সবুজ মেঘের ছায়া-এগারো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নদীর কথা ভাবতে ভাবতে নাবিদ কফির কাপে শেষ চুমুক দিল। ভাবল, যাক শেষ পর্যন্ত নদী রাজি হয়েছে। এমনিতে তো জুঁইয়ের কারণে নদীর জন্য সরাসরি কিছু করতে পারবে না। নদীকে তার বাসায় রাখতে পারলে তার চেয়ে খুশি আর কেউ হতো না। কিন্তু জুঁই কিছুতেই সেটা হতে দেবে না। জুঁই যে খারাপ মেয়ে তা নয়। স্ত্রী হিসেবে যথেষ্ট ভালো। সম্পর্কের টানাপোড়েন নেই। কিন্তু তার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়। এ ছাড়া, জুঁই কোনো ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চায়। সংসারে অহেতুক ঝামেলার ব্যাপারে সে বরাবরই খুব শঙ্কিত থাকে।

রাজীব আহসান চৌধুরীর কাছে নাবিদের বেশ কিছু ঋণ আছে। এই ঋণটা আর্থিক বা পারিবারিক নয়। মনের ঋণ। নাবিদ নদীর মাধ্যমে সেই ঋণ কিছুটা শোধ করতে চায়। তবে নদী তার দোকানে কাজ করতে রাজি হয়েছে, সেটা কোনো ঋণ শোধ নয়। একধরনের ভালো লাগা। নাবিদ সেই ভালো লাগা নিয়েই কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।

এখন পর্যন্ত দোকানে আর কোনো কাস্টমার আসেনি। মাঝেমধ্যে দোকানের এই কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নাবিদের বিরক্তি ধরে যায়। কখনো সে ওয়াইকাটো টাইমস নিউজ পেপার বা নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড পড়ে। কখনো কোনো ম্যাগাজিন হাতে নেয়। টাইম ম্যাগাজিনটা তার পড়তে ভালো লাগে।

তিনটার দিকে মৌনতাকে নিয়ে জুঁই দোকানে এলে তখন নাবিদের সময়টা ভালো কাটে। তবে বেশির ভাগ সময় জুঁই দোকানে এলে নাবিদ বাসায় চলে যায়। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নেয় বা বাসার পেছনে বাগানে কাজ করে। কখনো সে ব্যাংকিং ও অফিশিয়াল কাজগুলো সেরে নেয়। বিকেলে সে আবার দোকানে ফিরে আসে। রাতে দোকান বন্ধ করা অবধি সে দোকানে থাকে।

নাবিদ আরও কিছুক্ষণ কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থেকে আবার অফিস রুমে চলে এল। কম্পিউটার অন করে সে প্রথম ইমেইল চেক করল। অ্যাকাউন্ট্যান্ট প্রিয়া পাতিলের একটা ইমেইল। আগামী সপ্তাহে সময় করে তার সঙ্গে বসতে হবে। কোকাকোলা কোম্পানির হ্যামিল্টন ব্রাঞ্চ থেকে ইমেইলে একটা ইনভয়েস পাঠিয়েছে। একটা হোম-বিজনেসের ইমেইল।

অ্যাকাউন্ট্যান্ট প্রিয়া পাতিলকে সরাসরি ফোন দেবে বলে নাবিদ ইমেইলের কোনো উত্তর দিল না। কোকাকোলা কোম্পানির ইমেইলের দুই লাইন টাইপ করে একটা রিপ্লাই দিয়ে দিল। ফেসবুক খুলে এলোমেলো কিছু ছবি দেখল। তারপর সে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর পাতা খুলল। বাংলাদেশের পত্রিকায় সেই গতানুগতিক খবর। সরকারের খবরদারি। বিরোধী দলের হরতাল। ক্রিকেটে টেস্টে বাংলাদেশের হার। নায়িকা জইতুনের আবার বিয়ে।

এরই মধ্যে দোকানের সামনের দরজায় শব্দ হলো-টুং টুং, টুং টুং। নাবিদ সিসি টিভিতে দেখল, একজন নারী কাস্টমার। নাবিদ কম্পিউটার অন রেখেই কাউন্টারে এসে দাঁড়াল। এবারের কাস্টমার দুধ ও ব্রেডের কাস্টমার। দুটো দুধের কন্টেইনার ছয় ডলার ও একটা ব্রেড দুই ডলার। সুপারমার্কেট থেকে কিনলে দুটো দুধের কন্টেইনারের দাম পড়ত চার ডলার। ব্রেডের দাম পড়ত এক ডলার। তারপরও এ সব কনভিনিয়েন্স স্টোর বা মিনিমার্টগুলোতে কাস্টমাররা আসেন।

কাস্টমার চলে যেতেই নাবিদ আবার তার অফিস রুমে ফিরে এল। একবার ভাবল কম্পিউটারে গত সপ্তাহের হিসাবটা করে রাখবে। অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাছে তাকে সেই হিসাব নিয়ে বসতে হয়। কিন্তু তার এ মুহূর্তে এসব হিসাব-কিতাব করতে ইচ্ছে হলো না। এ সপ্তাহের যেকোনো একদিন করলেই হবে। অ্যাকাউন্ট্যান্টের সঙ্গে তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো আগামী সপ্তাহে।

নাবিদ কম্পিউটার বন্ধ করে দিল। শরীরের আড়মোড়া ভেঙে নাবিদ অফিস রুম ছেড়ে ধীর পায়ে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে সে কী ভেবে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ম্যাগাজিন র‍্যাক থেকে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিল। বিনোদন ম্যাগাজিন। প্রিন্স উইলিয়াম ও কেট মিডলটনের কাহিনি। বিষণ্ন কেট মিডলটন। কিছুদিন আগেই ব্রিটিশ রাজ পরিবারে আরেকটা বিয়ে হয়েছে। প্রিন্স হ্যারি ও মেগানের বিয়ে। এ নিয়ে কেট মিডলটন বেশ বিষণ্ন। রাজ পরিবারে নিজের প্রাধান্য বিস্তার করা নিয়ে কথা।

নাবিদ জানে এসব আজগুবি খবর। হলিউড অভিনেতা ব্র্যাড পিট ও অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মনোবিচ্ছেদের গল্প গত দশ বছর ধরেই চলছে। ব্রিটনি স্পিয়ার্সের ওজন বাড়ানো-কমানোর কিছু অর্ধনগ্ন ছবি ম্যাগাজিনে পাঁচ বছর ধরেই দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও এ সব ম্যাগাজিনের বেশ কাটতি। এসব ম্যাগাজিন এখানকার লোকজন হরহামেশা কিনছেন। দোকানদারেরাও এসব ম্যাগাজিন বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু পাশে পড়ে থাকা টাইম ম্যাগাজিন বা রিডার ডাইজেস্ট সপ্তাহে পাঁচ কপিও বিক্রি হচ্ছে না।

দোকানে কাস্টমার না থাকলে সময়টা যেন কাটতেই চায় না। নাবিদ কতক্ষণ অযথাই শেলফের এটা-সেটা গোছাল। কিছুক্ষণের জন্য সে দোকানের বাইরে এসেও দাঁড়াল। আজ বাইরে রোদটা উঠেছে বেশ। রাস্তার মাঝখানে বছর তিনেক আগে সিটি কাউন্সিল সারি সারি করে ম্যাপল গাছ লাগিয়েছিল। এরই মধ্যে ম্যাপল গাছগুলো বেশ বেড়ে উঠেছে। শীতের হাওয়ায় এখন ম্যাপল গাছের পাতা এরই মধ্যে প্রায় সব ঝরে গেছে। তারপরও সোনালি রং ধরা কিছু পাতা গাছের ডালে আটকে আছে। তিরাপা রোডটা অকল্যান্ড যাওয়া-আসার সংযোগ রাস্তা বলে সচরাচর এ পথ ধরে গাড়ির আসা-যাওয়া বেশি।

নাবিদের দোকানের পাশে একটা টেকওয়ে ফার্স্ট ফুডের রেস্টুরেন্ট। চাইনিজ টেকওয়ে। এখন রেস্টুরেন্টটা বন্ধ। এগারোটার দিকে খুলবে। রাত দশটা পর্যন্ত এই চাইনিজ ফার্স্ট ফুড রেস্টুরেন্টটা খোলা থাকে। নাবিদ ও জুঁইয়ের সঙ্গে এই চাইনিজ ফার্স্ট ফুড রেস্টুরেন্টের মালিক ও মালিকের স্ত্রীর বেশ ভালো সম্পর্ক। প্রায় এক যুগ বসবাস করে ইংরেজি ভাষাটা পুরোপুরি রপ্ত করতে না পারলেও তারা ফার্স্ট ফুড রেস্টুরেন্টটা বেশ ভালোভাবেই চালাচ্ছেন।

এসব চাইনিজ টেকওয়ে বা ফার্স্ট ফুডের রেস্টুরেন্ট আজকাল নিউজিল্যান্ডে ছোটবড় শহরের প্রতিটা শপিং সেন্টার, প্রতিটা সাবার্ব, প্রতিটা বাস ও রেলওয়ে স্টেশনসহ আনাচকানাচে গড়ে উঠেছে। নাবিদ মাঝেমধ্যে ভাবে, এভাবে একদিন চাইনিজ জাতিরা ছোট ছোট ব্যবসা স্থাপন করে সারা বিশ্বটা দখল করবে। এমনিতেই ইউরোপের সবগুলো দেশ, পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিটা দেশে চাইনিজরা ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট বা ব্যবসা স্থাপন করে যে হারে এগোচ্ছে, তাতে আগামী চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তারা শুধু পশ্চিমা বিশ্বকে নয়, সারা বিশ্বকেই ছাড়িয়ে যাবে।

চাইনিজ ফার্স্ট ফুড রেস্টুরেন্টটার পর একটা টাট্টুর দোকান। তারপর সেকেন্ড হ্যান্ড দোকান স্যালভেশন আর্মি। সারা বিশ্বের আর্ত মানুষের সেবার জন্য এই দোকানটা খোলা হয়েছে। মানুষের ফেলে দেওয়া পুরোনো কাপড়গুলো ধোয়। পুরোনো জুতা, ব্যাগ, বইপত্র ও পুরোনো আসবাবপত্রগুলো মেরামত করে। সেগুলো দোকানে এনে সাজিয়ে রেখে বিক্রি করে। এই বিক্রির টাকা দিয়ে তারা সারা বিশ্বের দুস্থদের সহায়তা করে। নিউজিল্যান্ডের প্রায় প্রতিটা শহরে চারটা-পাঁচটা করে এই স্যালভেশন আর্মি বা হসপিস নামের দোকানগুলো বেশ বড় পরিসরে আছে। এসব দোকানগুলোতে যারা কাজ করেন, তারা সারা দিন কাজ করেও একটা পয়সা নেন না। তারা সবাই ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেন।

এ সব দোকানগুলোর সামনে গেলে নাবিদের মাথা আপনাআপনি নত হয়ে আসে। এ দোকানগুলোতে পুরোনো জামাকাপড়, জুতা-ব্যাগ বা বাসার আসবাবপত্র এক-দুই বা পাঁচ-দশ ডলারে বিক্রি করে এবং দোকানের মানুষগুলো বিনা পারিশ্রমিকে সারা দিন কাজ করে বৃহৎ অঙ্কের ডলার জমিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর গরিবদের সেবার জন্য পাঠায়। সেই টাকা সেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কিছু প্রভাবশালীরা মেরে দেয় বা চুরি করে। গরিবদের কাছে না পৌঁছিয়ে নিজেদের কাজে লাগায়!

একজন কাস্টমার দোকানে ঢুকতে দেখে নাবিদও তাড়াতাড়ি দোকানে ঢুকে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াল। এবারের কাস্টমারটা দুধ ও ব্রেড কিনতে এসেছেন। সঙ্গে এক প্যাকেট সিগারেট।

কাস্টমারটা চলে যেতেই নাবিদ কাউন্টারের পেছনে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। কাউন্টারের একটা উঁচু চেয়ার আছে। নাবিদ কখনো সেই চেয়ারটাতে বসে না। সচরাচর সে দাঁড়িয়ে থাকে। মিসেস মার্গারেট ঢুকলেন তখনই।

নাবিদ মার্গারেটকে দেখে একটা দিঘল হাসি দিল। বলল, গুড মর্নিং।

মার্গারেট তার কুঁচকানো গালে হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, গুড মর্নিং।

নাবিদ জিজ্ঞেস করল, আজ এত সকালে যে?

মার্গারেট বললেন, হ্যাঁ, সকালের নাশতা করতে গিয়ে দেখি ব্রেড নেই। ডিমের ট্রেতে ডিম নেই। কন্টেইনারে দুধ নেই।

: ও, আপনার নাশতার তো তাহলে কিছুই ছিল না।

: হ্যাঁ, এ জন্য তো এই সকালে তোমার দোকানে এলাম।

: তাহলে এক কাজ করুন। আপনি আমার এখানে নাশতাটা সেরে নিন। অফিস রুমের ফ্রিজে টুনা ফিশের ক্যান আছে। ফ্রিজের পাশেই বেঞ্চটপের ওপর ব্রেড আছে। আপনি নাশতা সারতে সারতে আমি আপনাকে এক কাপ কফি বানিয়ে দিই।

মার্গারেট হাসলেন। বেশ আন্তরিক হাসি। বললেন, না না, অসুবিধা নেই। তোমাকে বলার জন্য ধন্যবাদ। আমি বাসায় গিয়েই নাশতা করব। আসলে আমার বাসায় কিছুক্ষণের মধ্যে একজন গেস্ট আসবে। আমরা এক সঙ্গে নাশতা করব। তারপর আমরা এক সঙ্গে আজ দুপুরের শো-তে মুভি দেখতে যাব।

নাবিদ জিজ্ঞেস করল, মুভি! কী মুভি?

: গন উইথ দ্য উইন্ড।

: সেটা তো বেশ পুরোনো মুভি।

: পুরোনো মানে, প্রায় আটাত্তর বছরের পুরোনো মুভি। আমার বয়সের সমান সমান বয়স। এই মুভিটার পেছনে কিছু চমৎকার কাহিনি আছে। আমার জীবনের কাহিনি।

নাবিদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার জীবনের কাহিনি?

মার্গারেট বললেন, হ্যাঁ।

: সেটা কী রকম?

: এই মুভিটা যেদিন নিউজিল্যান্ডে প্রথম মুক্তি পায় সেদিন ছিল ১৭ জানুয়ারি, ১৯৪০ সাল। আমার মা এর আগেই উপন্যাসটা পড়েছিলেন। উপন্যাসটার নামও গন উইথ দ্য উইন্ড। উপন্যাসটার লেখিকা ছিলেন মার্গারেট মিশেল। তিনি উপন্যাসটা লিখেছিলেন ১৯৩৬ সালে। আর মুভিটা বানানো শুরু হয় ১৯৩৯ সালে। তা মুভিটা নিউজিল্যান্ডে মুক্তি পাওয়ার প্রথম দিনেই মা বাবাকে নিয়ে মুভিটা দেখতে যান। আমি তখন মায়ের পেটে।

নাবিদ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তারপর?

মার্গারেট একটু হাসলেন। বললেন, তারপর আর কী, মায়ের তখনো ডেলিভারির ডেট হয়নি। আরও কিছুদিন বাকি ছিল। কিন্তু মুভি দেখতে গিয়ে বাবা-মা পুরো মুভিটা দেখতে পারেননি। বোঝই তো, তিন ঘণ্টা পঁচিশ মিনিটের মুভি। এরই মধ্যে মার ব্যথা ওঠে। হাসপাতালে যেতে যেতেই আমার জন্ম। এ জন্যই আমার জন্মের পর মা আমার নাম রাখেন, মার্গারেট মিশেল। গন উইথ দ্য উইন্ড উপন্যাসটার লেখিকা মার্গারেট মিশেলের নামে নাম।

নাবিদও হাসল। বলল, চমৎকার তো!

মার্গারেট বললেন, শুধু কী চমৎকার, খুবই চমৎকার। পুরো কাহিনি তো তোমাকে এখনো বলা শেষ হয়নি। আমার জীবনের আরও কিছু চমৎকার কাহিনি ঘটেছিল এই মুভিটাকে কেন্দ্র করে। আমার প্রথম প্রেম হয় এই মুভিটা দেখতে গিয়েই। যে যুবকটার সঙ্গে আমার প্রেম হয় তার নাম আর্থার ব্রুক। সেই আর্থার ব্রুক সিনেমা হলে গিয়ে আমার পাশের সিটে বসেছিল। সেটা ছিল ১৯৫৮ সালে।

: বলেন কী!

: হ্যাঁ, শুধু কী তাই, আমার ব্যবসার জীবনের প্রথম ক্লায়েন্টের সঙ্গে আমি এই মুভিটা দেখতে যাই। সেটা ১৯৬৩ সালে। ক্লায়েন্টই আমাকে অফার করেছিল মুভিটা দেখতে। আর সেই ক্লায়েন্ট ছিল ইন্ডিয়ান ক্লায়েন্ট। বিজনেস ট্যুরে নিউজিল্যান্ডে এসেছিল।

: এত কিছু!

: আর বলো না, আমার স্বামীর সঙ্গে প্রথম দেখা ও কথা হয় এই মুভিটা দেখতে গিয়েই। সেটা ১৯৮৫ সাল ছিল। মুভিটা দেখার পর সিনেমা হল থেকে বের হয়ে আমরা ডিনারে যাই। এর কিছুদিন পরই আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই। তারপর দীর্ঘ বিশ বছরের বিবাহিত জীবন। বলেই মার্গারেট কোথায় যেন ক্ষয়ে গেলেন।

নাবিদ জানে, মিসেস মার্গারটের স্বামী প্রায় তেরো বছর আগে ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা গেছেন। তার মুখেই স্বামীর গল্প বহুবার শুনেছে।

মার্গারেট ক্ষয়ে যাওয়ার দৃষ্টি টেনে হাসলেন। তার কৃত্রিম দাঁতগুলো দোকানের ভেতরের নরম আলোতেও ঝিলিক মারল। তিনি বললেন, নাবিদ, আরও কী ইন্টারেস্টিং জানো, আজ যে গেস্ট আমার বাসায় আসবে, সে আর্থার ব্রুক।

নাবিদ জিজ্ঞেস করল, আর্থার ব্রুক?

মার্গারেট বললেন, ওই যে, যাকে নিয়ে আমি প্রথম যৌবনে গন উইথ দ্য উইন্ড মুভিটা দেখতে গিয়েছিলাম। সেই যুবক। আমার প্রথম প্রেমিক। এখন অবশ্য সে আর যুবক নেই। বুড়ো হাবড়া। হি হি, হি হি!

নাবিদ মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে বলল, ও, তাই? তার সঙ্গে কীভাবে আবার দেখা হলো?

মার্গারেট বললেন, সে এক ইন্টারেস্টিং ঘটনা। আর্থার ব্রুকের সঙ্গে বিরহ শুরু হয় সেই ১৯৬১ সালে, সে যখন জাহাজের চাকরি নিয়ে নিউজিল্যান্ড ছেড়ে চলে যায়। পরে সে অস্ট্রেলিয়াতে সেটেল্ড হয়। আমি অবশ্য এর কিছুই জানতাম না। গত শুক্রবারে আমি ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে মিলার্সে গিয়েছিলাম কিছু শীতের কাপড় কিনতে। মিলার্সের সামনে দেখি এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বৃদ্ধকে বেশ চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। আমি কাছে গিয়ে ভালো করে তাকাতেই চিনে ফেলি। আরে, এ যে আর্থার ব্রুক!

: বলেন কী! আপনি তাকে দেখেই চিনে ফেললেন?

: আরে, চিনব না, আমার প্রথম প্রেমিক!

: তিনি আপনাকে চিনতে পেরেছিলেন?

: প্রথমে চিনতে পারেনি। পুরুষ মানুষ না! পুরুষ মানুষ সহজে ভুলে যায়। নারীরা ভোলে না। কিন্তু পরিচয় দেওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গেই সে আমাকে চিনতে পারে।

: তিনি কি এখন হ্যামিল্টনে বসবাস করেন?

: না, সিডনিতেই। হ্যামিল্টনে এসেছে তার এক নাতির বিয়েতে।

: আপনারা আজ মুভিটা কোথায় দেখতে যাবেন?

: ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের ফ্লিক থিয়েটারে। আরও মজার ব্যাপার কী দেখ, আর্থার ব্রুকের সঙ্গে দেখা শুক্রবারে। শনিবার থেকেই ফ্লিক থিয়েটারে গন উইথ দ্য উইন্ড মুভিটা দেখানো শুরু করেছে। হোয়াট আ কো-ইনসিডেন্ট! (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1565216