খানিকক্ষণ আগেই অফিসের সার্ভিস ম্যানেজার ম্যালকম ফক্স রাকিবকে ফোন দিয়েছিলেন। অফিসে যাওয়ার আগে কেমব্রিজের প্রজেক্টটা রাকিবকে দেখে আসতে বলেছেন তিনি। কেমব্রিজের প্রজেক্টটা নিয়ে এখনো ঝামেলা শেষ হয়নি। আটচল্লিশ মিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট। ফ্লিটচার কোম্পানির ওয়েলিংটনের সেন্ট্রাল অফিস থেকেও লোকজন বারবার আসা যাওয়া করছে।
রাকিব অফিসের উদ্দেশে বের হলে এতক্ষণ বের হয়ে যেত। কিন্তু কেমব্রিজে প্রজেক্টটা দেখতে যাবে বলে সে একটু ধীরস্থিরভাবে বাসা থেকে বের হচ্ছে। তাকে দুপুরের আগে অফিসে গিয়ে রিপোর্ট করলেই হবে।
রাকিব আজ সকালের নাশতা দুধ-সিরিয়াল দিয়ে সেরেছে। এক কাপ ব্ল্যাক কফিও খেয়েছে। এখন ঘড়িতে প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। আজ বাইরে চমৎকার রোদ উঠেছে। সাধারণত শীতকালে এত চমৎকার রোদ ওঠে না। সারা দিন হয় বৃষ্টি থাকে, নয়তো মেঘ ও রোদের খেলা চলে। শীতকালে এমন চমৎকার রোদ উঠলে হ্যামিল্টনের লোকজন ঘুম থেকে উঠেই বলে, আহা, হোয়াট অ্যা বিউটিফুল ডে!
আতিক সারা রাত ট্যাক্সি চালিয়েছে বলে এখন রুমের দরজা বন্ধ করে সে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আতিকের জন্য সুখের খবর, তার স্ত্রীর নিউজিল্যান্ডে আসার ভিসা হয়ে গেছে। আগামী দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে নিউজিল্যান্ড চলে আসবে। তবে এখনো টিকিট কাটেনি। আতিক এখন থেকেই বাসা দেখা শুরু করেছে।
আতিক চলে গেলে বাসাটা আবার ফাঁকা হয়ে যাবে। এতে অবশ্য রাকিবের খুব একটা খারাপ লাগবে না। তার একা থাকার অভ্যাস আছে। প্রায় ছয় বছর ধরেই সে একা থাকছে।
তবে আতিকের পরিবর্তনে রাকিবের বেশ ভালো লাগছে। নিউজিল্যান্ডে কিছু কিছু বাঙালি আছে, যারা সারা জীবনেও শোধরায়নি। বাংলাদেশে বিয়ে করে এসেও এ দেশে পুরোনো গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আগের মতোই মদ ও নারীতে মত্ত থাকে। বাংলাদেশ থেকে বউ আসার পর এ জন্য তাদের অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। মাঝেমধ্যে কারও কারও বউ মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পুলিশ ডেকে, কোর্টকাচারি করে আলাদা হয়ে যায়। স্বামীরা তখন যে মধু সেই যদু হয়ে আগের মতো জীবনযাপন করে। কেউ কেউ আরও বলগাহীন জীবনযাপন করতে অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। সেদিক থেকে আতিক খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে শুধরে নিয়েছে। এখন বউ বলতেই অজ্ঞান। বউ আসার আগেই নিজের জীবনটা খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিয়েছে।
রাকিব ঠিক পৌনে নয়টার দিকে কেমব্রিজের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হলো। বাসার দরজা বন্ধ করে যেই গাড়িতে উঠতে যাবে, ঠিক তখনই তার মোবাইলে নদীর ফোন এল।
রাকিব ফোন ধরে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, নদী, তুমি ঠিক আছ তো?
নদী বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি।
: না মানে, এত সকালে ফোন দিয়েছ? এ সময় তো তুমি কখনো ফোন দাও না।
: একটা জরুরি কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছি।
: জরুরি কথা, কী?
: আসলে জরুরি কথা নয়, জরুরি পরামর্শের জন্য ফোন দিয়েছি। আপনি কি এখন অফিসে?
: না, জাস্ট বাসা থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠছি।
: আজ এত দেরি? এখন প্রায় নয়টা বাজে। আপনার নয়টা থেকে অফিস না?
: এখনো নয়টা বাজেনি। পৌনে নয়টা বাজে।
: ওই একই কথা। আপনি তো সাড়ে আটটার আগেই অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে যান। আজ এত দেরি করছেন যে?
: তুমি ফোন দেবে যে, এ জন্য।
: দেখেন, ফাজলামো করবেন না। এখনো অফিসে যাননি কেন? ছুটি নিয়েছেন?
রাকিব ফোনের এপাশে মৃদু হেসে বলল, না।
নদী জিজ্ঞেস করল, তাহলে?
: আসলে অফিস থেকে খানিকক্ষণ আগে আমাদের অফিসের সার্ভিস ম্যানেজার ফোন দিয়েছিলেন। আমাকে এখন অফিসে যাওয়ার আগে কেমব্রিজের প্রজেক্টটা দেখতে যেতে হবে। দুপুরের আগে আমাকে অফিসে এসে রিপোর্ট করলেই হবে। এখন আমি রিল্যাক্সড। ধীরেস্থিরে কেমব্রিজ যাব। প্রজেক্টে ঘণ্টাখানেক কাটাব। তারপরে আস্তে ধীরে অফিসে আসব।
: আমাকে সঙ্গে নেবেন?
রাকিব এক মুহূর্তের জন্য থেকে কী ভেবে বলল, হ্যাঁ, যেতে পার। ফেরার পথে তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাব।
নদী বলল, না রাকিব ভাই, আমার দশটায় ক্লাস আছে। খুব জরুরি ক্লাস। এর আগে আমাকে একটু আমাদের ইউনিভার্সিটির সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে যেতে হবে।
: তাহলে বললে যে?
: হি হি হি, এমনিই বললাম। আপনার সঙ্গে যেতে পারলে আমার খুব ভালো লাগত। এ মুহূর্তে আমার মনও চাচ্ছে। কিন্তু কী করব! আজকের ক্লাসটা এত ইম্পর্ট্যান্ট।
রাকিব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তার ড্রাইভওয়ে থেকে বের হতে হতে বলল, ঠিক আছে, অসুবিধা নেই। আরেকদিন তোমাকে নিয়ে যাব। অবশ্য এখন প্রজেক্টের কাজ চলছে। দেখার কিছুই নেই।
নদী বলল, স্যার, আপনি মনে হয় ভুলে গেছেন, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনেই পড়ছি। হোক তা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। আমার অনেক কিছুই দেখার আছে।
রাকিব এবার একটু শব্দ করেই হাসল। বলল, হুম ম্যাডাম, আমি আসলেই ভুলে গিয়েছিলাম আপনি একজন ইঞ্জিনিয়ার। আমার ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা চাই।
নদী আবার শব্দ করে হাসল, হি হি, হি হি। বলল, ঠিক আছে। ক্ষমা করে দিলাম।
রাকিব জিজ্ঞেস করল, তুমি না কী একটা জরুরি কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলে?
: জরুরি কথা নয়, আসলে আমার একটা পরামর্শ দরকার।
: কী পরামর্শ বল?
: আমার একটা জব হয়েছে।
: এটা খুব ভালো একটা সংবাদ। তোমার তো একটা জব করার ইচ্ছে, তাই না?
: হ্যাঁ, আমার আসলেই একটা জব করার ইচ্ছে।
: পার্টটাইম তো অবশ্যই?
: ফুলটাইম কে জব দেবে? আমার তো বিশ ঘণ্টা কাজ করার অনুমতি আছে। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের বিশ ঘণ্টা কাজ করার পারমিশন থাকে।
: আমি জানি। এ জন্যই বললাম। আচ্ছা, বাদ দাও, জব পেয়েছ ভালো কথা। আমার কী পরামর্শ চাচ্ছ?
: জবটা কিন্তু নাবিদ ভাইয়া দিয়েছেন।
: নাবিদ ভাই?
: হ্যাঁ, নাবিদ ভাইয়া।
: এতে অসুবিধা কী? তোমার জব দরকার। কে দিল না দিল সেটা ইম্পর্ট্যান্ট না। আর নাবিদ ভাই তো তোমার ভাইয়াই।
নদী বলল, তা ঠিক। কিন্তু সমস্যা হয়েছে, নাবিদ ভাই আমাকে জবটা দিয়েছেন তার দোকানে।
রাকিব এবার একটু চুপ হয়ে গেল। কিন্তু পর মুহূর্তে কী ভেবে জিজ্ঞেস করল, তার দোকানে কীভাবে?
: ওই তো, রোববারে তার দোকান বন্ধ থাকে না? সেদিন তিনি নতুন করে দোকান খোলা রাখতে চাচ্ছেন। রোববারে পুরোটা দিন আমাকে দোকানে বসতে বলছেন। পরে কাজটা শিখে গেলে শনিবারেও দোকানের দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দেবেন।
: ব্যাপারটা মন্দ নয় নদী। তবে তোমার কী মত?
: আমি তো না বুঝেই হ্যাঁ বলে দিয়েছি।
: ভালো করেছ। তোমার নাবিদ ভাইয়া বেশ দায়িত্বশীলের মতোই কাজ করছেন। তিনি বেশ বুদ্ধিমান।
: সেটা কেমন?
: তুমি একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবো, তাহলেই বুঝতে পারবে।
: আহা, আমার মাথায় এখন কোনো কিছু কাজ করছে না। আমি মাকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছি।
: তুমি আবার তোমার মাকে নিয়ে চিন্তিত কেন?
: সেটা পরে বলছি। নাবিদ ভাইয়া দায়িত্বশীল বা বুদ্ধিমানের মতো কী কাজ করেছেন, সেটা বলেন।
: ওই তো, রোববারে তার দোকানটাও খোলা রইল। তোমারও একটা কাজ হলো। তাকেও আর তোমাকে এমনি এমনি টাকাপয়সা দিতে হলো না।
: নাবিদ ভাইয়া এমনি এমনি আমাকে টাকা পয়সা দিতে যাবেন কেন? আর তিনি দিলেই আমি নেব কেন?
: আমি তো এ জন্যই বলেছি। আমি তোমাকে চিনি তো। তুমি মোটেও কারও কাছ থেকে টাকাপয়সার সহযোগিতা নেবে না। যদিও নাবিদ ভাইয়া তোমার ভাইয়া। তবুও নেবে না।
নদী এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, রাকিব ভাই, এ জন্যই আমি আপনাকে এত পছন্দ করি।
রাকিব ফোনের এপাশে মৃদু হাসল। কিছু বলল না। সে গাড়ির বিল্ড-ইন-ব্লু টুথে কথা বলছে। এখানকার ট্র্যাফিক আইন খুব কঠিন। এখানে কেউ গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইল কানে দিয়ে কথা বললে সঙ্গে সঙ্গে তিন শ ষাট ডলার ফাইন। সঙ্গে বেশ কয়েকটা ডি-মেরিট পয়েন্ট যায়।
রাকিবের গাড়িটা এখন কবহ্যাম ড্রাইভ এক্সপ্রেসওয়ে ছেড়ে স্টেট হাইওয়ে ওয়ান ধরে কেমব্রিজের অভিমুখে যাচ্ছে। হ্যামিল্টন থেকে কেমব্রিজের দূরত্ব মাত্র বাইশ কিলোমিটার। কেমব্রিজ নর্থেই তাদের প্রজেক্টটা।
নদী নিজ থেকেই বলল, মাকে নিয়ে একটু সমস্যায় আছি।
রাকিব বলল, হ্যাঁ, তুমি একটু আগে বলছিলে। তোমার মাকে নিয়ে তুমি কী সমস্যায় আছ?
: তিনি চান না, আমি নাবিদ ভাইয়াদের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করি।
: কেন? এতে সমস্যা কী? তিনি তো খুশি হওয়ার কথা। বিদেশে এসে তুমি এমন একজন ভাইয়া পেয়েছ। আপন না হলেও তোমার নাবিদ ভাইয়া তো তোমাদের বংশেরই।
: আপন ভাইয়া না হলেও আমি নাবিদ ভাইয়াকে আপন ভাইয়ার মতোই ভাবছি। আমার কোনো ভাই নেই। এটা হয়তো আবেগের কথা। কিন্তু এটা সত্য।
রাকিব ফোনের এপাশে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমি জানি। গত দুই-তিন সপ্তাহ ধরে তোমার যে হাসিখুশি চেহারাটা দেখছি...!
নদী কথাটা টেনে নিয়ে বলল, দেখেন, আমি কিন্তু বরাবরই হাসিখুশি। আপনিই শুধু মুখ গম্ভীর করে থাকেন। প্রথম প্রথম তো আপনাকে দেখলে আমার মনে মনে ভয় ধরে যেত।
রাকিব এবার বেশ শব্দ করে হাসল, হা হা হা। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, হয়েছে। আর বলতে হবে না। এখন যে কথা বলছি, তুমি তোমার মাকে পজিটিভ ওয়েতে বোঝাও। তিনি খুবই বুদ্ধিমতী।
: তা না হয় বোঝালাম।
: তিনি তোমাকে নাবিদ ভাইদের সঙ্গে মিশতে না করছেন?
নদী বলল, না, তবে তাদের সম্বন্ধে যখনই কথা বলি, তিনি কেমন নিষ্প্রভ হয়ে যান। মেসেঞ্জারে দেখা যায়, মা চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কোনো কথা বলছেন না...! আসলে হয়েছে কী, তিনি তো কখনোই শ্বশুর বাড়ির সংস্পর্শে ছিলেন না। শ্বশুর বাড়ির লোকজন জীবনেও তার খোঁজ খবর নেয়নি। এ জন্যই মনে হয়, তিনি শ্বশুর বাড়ির লোকজনের কথা শুনলে ভয় পান।
রাকিব বলল, আমারও তাই মনে হয়। (ক্রমশ)
মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <mohibulalam.k@gmail,com>
ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: