমহিলা আমাকে যুক্তরাজ্যের চাইল্ড অ্যাক্ট আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন—এ রকম ঘটনা (বাচ্চার গায়ে ব্যথার দাগ) দুবারের বেশি ঘটলে তারা অ্যাকশন নেন। তাই শরীরে ক্ষত চিহ্ন পড়ে যায় এমন রিস্কি খেলা বাচ্চাকে খেলতে না দেওয়াই ভালো।

এখানে অ্যাকশন নেওয়া মানে বাবা–মার (অভিভাবক) বিরুদ্ধে নালিশ বা কেস। কর্তৃপক্ষ এসে ভালোভাবে যাচাই করে যে এই অভিভাবক বাচ্চা পালনে যোগ্য ভূমিকা পালন করছেন কিনা, বাচ্চা তাদের কাছে সেফ কিনা, তারা বাচ্চাকে কোনোরকম অ্যাবিউজ করছেন কিনা। সব দেখে শুনে তারপর তারা তাদের সিদ্ধান্ত জানায়। বাচ্চার ভবিষ্যৎ সিকিউরিটি তারা নিশ্চিত করে। অভিভাবক যদি অযোগ্য প্রমাণিত হয় তাহলে শিশুটিকে তাদের কাছে আর দেওয়া হয় না।

টিচার বা কেয়ার গিভাররা যখন এ ধরনের ছকে বাধা কথাগুলো মুখস্থ বুলির বলে যান তখন মনে মনে হালকা হেসে উঠি। বলতে ইচ্ছে করে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। আমার বাচ্চার ভালোমন্দ আমার চেয়ে যেন এরা বেশি বোঝে! এ কথা ভাবার পর মুহূর্তেই মনে পড়ে যায়, না এটা অন্যায়। উন্নত দেশগুলোর শিশুদের সেফটির জন্য করা এই সিস্টেম কতটা জরুরি তা প্যারেন্ট মাত্রেই জানেন। এতে বিরক্ত হওয়াই উল্টো দোষের। আমি নিজে দীর্ঘদিন শিশুদের নিয়ে কাজ করেছি। চাইল্ড সেফটির নিয়ম কানুনের ব্যাপারে আমি তাই আরও বিশদভাবে জানি। কতবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেবেছি, ইস এ রকম যদি আমাদের দেশের সিস্টেম হতো, আমরা যদি চাইল্ড অ্যাবিউজের ব্যাপারে এতটাই কনসার্ন হতাম, আমাদের নিয়ম কানুনগুলো যদি এ রকম কঠিন ও শক্ত হতো তাহলে মা–বাবারা তাদের সন্তানদের নিরাপদ ভাবতে পারতেন। বাংলাদেশে এখন চাইল্ড সেফটি নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে, সচেতনতা সৃষ্টি করার ব্যাপক প্রয়াস চালানো হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিগুলোর মতো নিয়মকানুন এ রকমভাবে ফলপ্রসূ হতে এখনো অনেকটাই দেরি।

দেশ ছেড়ে, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে এত দূরে থাকার মধ্যে প্রাপ্তির চেয়ে হাহাকারটাই বেশি। নিজের শেকড় ছেড়ে অন্য সংস্কৃতির মধ্যে বাস করা বা মিশে যাওয়া কখনোই সুখের নয়। তবু আমাদের মতো বহু প্রবাসীরা নিজের মনের সঙ্গে অবিরত যুদ্ধ করতে করতে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কাটিয়ে দেন শুধু এই একটা কারণে, আর তা হলো সন্তানের একটি নিরাপদ পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ। টাকা পয়সা, বাড়ি গাড়ি সবকিছুই দেশের ভালোবাসার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। তুচ্ছ হতে পারে না শুধু সন্তানের নিরাপত্তা। তাই নিজের শেকড়ে ফেরার সকল ইচ্ছেকে মনের কুঠুরিতে বন্ধ করে রেখে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাদের জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়, তাদের কষ্ট বোঝার কেউ নেই।

দেশের মানুষ তাদের ত্যাগ, তাদের দীর্ঘশ্বাস দেখতে পান না...উল্টো টিটকারি মেরে বলেন, এতই যখন টান তাহলে ওখানে পড়ে আছ কেন? এগুলো বিলাসী ভালোবাসা, আর কিছুই নয়। অমন আরাম আয়েশের জীবনযাপন করলে এ রকম দেশপ্রেমের কথা আমরাও বলতে পারব। আফসোস তারা জানেন না, বিদেশ মানেই আরাম আয়েশ নয়, বিদেশ মানেই কাড়ি কাড়ি টাকার বিছানায় শুয়ে থাকা নয়। বাংলাদেশে মিডল ক্লাসের লাইফ যতটা কঠিন, প্রবাসেও তাই, কোনোটা কারও থেকে কম বা বেশি নয়। তাই কাউকে এভাবে তাচ্ছিল্য করা বা জাজমেন্টাল হওয়া উচিত নয়।

হ্যাঁ, দেশের বাইরে যারা থাকি কিছু সুবিধা পাই। যেমন বাইরের আইন কানুন কড়া, আমাদের হয়তো সন্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা কম করতে হয়। আমাদের খাদ্যে ভেজাল নেই। এখানে দুই নম্বরি করে লোক ঠকানো নেই। এগুলো সবই সত্যি। কিন্তু তারপরেও আমাদের অনেক না পাওয়া আছে। সেগুলোও নেহাত কম নয়।

প্রবাসে কেউ কাউকে সাহায্য করে না। কেউ কারও খোঁজও রাখে না। মামা–খালার জোরে এখানে কোনো জব হয় না। ঘরে দারোয়ান, গাড়িতে ড্রাইভার, অফিসে পিয়ন বা সহকারী আর বাসায় কোনো কাজের বুয়া থাকে না। ঘরে–বাইরে সমস্ত কাজ নিজেদের করতে হয়। দেশের মতো বিপদে আপদে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের কাউকে কাছে পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। চরম দুঃসময়েও একাই নিজেদের সামলাতে হয়। শবেবরাত হোক, রোজা হোক কী ঈদ, সব দিনই কাজে যাওয়া লাগে। প্রবাসীদের সন্তানেরা দেশের মতো কাজিনদের সঙ্গে হাসি আনন্দের শৈশব কৈশোর পায় না। বিদেশে টাকা উপার্জন যেমন কষ্টসাধ্য, টাকা জমানো তার চেয়েও বেশি কষ্টের। রেসিজমের মতো বেদনাদায়ক ও অপমানজনক একটি ব্যাপারের শিকারও এখানে হতে হয়। আরও এমন অনেক কষ্ট আছে, যাতনা আছে যা দেশের মানুষকে সহ্য করতে হয় না।

তারপরও ভালো মন্দ মিলিয়েই আমাদের জীবন। দেশে ও দেশের বাইরে সকলেই দুঃখকষ্ট, আনন্দবেদনা আমরা এক একরকম ভাবে ফেস করি। অপ্রাপ্তি ও অসন্তোষ যেমন আছে তেমনি প্রাপ্তি ও সন্তুষ্টিও কিছু কিছু কিছু করে আমাদের সবার আছে। এগুলো মনে করে প্রায়ই বলতে ইচ্ছা করে আচ্ছা একে অপরকে ভালোবেসে, একে ওপরের অনুভূতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, একে অপরের কষ্ট ও নিরুপায়তাগুলো বুঝে আমরা কি একাত্ম হয়ে থাকতে পারি না?