বৈরী হাওয়ায় কর্মজীবী মা

কর্মজীবী মায়েরা তাঁদের গৃহস্থালির কাজকর্ম, সন্তান লালনপালন, আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সামাজিকতা রক্ষা ও নিজের কর্মস্থলের মধ্যে সামঞ্জস্য আনয়নের জন্য নিজের জীবনকে একটা ঘড়ির কাঁটার মতন বানিয়ে ফেলেন। ঘড়ির কাঁটাও মাঝেমধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু চাকরিজীবী মায়েদের কখনো থামতে নেই। কর্মজীবী মা হিসেবে যতটা না ঘরে–বাইরে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়, তার চেয়ে বেশি মানসিক নিপীড়নের স্বীকার হতে হয়। এই মানসিক নিপীড়নের উৎপত্তি আমাদের চারপাশের মানুষগুলো থেকেই।

আমার মেয়ে জন্মের সময় আমি অফিস থেকে কেবল তিন মাসের ছুটি পেয়েছিলাম। আমি হন্যে হয়ে একজন সাহায্যকারী খুঁজছিলাম, যার কাছে বাচ্চাটাকে রেখে অফিস যেতে পারি। যখনই কাউকে বলেছি ভালো কোনো লোকের সন্ধান পেলে আমাকে জানাতে, তখনই তার কাছ থেকে একগাদা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। এত দিন তো চাকরি করেছেন, এখন না হয় আর নাই করলেন! আপনার স্বামী তো অনেক ভালো উপার্জন করে, তবে আপনার করার দরকার কী? মেয়েরা এত ক্যারিয়ারিস্ট হলে সংসার টেকে না, বাপ-মা দুজনই ব্যস্ত থাকলে সন্তান মানুষ হবে কীভাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে প্রথম যেদিন অফিসে জয়েন করার জন্য যাচ্ছিলাম, পুরো রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে গেছি। ভেতরটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। আমি যতই সামনের দিকে হাঁটি ততই আমার বাচ্চার শরীরের গন্ধ যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। রিকশার খোঁজে বাসা থেকে বের হয়ে কিছু দূর যেতেই পাশের ফ্ল্যাটের দুই ভাবির সঙ্গে দেখা হলো। তারা আমার চোখ মুখ লাল দেখে খুবই আন্তরিকতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? আমি বললাম, মেয়েকে রেখে অফিসে যাচ্ছি খুব কষ্ট লাগছে। প্রত্যুত্তরে যা শুনলাম তা হলো, ভাবি, আপনি ভালোই শক্ত, কীভাবে যে পারেন! আমার হাসব্যান্ড আমাকে বলেছে, যত টাকা লাগে আমাকে হাতখরচ দেবে, কিন্তু বাচ্চা রেখে চাকরি করার দরকার নেই। এত কষ্টের মাঝেও হেসে বললাম, আমাদের মা-মেয়ের জন্য দোয়া করবেন!

এরপর আমি হাঁটা শুরু করলাম। মা হিসেবে কেমন যেন নিজেকে অপরাধী লাগছিল, আমি কি তবে আমার সন্তানকে কম ভালোবাসি? স্বামীর থেকে হাত খরচ পাওয়া না পাওয়ার ওপর কি আমার মেধা ও দক্ষতার মূল্যায়ন হবে? আমি কি পারব আমার সংসার ও কর্মস্থল সামলে আমার সন্তানকে একটা নিরাপদ ভবিষ্যৎ দিতে? এসব ভাবতে ভাবতেই বিড়বিড় করে আমার প্রিয় দুইটা লাইন আওড়ালাম—‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়...!’

আমার মেয়ের যখন পাঁচ মাস বয়স ছিল তখন আমার হাসব্যান্ড যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, হুট করেই সব কর্মচারী ছাঁটাই করে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেল। সংসারের মুখ্য খরচগুলো সব সময় তিনিই বহন করতেন। তাই আমরা চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলাম। আমার তখন পার্টটাইম জব। অফিসে গেলে বেতন হয়, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কোনো কারণে অফিসে অনুপস্থিত থাকলে বেতন হয় না। মাস শেষে যে পরিমাণ বেতন আমার হাতে আসে, তা দিয়ে ঢাকা শহরে বাড়িভাড়া দেবার পর কেবল তিন হাজার টাকা থাকবে। বাড়ির সাহায্যকারীর বেতন, তিনজন পরিপূর্ণ মানুষের তিনবেলার খাওয়া দাওয়া, প্রয়োজনীয় পোশাক–পরিচ্ছেদ, ওষুধসামগ্রী ক্রয়, বাচ্চার জন্য কৌটার দুধ, তার পাম্পারস ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনা, সব মিলিয়ে তিন হাজার টাকায় মাস পার করতে তিনবেলার জায়গায় দুইবেলা খেয়েছি। দুর্দিনে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাইকে চেনা যায়। আর আত্মসম্মানবোধ বেশি থাকলে দেখবেন কাউকে নিজের কষ্টের কথা বলতেও পারছেন না। ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ এই সত্যের মুখোমুখি যারা হন, তাঁরা জানেন সন্তানের জন্য কেবল ভালোবাসা তুলে রাখলে জীবন চলে না! সন্তানের সুন্দর জীবনের জন্য বাবা-মাকে মাঝেমধ্যে কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয়!

বলাই বাহুল্য, বাচ্চাকে গৃহপরিচারিকার কাছে রেখে চাকরি করি বলে যাঁরা আমার সন্তানের জন্য অনেক মায়া কান্না দেখিয়েছেন, তাঁরা কেউ আমার দুর্দিনে সন্তান বা আমার পরিবারের জন্য একবেলার ডাল–ভাতের জোগান দেননি!

আমার একজন সহকর্মী ছিলেন, তিনি তাঁর শাশুড়িসহ একসঙ্গেই থাকতেন। সারা দিন অফিস করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে তিনি ওনার এক বছরের বাচ্চাকে ফিড করানোর আগে রান্নাঘরে ঢুকে শাশুড়ির পছন্দমতো পরের দিনের সবকিছু রান্না করে দিতেন। শাশুড়ি বিয়ের প্রথম থেকেই বলেছেন, চাকরি করবে ভালো কথা কিন্তু কাজের লোকের হাতের রান্না তিনি খাবেন না। তাঁর ভাষ্যমতে, সারা দিন বাচ্চা রেখে যদি কাজ করতে পারে তবে বাসায় এসে বাচ্চার জন্য এত আদিখ্যেতা না দেখালেও চলে...!

কর্মজীবী মায়েরা কর্মস্থলে ও নানা ধরনের নেতিবাচকতার মুখাপেক্ষী হন। আমার ব্যক্তিজীবন থেকে তো বটেই আমি আমার চার পাশের সহকর্মীদেরও দেখেছি বিভিন্ন মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে। আমি যখনই কোনো ভালো পদের জন্য আবেদন করতে গেছি আমাকে নির্বাচন না করার পেছনে সব চেয়ে জোরালো যুক্তি ছিল, আমি আটটা-পাঁচটার বাইরে অফিসকে কী দিই? একবার আমার এক সুপারভাইজার আমাকে বললেন, আমি বুঝি আপনার ছোট একটা বাচ্চা আছে, এ জন্য আপনি অফিস শেষে এক মিনিটও থাকতে চান না। আপনার কাজের দক্ষতা বেশ ভালো, বার্ষিক যে টার্গেট থাকে তার চেয়েও মাঝে মধ্যে বেশি করেন। কিন্তু সে জন্য তো অফিস আপনাকে বেতন দিচ্ছে! আপনাকে ভালো অবস্থানে যেতে হলে এর বাইরে অতিরিক্ত সময় অফিসকে দিতে হবে। এ ধরনের কথায় আমি খুব বিস্মিত বোধ করি। অফিস নির্ধারিত সময়ের বাইরে আমার পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত সময় অফিসের জন্য ব্যয় করে ক্যারিয়ারের উচ্চপর্যায়ে যাওয়ার ইচ্ছা আমার কখনো হয়নি।

দেশ ছেড়ে বিদেশ এসেও একই ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছি। আমি বর্তমানে যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছি, সেটা কানাডার পাঁচটি বড় ব্যাংকের মধ্যে একটা। ইন্টারভিউয়ের সময় আমাকে ম্যানেজমেন্টকে আশ্বস্ত করতে হয়েছিল যে আমার সন্তান নিয়ে কোনো রকম চ্যালেঞ্জ নেই, আমি টাইমিংয়ের ব্যাপারে ফ্লেক্সিবল, এমনকি আপাতত দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ারও কোনো প্ল্যান নেই। কি দেশ আর কি বিদেশ, কর্মজীবী মা হওয়াটাই যেন আজন্ম পাপ!



চাকরিজীবী মায়েদের চারপাশে এমন একটা বলয় থাকে, যেখানে তাঁকে হরহামেশাই সন্তানের চেয়ে চাকরি বেশি ভালোবাসে এমন অপবাদ যেমন শুনতে হয়, তেমনি আটটা পাঁচটার বেড়াজালে আটকে থাকে বলে অফিসকেও খুশি করতে পারে না।

একজন মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পড়াতে তার বাবা-মায়ের যে পরিমাণ আর্থিক বিনিয়োগ এবং বিভিন্ন ত্যাগ-তিতিক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, তার পরিসমাপ্তি যদি কেবল ভালো বিয়ে দেওয়ার জন্যই হয়, তবে অবশ্য ভিন্ন কথা। আল্লার অশেষ কৃপায় আমার বাবা-মাকে কখনো তাদের আর্থিক বিষয়ে আমার ওপর নির্ভর করতে হয়নি। তাদের মেয়ের একটা নিজস্ব পরিচয় থাকুক এই ব্যাপারটায় তারা খুব মানসিক তৃপ্তি লাভ করেন। একজন মা হিসেবে আমার সন্তানের দেখভাল করা যেমন আমার কর্তব্য ঠিক তেমনি একজন সন্তান হিসেবে আমার বাবা-মায়ের মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিন্ত করাও আমার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে বলে আমি বিশ্বাস করি।

ছোটবেলায় ভাবতাম, বাড়ির সবাই অসুস্থ হয়, কিন্তু মায়ের কখনো অসুখ করে না। এখন বুঝি মায়েদের কখনো অসুস্থ হতে নেই! কর্মজীবী মারা অতি গুরুতর অসুস্থ না হলে তার নিজের জন্য কখনো অফিস থেকে সিক লিভ নেন না। সেটা জমিয়ে রাখেন তার সন্তান বা পরিবারের অন্যদের জন্য। এই সমাজ কি কখনো ভেবেছে, সারা দিনের পরিশ্রমের পর কতটা শারীরিক ও মানসিক শক্তি সঞ্চয় করে রাখলে একজন মানুষ আবার সংসার নামক যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন? আমরা কি কখনো ভেবেছি কর্মজীবী মায়েরা তাঁদের সন্তানসহ পরিবারের সবাইকে কোয়ালিটি ফুল সময় দেওয়ার ব্যাপারে কতটুকু সচেতন থাকেন? কখনো কি ভাবি একজন কর্মজীবী নারী যখন মায়েতে রূপান্তরিত হন, তখন তাঁর চারপাশের একটু সহযোগিতা তাকে তার দক্ষতা ও যোগ্যতা ধরে রাখতে সাহায্য করে? আমার মাথায় হাজারো প্রশ্ন ভিড় জমায়। একজন নারী কি কেবল নিজের বিলাসিতার খরচ জোগানোর জন্য চাকরি করেন? তাঁর পরিবারে কি তিনি কোনো অবদান রাখেন না? তার উপার্জন কি তাঁর স্বামীর ওপর বর্তানো দায়দায়িত্ব কমাতে সাহায্য করে না? দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কি কোনো অবদান রাখে না? একজন কর্মজীবী মা অফিস ও সংসারের মধ্যে সামঞ্জস্য আনয়নের জন্য যে পরিমাণ টাইম ম্যানেজমেন্টের ভেতর দিয়ে যান তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব কি সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই গোছানো ও আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করে না?

সন্তানতো নারীই বহন করে। এর তো কোনো বিকল্প নেই। তবে কেন কর্মজীবী মারা চারপাশের বৈরী হওয়ায় কেবল ঘুরপাক খান? সর্বোপরি, কতটা মানসিক শক্তি, নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস ও সৃষ্টিকর্তার ওপর আস্থা থাকলে একজন মা তার চাকরির পাশাপাশি নিজ সন্তানকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন, তা বুঝতে এই সমাজের আর কত দিন সময় লাগবে?

সেই প্রতীক্ষায় আছি...!
...

ফারজানা আক্তার পান্না: টরন্টো, কানাডা।