প্রবাসী টুনটুনির গল্প

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

টুনটুনির জন্মকে তার বাবা–মা তাদের জীবনে সৌভাগ্য হিসেবেই মানে। তাই তাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে টুনটুনির সব ইচ্ছে পূরণের একটা চেষ্টা আছে তাদের মধ্যে। সীমিত আয়ের সংসারে তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় সাধারণত বেশি। তাই আলাদাভাবে সংসারের জন্য বা টুনটুনির ভবিষ্যতের জন্য তাদের সঞ্চয় করার কোনো উপায় নেই দেখে টুনটুনির বাবা তার মাকে বলল, টুনটুনির জন্য একটা মাটির ব্যাংক কিনে আনলে কেমন হয়। তাতে টুনটুনির জন্য খুচরো পয়সাগুলো ফেলে রাখলে বছর শেষে টুনটুনির জন্য কিছু একটা কেনা যাবে। টুনটুনির মা সায় দেওয়ার পর তার বাবা ফুটপাত থেকে একটা মাটির ব্যাংক কিনে আনল আর টুনটুনিকে দেখিয়ে দিল এখন থেকে খুচরো পয়সাগুলো তার মধ্যে ফেলে রাখতে।

প্রথম দু–একদিন দেখিয়ে দেওয়ার পর থেকে টুনটুনি নিজেই সেখানে পয়সা ফেলা শুরু করল। তার বাবা অফিস থেকে ফেরার পরপরই সে তার মানিব্যাগটা নিয়ে সেখানে কোনো খুচরো পয়সা আছে কিনা চেক করে। এক টাকা, দুই টাকা বা পাঁচ টাকার কয়েন পেলেই সেটা সঙ্গে সঙ্গে তার কয়েন বক্সে ফেলে দেয়। মাঝেমধ্যে আবার ঝাঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে সেটা ভরেছে কি না? এ ছাড়া, ঈদ বা কোনো উপলক্ষে পাওয়া সালামির টাকাগুলোও টুনটুনি মাটির ব্যাংকে ফেলা শুরু করল। এভাবে ভালোই চলছিল। এরপর একদিন তারা পরবাসী হয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে এল।

পরবাসে এসেও টুনটুনি তার বাবার কাছে বায়না ধরল তাকে একটা ব্যাংক কিনে দেওয়ার জন্য। তার বাবা তন্ন তন্ন করে সব দোকান খুঁজল। কিন্তু কোনো মাটির ব্যাংক পেল না। হঠাৎ একদিন একটা সস্তার দোকানে ঢুকে অন্য কিছু জিনিসপত্র কেনার সময় দেখল গোলাকৃতি টিনের গায়ে ডলারের ছবি দেওয়া। সেটা হাতে নিয়ে গিয়ে কাউন্টারে বসা দোকানিকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানালেন, এগুলো কয়েন বক্স। পাশে দাঁড়ানো টুনটুনির দিকে দেখিয়ে বললেন, এগুলো তুমি তোমার মেয়ের জন্য কয়েন জমাতে পারো।

টুনটুনির বাবা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। তখনই একটা কয়েন বক্স কিনে নিয়ে বাসায় চলে এল। তারপর থেকেই টুনটুনি আবার দেশের মতো করে তাতে কয়েন ফেলা শুরু করল। তার বাবা অফিস থেকে ফিরলেই সে তার বাবার ওয়ালেট হাতে নিয়ে চেক করে তাতে কোনো কয়েন আছে কি না? পাঁচ সেন্ট, দশ সেন্ট, বিশ সেন্ট, পঞ্চাশ সেন্ট, এক ডলার, দুই ডলার যা পায়, সবই সে কয়েন বক্সে ফেলে দেয়।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এভাবেই চলছিল। প্রথম বছর শেষে যে ডলারগুলো কয়েন বক্সে জমা হলো, সেগুলো ক্রিসমাসের ছুটির সময় কিডস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে জমা করে এল। সেইসঙ্গে টুনটুনির ভাইয়ের জন্য তার বাবা কিডস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিল আর টুনটুনিকে বলল, এখন থেকে তুমি ব্যাংকেও ডলার রাখতে পারবে। শুনে টুনটুনি বলল, বাবা প্রতি বুধবার আমাদের স্কুলে ব্যাংকের লোকেরা আসে টাকা জমা নিতে, আমি ওদের কাছে টাকা জমা দেব তাহলে। এরপর থেকে কয়েন বক্সে টাকা ফেলার পাশাপাশি সে সামান্য কিছু ডলার স্কুলেও জমা দিতে শুরু করল।

গত বছর ব্যস্ততার কারণে টুনটুনির কয়েন বক্সের জমানো ডলারগুলো ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়নি। তাই কয়েন বক্সটা বেশ ভারী হয়ে গেছে দেখে একদিন টুনটুনির বাবা বলল, এবার নিশ্চয় গতবারের তুলনায় দ্বিগুণ ডলার জমেছে। একদিন গিয়ে ডলারগুলো ব্যাংকে জমা দিয়ে আসব। এ সময় হঠাৎ টুনটুনির মা একটা কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়াতে সংসারে আয় বাড়ার পাশাপাশি এককালীন কিছু খরচও যুক্ত হলো। সেই খরচের জোগান দিতে গিয়ে টুনটুনির বাবা–মায়ের অবস্থা জেরবার। তখন টুনটুনির মা বলল, আচ্ছা টুনটুনির কয়েন বক্সে নিশ্চয় কিছু ডলার জমা হয়েছে। সেখান থেকে আমরা সাহায্য নিতে পারি।

প্রবাসে সবার আয় ব্যয়ই সীমিত। তাই কারও কাছ থেকে ধার পাওয়াও মুশকিল। আর ইতিমধ্যেই একজনের কাছ ধার নেওয়া হয়েছে। আর কারও কাছ থেকে ধার চাওয়া যাবে না। ধার চাইতে গেলে যে কী পরিমাণ লজ্জা লাগে তা যিনি ধার চান তিনিই জানেন। সমস্ত আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে ধার চাইতে হয়। আর ধার চাইতেও হয় লোক বুঝে। এমন একজনের কাছে, যিনি আপনার এই অসহায়ত্বের কোনো সুযোগ নেবেন না বা সেটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আর দশজনকে বলে বেড়াবেন না। এমনিতেই টুনটুনির বাবার গায়ের কুচকুচে কালো রঙের কারণে সমাজের এক ধরনের মানুষ শুরুতেই তাদের অশিক্ষিত চাষা রিফিউজির খাতায় ফেলে দিয়ে ঠাট্টা তামাশা করে। অবশ্য এগুলো দেখে টুনটুনির বাবা শুধু মনে মনে হাসে আর বলে হায়রে বাঙালি, দুই দিনের এই দুনিয়া, কীসের তোর এত বাহাদুরি। কিন্তু যখন দেখে সেই একইভাবে টুনটুনিকেও বিচার করা হচ্ছে অন্য বাচ্চাদের তুলনায় আলাদাভাবে তখন সে মুষড়ে পড়ে।

যা হোক, টুনটুনিকে তার কয়েন বক্সের টাকার কথা বলাতেই সে একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। হয়তোবা সেও বুঝেছিল বাবা–মায়ের এখন এই টাকা দরকার। তারপর টুনটুনির কয়েন বক্স খুলে সেখান থেকে নোটের ডলারগুলো নেওয়া হলো, যেগুলো সে বিভিন্ন উপলক্ষে সালামি হিসেবে পেয়েছিল। পরের সপ্তাহে দেখা গেল আরও কিছু ডলার দরকার তখন দুই ডলারের কয়েনগুলো নিয়ে নেওয়া হলো। এর পরেরবার নিয়ে নেওয়া হলো এক ডলারের কয়েনগুলো। এখন কয়েন বক্সে পড়ে আছে শুধু পাঁচ সেন্ট, দশ সেন্ট, বিশ সেন্ট আর পঞ্চাশ সেন্টের কয়েনগুলো। অবশ্য প্রতিবারই তাকে আশ্বাস দেওয়া হলো যে, তার কয়েন বক্স থেকে নেওয়া টাকার চেয়ে বেশি টাকা ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু কবে সেটা আর বলা হলো না। এভাবেই টুনটুনির টাকার শ্রাদ্ধ করে চলেছে তার বাবা–মা মিলে।

সেই কয়েন খরচ করা নিয়েও দেখা দিল বিশাল ঝক্কি। দোকানে গিয়ে সওদাপাতি কিনে কয়েন দিতে গেলে নিজেরদের দারিদ্র্য প্রকাশ পায়। বিশেষ করে টুনটুনির মা কয়েন নিয়ে বাজারে যেতে খুবই লজ্জা পাচ্ছিলেন। সেটা দেখে টুনটুনির বাবা বলল, শোন তুমি বাঙালিদের দোকানে যেও না, তাহলেই হবে। অন্যদের তুমি কয়েন দিলে সেটা নিয়ে তারা মাথা ঘামাবে না। কিন্তু বাঙালিদের কাছে তুমি কয়েন দিয়ে কিছু কিনলে তোমাকে সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার মানুষ ভেবে বসবে এবং এরপর যতবার দেখা হবে এই প্রসঙ্গ তুলে খোঁচা দেবে। তবুও টুনটুনির মায়ের লজ্জা কাটেনি। আর টুনটুনির বাবা বহাল তবিয়তে কয়েন দিয়ে বাজারঘাট করে বেড়াচ্ছে। কারণ সে এগুলোকে পাত্তা দেয় না। তার একটাই কথা কে কী বলল তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। কারণ আমিতো আর চুরি বা ভিক্ষা করে এটা উপার্জন করিনি। গায়ের রক্ত পানি করে এই কয়েনগুলো আয় করেছি আর আমার মেয়ে টুনটুনি অত্যন্ত যত্ন সহকারে সেগুলো জমিয়েছিল।

গল্পের টুনটুনি রাজার ভান্ডারের একটা মোহর নিয়ে বড়াই করেছিল, রাজার ঘরে যে ধন আছে, আমার ঘরে সে ধন আছে। আর বাস্তবের টুনটুনিরা তাদের মোহরের (কয়েনের) বড়াই করা তো দূরে থাক সেগুলো নিজের কাজেও লাগাতে পারে না। তবে এতে টুনটুনির মনে কোনো খেদ নেই। সে এই বয়সেই বুঝে নিয়েছে, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের জীবন অনেকটা জোয়ার ভাটার মতো। এই সচ্ছলতা তো এই অভাব। তাই সে তার মোহরের মায়া অনেক আগেই ত্যাগ করেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে বাস্তবের টুনটুনি গল্পের টুনটুনির গল্পটা পড়েছে। কিন্তু গল্পের টুনটুনির মতো মোহরের বড়াই করে সে তার বাবা মায়ের নাক কাটাতে চাইনি। বরং সে মোহরের মায়া ত্যাগ করে তার বাবা মায়ের সম্মান বাঁচিয়ে চলেছে।

লেখকের ইমেইল: <[email protected]>