স্বপ্ন বাক্সবন্দী করার গল্প

ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডিলেড। সংগৃহীত
ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডিলেড। সংগৃহীত

শীতের সকালে শিশির ভেজা রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাওয়া ছিল ছোটবেলার গল্প। নদীতে নৌকা চালানো, মধ্য দুপুরের খেলাধুলা আর মায়ের হাতের অসাধারণ মজাদার খাবার এবং বকুনি ছিল সেই দিনগুলোর নিয়মিত সাথি। এভাবে গ্রাম থেকে শহর, শহর মহানগরী, মহানগরী থেকে উন্নত দুনিয়ায় চলে আসা। সৃষ্টিশীল মানুষকে অবশ্যই ভাবুক, খেয়ালি আর স্বপ্নবাজ হতে হয়। ধীরে ধীরে তৈরি করতে হয় পরিবেশ। আর শতচেষ্টার মাধ্যমে স্বপ্নকে করতে হয় বাক্সবন্দী। এ হলো জীবনের শুরুর কথা। আর স্বপ্নগুলো দেখতে শুরু করেছিলাম বাবার কাছ থেকেই। হাতে হাত রেখে বাজারে যাওয়া আর নানান ধরনের গল্প, যা স্বপ্ন দেখিয়েছিল সে সময়। তারপর ভালো কিছু বন্ধু সে স্বপ্নকে করেছিল ত্বরিত। এভাবে না বুঝে স্বপ্নকে সামনে রেখে এগিয়ে চলা। এখানেও দেখা মিলেছে কিছু স্বপ্নবাজ বন্ধুর। বন্ধুত্ব যদি একটি চিত্রনাট্যের সঙ্গে কল্পনা করি সেই চিত্রনাট্যের সব সংলাপ মানুষের জীবনে বন্ধু। কিন্তু সবগুলো সংলাপ সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না। কিছু কিছু সংলাপ যেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় তেমনি হয়ে যায় সময়ের সাক্ষী।

মানুষের মনই শ্রেষ্ঠ। যা হচ্ছে জ্ঞানের উৎস। তাই জালাল উদ্দিন রুমি মনকে নিয়ে লিখেছেন:

‘মিথ্যা শোনেনি ভাই।
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কাবা নাই।’

মনকে যার দ্বারা অতীত ও ভবিষ্যৎ সীমারেখা টানা যায়। যা দিয়ে মিলিয়ে নেওয়া বাংলাদেশের আর পশ্চিমা দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে। মানুষের জীবন ততক্ষণ সজীব যতক্ষণ স্বপ্ন দ্বারা বেষ্টিত হয়। স্থির জীবনে স্বপ্ন থাকে না। কারণ স্বপ্ন মানে অস্থিরতা। নিজেকে বদলে আরেক রূপে নিয়ে যাওয়া। স্বপ্ন পূরণের অন্যতম জায়গা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। কিশোর বয়সের শেষলগ্নে প্রবেশ করি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাসে। খেয়ালি ভাবেই উঠে পড়ি হলে, জুটে যায় বন্ধু। ক্লাসরুম, চায়ের দোকান, লাইব্রেরি থাকে সেসময়ের শিক্ষার উৎস।

এখন আছি দ্য ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডিলেড, সাউথ অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় এটি। এর আছে পাঁচটি শাখা। সিটি ক্যাম্পাসের অবস্থান শহরে। যা তৃতীয় পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫০ বছরের আগের ক্যাম্পাস। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ক্যাম্পাস পাশাপাশি। একটা সিটি ক্যাম্পাস, অন্যটি হোয়াইট ক্যাম্পাস। সিটি ক্যাম্পাস শহরতলি কেন্দ্রে অবস্থিত। অন্যটির অবস্থান শহরের পাশে সমুদ্রের কিনারায়। তবে ভালো লাগবে বিশ্ববিদ্যালয় দেখে।

সুন্দর ভবনগুলোর আছে চটকদার নাম। দুটি বিশ্ববিদ্যালয় দুইভাবে দুইদিকে গবেষণায় মনযোগ দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারেই বিভিন্ন ভাস্কর্য। শুরুতেই যারা অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন এগুলো তাদের ভাস্কর্য। সিটি ক্যাম্পাস আছে বিজ্ঞান অনুষদ, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাথ অনুষদ ও মেডিকেল অনুষদ। এ ছাড়া আছে ইনস্টিটিউট। ভবনের আছে নতুন আর পুরানের আভিজাত্য। তবে নতুন ভবনগুলো তৈরি হয়েছে কাচ দিয়ে। তাই সহজেই রুম থেকে দেখা যায় নীল আকাশ। ভাবি মাঝে মাঝে আকাশ এত নীল কেন। রাতের আকাশে দেখা যায় চাঁদ। মনে হয় কে যেন ধরে রেখেছে চাঁদকে।

ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডিলেড। সংগৃহীত
ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডিলেড। সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ইউনিয়ন হাউস। যার তুলনা চলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সঙ্গে। সেখানে আছে বার, জিমনেসিয়াম, মসজিদ আর সিনেমা হল। যার যা ভালো লাগে সে সেখানে যাচ্ছে। আছে পছন্দের স্বাধীনতা। নেই নারী পুরুষের কোনো ভেদাভেদ। এর পাশে আছে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি। আছে গ্র্যাজুয়েট সেন্টার। ভর্তি কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে স্কলারশিপ, ছাত্রদের কাজের মূল্যায়ন সবই করে থাকে এরা। দুই ধরনের স্কলারশিপের অফার করে বাইরের দেশের ছাত্রদের জন্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে বড় খেলার মাঠ। সন্ধ্যার পর বিভিন্ন খেলাধুলা মেতে ওঠে সবাই। আরও আছে ইউনিভার্সিটির হল। যা দেখতে অনেকটা পাঁচতারকা হোটেলের মতো।

আছে হাব সেন্ট্রাল। সেখানে থাকে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট সাপোর্ট সেন্টার। ছাত্ররা সেখানে গিয়ে যেকোনো সমস্যার কথা জানাতে পারেন। নানান দেশের ছাত্ররা এখানে জড়ো হয়েছেন। আছেন বাংলাদেশেরও অনেক ছাত্র। বিভিন্ন বিষয়ে তারা করছেন অধ্যয়ন। এদের মধ্যে বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রই বেশি। যাদের কথা বলছি তারা সবাই মাস্টার্স অথবা পিএইচডি ছাত্র। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জড়ো হয়ে সবাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মিলিত হয়েছেন।

দেশীয় মানুষ হিসেবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে গড়ে উঠেছে বন্ধুত্ব। অনেকের সঙ্গে আছে বয়সের ব্যবধান। তারপরও গল্প আড্ডায় ভুলে যান সব। বন্ধুত্বের ফাঁকে আছে কিছু ব্যক্তিগত নিয়মিত কাজ। আর তা হলো ঘুম থেকে ওঠা, তারপরে বাস বা ট্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া। সময় পেলে দুপুরের খাবার একসঙ্গে খাওয়া অথবা বিকেলের চা বা কফির আয়োজন একটি নিয়মিত ঘটনা। গবেষণার ফাঁকে ফাঁকে জমে ওঠে আড্ডা নদীর তীরে। তারপরে মেতে উঠত গবেষণা সবশেষ আলোচনা—দেশ, সমাজ আর রাজনীতি তথা পরিবার। এখানে বন্ধুরা একটু অবসর পেলেই বিভিন্ন টুর আর বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন বৈশাখ ঈদ পরবর্তী খাওয়া দাওয়া মেতে উঠি। বেশির ভাগ সময়ে বিবাহিতরা অবিবাহিতদের খাওয়ায়ন। স্বপ্নকে এভাবে বাক্সবন্দী করার জন্য হাজারো তরুণ এখানে গবেষণা করে চলেছে। এ নেশা নতুন কিছু খোঁজার আড্ডা গল্পে মিল এভাবে সময়গুলো ঝরে, ঝরছে, ঝরুকই না।