যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন ও নারী জাগরণ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

কিছুদিন আগেই হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন। এবারের এই নির্বাচন বিভিন্ন দিক দিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত রিপাবলিকান পার্টি ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও হাউসে বেশি আসন পেয়েছে ডেমোক্র্যাট। বিরোধী দল হিসেবে এটি বড় ধরনের বিজয়। তবে আজ যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব, সেটি হলো আগের সকল রেকর্ড ভেঙে দিয়ে বিপুলসংখ্যক নারী প্রার্থীর বিজয়। কংগ্রেসে শতকরা ২০ ভাগ, সিনেটে শতকরা ২৩ ভাগ ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে শতকরা ১৯ দশমিক ৩ ভাগ নারী সদস্য আসন পেয়েছেন। এক শর ওপরে নারী প্রার্থী বিভিন্ন পদে জয়লাভ করেছেন।

২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে সুযোগ্য নারী প্রার্থী স্বনামধন্য হিলারি ক্লিনটন যখন পরাজিত হলেন, সেটা অনেকের জন্যই ছিল এক অপ্রত্যাশিত আঘাত। যুক্তরাষ্ট্র যতই উন্নতির শিখরে বসে থাকুক, এ দেশের সাধারণ মানুষ এখনো দেশে নারী রাষ্ট্রপতি নেতৃত্বে বিশ্বাসী নয়। এমনটাই ধারণা হয়ে গিয়েছিল অনেকের। এ দেশের বিপুলসংখ্যক নারী নাগরিকদের আশা ভঙ্গ হয়েছিল। সেই অপরিমেয় আশা ভঙ্গের দুই বছর পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীদের এই বিপুল বিজয় এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ও যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক বিরাট মাইল ফলক। শুধু সংখ্যাধিক্যই নয়, বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল নারীদের জন্যই সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে এই নির্বাচন। প্রথমবারের মতো দুজন মুসলিম নারী সিনেটে নির্বাচিত হয়েছেন। কানেকটিকাট ও ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্য থেকে দুজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী বিজয়ী হয়েছেন। সব মিলিয়ে ২০ জনেরও অধিক কৃষ্ণাঙ্গ নারী বিজয়ী হয়েছেন। এবারের নির্বাচনে আমরা পেয়েছি সর্বকনিষ্ঠ নারী বিজয়ী প্রার্থীকে। ক্যালিফোর্নিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যে বর্তমানে সিনেটে দুজন নারী।

হিলারি ক্লিনটনের পরাজয়ের পর গত দুই বছরে আমেরিকানদের কিছুটা হলেও টনক নড়েছে। বর্তমান রিপাবলিকান সরকার নারীদের যথেষ্ট সম্মান করছে না। বিভিন্নভাবে মেয়েদের অপমানসূচক কথা বলে, ইঙ্গিত দিয়ে বা এ ধরনের কাজকে উসকানি দিয়ে, আইনের পাশ কাটিয়ে গিয়ে ইতিমধ্যেই তারা নারীদের মন যথেষ্ট বিষিয়ে তুলেছে। এর ফলে তাদের ওপরে নারীদের আস্থা কমেছে। এ নির্বাচনে এক বিরাট ভূমিকা রেখেছে ‘MeToo’ আন্দোলন। এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে একের পর এক সুপ্রতিষ্ঠিত, সুপরিচিত ও সফল নারীরা মুখ খুলেছেন। মুখ খুলেছেন ধর্ষণ থেকে বেঁচে আসা গ্রেচেন হুইটম্যান। বিচারপতি কাভানার বিরুদ্ধে যখন যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এল নির্বাচনের কিছুদিন আগে, সে ব্যাপারেও সরকার উদ্ধত ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করেছে। এসব ঘটানই বর্তমান সরকারকে একতরফা পুরুষতন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং নারী নাগরিকদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে যে, এই ধারা চলতে থাকলে নারীদের সমস্যাগুলো কমবে না, বরং বাড়তে পারে। যৌন নির্যাতনের উপযুক্ত বিচার হবে না, নারীরা সমঅধিকার পাবে না অনেক ক্ষেত্রেই। এই সব সন্দেহ আর হতাশার ফলাফল স্বরূপই আমরা পেয়েছি নারীদের এই বিপুল বিজয় এই ঐতিহাসিক নির্বাচনে।

এই নির্বাচনের সুফল হিসেবে আমরা কী আশা করছি? প্রথমত ‘MeToo’ আন্দোলন আরও জোরদার হবে আশা করা যায়। যেকোনো ধরনের যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত হবে এবং সে হিসেবে শাস্তি নির্ধারিত হবে আশা করি। দেশের এক পঞ্চমাংশ অঙ্গরাজ্যে আইনজীবীদের জন্য যৌন নির্যাতনবিষয়ক বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকা এখনো বাধ্যতামূলক নয়। এই নিয়মের পরিবর্তন দরকার। অনেকগুলো অঙ্গরাজ্যেই জনগণের ট্যাক্সের টাকায় যৌন হয়রানির কেসগুলোর সুরাহা বা দফা হয়, এটাও একটি অন্যায়। যেকোনো ধরনের যৌন হয়রানির সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে মেয়েদের নিরাপত্তা অনেক বেশি বেড়ে যাবে।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাইরে থেকে যাই শোনা যাক না কেন, কর্মক্ষেত্র বা শিক্ষা ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে মেয়েরা কিন্তু এখনো সমঅধিকার পায় না। এমনকি একই শিক্ষা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একই পদে অনেক জায়গায় মেয়েরা কম সম্মানী পান। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিতের মতো বিষয়গুলোতে এখনো মেয়েদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে সীমিত। মেয়েদের কর্মক্ষেত্র এখনো বিশেষ কিছু কাজেই সীমাবদ্ধ। কোম্পানির বড় বড় পদগুলো এখনো পুরুষ অধ্যুষিত। মেয়েদের যোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ ও সন্দেহের শিকার। রাজনৈতিক নেতৃত্বে অধিকসংখ্যক নারী নেতার আগমন মেয়েদের এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে সাহায্য করবে আশা করি। শিক্ষা ক্ষেত্রে মেয়েদের উৎসাহিত করা হবে, বেশি সুযোগ দেওয়া হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে। কর্মক্ষেত্রেও অধিক সুযোগ দেওয়া হবে। ‘এই কাজ মেয়েদের নয়’, এ ধরনের মনোভাব দূর হবে। মেয়েদের মনে এই সবগুলো আশাই এখন আবার দেখা দিচ্ছে।

মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামগ্রিক জীবনযাপনের মানের ওপরে মনোযোগ দেওয়া হবে। মাতৃত্বকালীন ছুটি, শিশু সন্তানকে মাতৃ স্তন পানের সুব্যবস্থা করা, কর্মজীবী মায়েদের সন্তানদের জন্য কম খরচে উন্নতমানের ডে কেয়ারের ব্যবস্থা করা বা সন্তানদের অসুস্থতার কারণে ছুটি নেওয়া এসবের সুব্যবস্থা হবে। সন্তান ধারণের অপরাধে চাকরি হারাতে হবে না বা কর্মক্ষেত্রে অবনতি হবে না কোনো মায়ের। যেসব মা একা সন্তানদের লালন পালন করেন তাদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। আশা করি, নবনির্বাচিত নারী সদস্যদের উদ্যোগে নারীদের এই সব সমস্যার সমাধান হবে দ্রুত। সমান অধিকারে ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের মেয়েরা এবং বিশ্বের বুকে অচিরেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।
...