স্থাপত্যে অতুলনীয় জ্ঞানের উন্মুক্ত আকাশ

থেকে ৬-৩ ক্যালগেরির সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরি
থেকে ৬-৩ ক্যালগেরির সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরি

কী সুন্দর, কী চমৎকার এবং অসাধারণ! এমন একটা জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আদতে এটা কোনো বেড়াতে যাওয়ার জায়গা নয়। হ্যাঁ, এটা একটা লাইব্রেরি। ক্যালগেরির ‘সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরি’। প্রায় পাঁচ বছর ধরে কাজ চলছিল নতুন এই মনোমুগ্ধকর স্থাপত্যের। এখানে গণগ্রন্থাগারে বেশ অনেকগুলো শাখা আছে, এটা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। পুরোনোটার পাশেই নতুন কলেবরে এর আবির্ভাব ঘটেছে। পুরোনো ভবন অন্য কোনো কাজে ব্যবহৃত হবে। এ যেন শুধু গ্রন্থাগার নয়, শিল্পের একটি অত্যাশ্চর্য কাজ। ইতিমধ্যেই আর্কিটেকচারাল ডাইজেস্টে ২০১৮ সালে সম্পন্ন হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত ১২টি ভবনের একটি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এই গ্রন্থাগার ভবন।

প্রথন যখন কানাডা আসি, সবচেয়ে ভালো লেগেছিল পুরোনো সেই সেন্ট্রাল লাইব্রেরি। বাচ্চাদের অংশে ছয় মাসের শিশুটাকে ছেড়ে দিয়ে দিব্যি আমিও একটা রঙিন বই হাতে নিয়ে বসতে পারতাম। শিশুদের জন্য নিরাপদ নানা খেলনা আর বইগুলো নিয়ে রঙে রূপে ভরপুর ছিল সেই জায়গা। কামড়ে ছেঁড়ার চেষ্টা করতে করতে অবাক চোখে বইয়ের পৃষ্ঠাও দেখত আমার মেয়ে। সেই থেকে বইয়ের সঙ্গে সখ্য। সেই লাইব্রেরির সঙ্গে তুলনায় নতুন লাইব্রেরি আরও বেশি নান্দনিক, ব্যবহার উপযোগী আর নানা উপাদানে সমৃদ্ধ এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।

ক্যালগেরির সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরি
ক্যালগেরির সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরি

২০১৪ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০১৮ সালের এই নভেম্বরে উদ্বোধন হলো নতুন ভবনের। কাজ চলাকালে প্রতিদিন ৩ হাজার ৫০০ লোকের পদচারণায়, ৫৫ বছরের ঐতিহ্য রক্ষা করেছে পুরোনো লাইব্রেরি। ২ লাখ ৪০ হাজার বর্গ ফুটের পাঁচ তলা এই নতুন ভবনে প্রায় ছয় লাখ আইটেম আছে। বছরে দুই মিলিয়ন লোককে তারা সেবা দিতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ২৪৫ মিলিয়ন কানাডীয় ডলার। সরকারি অর্থের পাশাপাশি দারুণভাবে তারা অর্থ সাহায্য জোগাড় করেছে। এর নানা অংশের জন্য অর্থ জোগাড় করা হয়েছে এমনভাবে যে, যারা একটা জানালার খরচ দেবেন, তাদের নাম ওই জানালায় থাকবে এবং তারা একটা ছোট্ট মেসেজও দিতে পারবেন লিখে রাখার জন্য। আরও কম অর্থে একই জানালায় অনেক লোকের নাম থাকবে। বাচ্চাদের সেকশনে যাওয়ার সিঁড়িটি যিনি অর্থায়ন করেছেন তিনি তা উৎসর্গ করেছেন, অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মায়েদের জন্য। এর নামটিও তার দেওয়া, ‘দ্য মামস স্টেয়ারওয়ে’ (The Moms’ Stairway)। এ ছাড়া, তৈরি করা হয়েছে একটি টাইম ক্যাপসুলের একটি বিমে লাইব্রেরি পাগল ৭০০ নাগরিক তাদের বার্তা লিখে রেখেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। সিঁড়ি, জানালা, অন্য নানা অংশ, এভাবে সবকিছুতেই স্থায়ী অবদান রেখেছেন সামর্থ্য অনুযায়ী অনেক নাগরিক।

ক্যালগেরির সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরি
ক্যালগেরির সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরি

শহরের ভেতরে চলাচলের যে ট্রেন, তার কাজ চলছিল। সেই কাজের সঙ্গে এই লাইব্রেরির নির্মাণকাজকে যুক্ত করা হয়েছে যেন পয়সা বাঁচে। কিন্তু ট্রেনের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল আগেই। তখনো লাইব্রেরির ডিজাইন করা শেষ হয়নি। তাই ট্রেন স্টেশনকে মাথায় রেখেই লাইব্রেরির ডিজাইন সেই অনুযায়ী করতে হয়েছে। জায়গা সংকুলানের কথা চিন্তা করে ট্রেন স্টেশন আর লাইব্রেরি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। যা এনে দিয়েছে বাড়তি সুবিধা। এই শীতের দেশে এ রকম একটা লাইব্রেরির সঙ্গেই যদি থাকে ট্রেন স্টেশন, কতই না উপকার হয়। তবে আছে উচ্চমানের শব্দ নিরোধক যাতে ট্রেনের শব্দ কোনো বিঘ্ন না ঘটায়।

ট্রেনের সঙ্গে একে যুক্ত করা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং কাজ। স্থপতিরা তাদের সফলতার প্রমাণ রেখেছে প্রতি ধাপে। পরিবেশের প্রতি দায়িত্বপূর্ণ দীর্ঘস্থায়ী সব উপাদান আর নিয়ম মেনে তৈরি এই বিল্ডিং পেয়েছে গ্রিন বিল্ডিং প্র্যাকটিস সার্টিফিকেট। মহতী এই ডিজাইনের অর্ধ চন্দ্রাকৃতির আকার দৃষ্টি কাড়ে। এ যেন এক জাহাজ যা ভবিষ্যতের জন্য পাল তুলেছে। মাথার কাছে কাচের ছাদ আকাশকে উন্মুক্ত করেছে। স্থপতিদের ভাষ্য অনুযায়ী, বই যেমন আমাদের কাছে জ্ঞানের আকাশকে এনে দেয় সেরকমই আকাশকে উন্মুক্ত রেখেছেন তারা।

ক্যালগেরির সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরি
ক্যালগেরির সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরি

প্রধান প্রবেশদ্বারের সিঁড়ির ওপরের ছাদ যেন মেঘের তোরণ। এখানে শিনুক আর্চ ক্লাউড (Chinook Arch Cloud) নামে এক বিশেষ ধরনের মেঘের দেখা পাওয়া যায়, যার সঙ্গে থাকে গরম বাতাস। নিমেষেই স্তুপিকৃত বরফ গলিয়ে দেয় এই বাতাস। ভৌগোলিকভাবে পৃথিবীর খুব অল্প জায়গায় এই বৈশিষ্ট্য আছে। এই শিনুক আর্চের অনুপ্রেরণাতেই নাকি এ রকম ডিজাইন করা হয়েছে, যা আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবে। ভেতরে প্রবেশ করতেই মনে হবে যেন বিস্তীর্ণ খোলা মাঠের মাঝে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া দৃষ্টি নন্দন এক স্থাপত্য। এখান থেকে দেখলে মনে হয়, ওপরে ওঠার সিঁড়ির গঠনগুলো এক অকল্পনীয় সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে।

এ যেন এক আলোর ঝরনাধারা! ওপরের খোলা আকাশ, চারদিকে কাচের জানালা-ভেতরের পরিবেশকে দিয়েছে দিনের আলোয় এক অনাবিল সৌন্দর্য। সকালের সূর্যরশ্মি পাশের ভবনে রিফ্লেক্ট করে এনে দেয় সোনালি সকাল। রোদে পিঠ দিয়ে বসে বই পড়তে কার না ভালো লাগে! রাতের রাস্তার লাইটগুলোকে কোনো পোস্টের সঙ্গে না লাগিয়ে এমনভাবে পাশের ভবনে লাগানো হয়েছে, তাতে বেঁচে গেছে খরচ আবার এনে দিয়েছে চাঁদের আলোর মুগ্ধতা। ভেতর থেকে মনে হবে যেন জ্যোৎস্না নেমেছে।

আদিবাসীদের যুক্ত করা হয়েছে এখানে নানাভাবে। যেমন আছে শহরের আদি ইতিহাস জানার জায়গা তেমনি আছে আদিবাসীদের ইতিহাস ঐতিহ্য জানার অংশ। চমৎকার আর্ট ওয়ার্ক আর স্কাল্পচার আছে আদিবাসীদের করা। আদিবাসীদের মধ্য থেকে একজনকে মনোনীত করা হয়েছে যিনি সবাইকে তাদের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান দেবেন।

লাইব্রেরির ভেতরের একটি অংশ
লাইব্রেরির ভেতরের একটি অংশ

এটাকে শুধু লাইব্রেরি বললে ভুলই বলা হবে। কী নেই এখানে! ফার্নিচার থেকে বইয়ের শেলফ অসাধারণভাবে সজ্জিত। নিরিবিলিতে পড়ার জন্য কোয়াইট প্লেস, কনফারেন্স রুম, অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিং স্টুডিও, প্রোডাকশন স্টুডিও, থিয়েটার। আছে পারফরমেন্স হল, যেখানে বক্তা ও অন্যরা অনুশীলন করতে পারবেন মূল অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে। রয়েছে ফিল্ড ল-মিটিং রুম, ভিডিও কনফারেন্স রুম, ডিজিটাল লার্নিং ল্যাব, সাধারণের ব্যবহারের জন্য ২০০ ফ্রি কম্পিউটার ও শক্তিশালী ওয়াইফাই। আয়োজন আছে নানা ধরনের প্রোগ্রামের, সব রকম বয়সীদের জন্য। রয়েছে বিভিন্ন ট্যুরের ব্যবস্থা। শেখা যাবে এই চ্যালেঞ্জিং আর্কিটেকচার থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছু। শিক্ষকেরা ক্লাস নিতে পারবেন সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে, সে জন্য আছে স্কুল ঘর। নানা ধরনের প্রশ্ন উত্তরের জন্য আছে প্রশ্ন রাখার জায়গা। নতুন আসা অভিবাসীদের জন্য আছে সাহায্য সহযোগিতার জায়গা। প্রার্থনা ও মেডিটেশনের সুবিধা সম্পন্ন জায়গাও রয়েছে একাংশে।

টিন এজারদের জন্য রয়েছে অসাধারণ সব ব্যবস্থা। টিন এজারদের কৌতূহলী মনের সত্যিকার স্ফুরণ ঘটবে এখানে। তাদের জন্য আছে টেকনোলজি ল্যাব ও মিউজিকের জন্য স্টেজ। একাডেমিক সাহায্যের জায়গা। এমনকি ভিডিও গেমের জন্য বিশাল মনিটরসহ আরামদায়ক বসার জায়গা। একটি শেলফে ১১ হাজার বই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিশাল এক গোল্ড ফিশের। মনে হবে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে এক রঙিন গোল্ড ফিশ।

ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়বে সিঁড়ির এই অবকাঠামো
ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়বে সিঁড়ির এই অবকাঠামো

আর মায়েদের জন্য! নবজাতকদের বুকের দুধ খাওয়ানোর জায়গা থেকে শুরু করে আছে নিরিবিলিতে বসার স্থান। মায়েরা পাবেন প্রশান্তির ছোঁয়া। শিশু থেকে টিনএজার সবার জন্য রয়েছে অসাধারণ সব খেলার সরঞ্জাম, প্রাণবন্ত সময় কাটবে তাদের, বিকাশ হবে শারীরিক সুস্থতার।

রয়েছে চা-কফি, খাবার দাবারের জন্য স্বনামখ্যাত শেফের দোকান। কফি হাতে বই নিয়ে বসা যাবে সহজেই। কানাডার বাথরুমগুলো সব সময়ই পরিচ্ছন্ন, এখানে নতুন যোগ হয়েছে লিঙ্গ নিরপেক্ষ বাথরুম।

বাদ পরে গেল অনেক কিছুই। তারপরও যেটার কথা না বললেই নয় তা হচ্ছে সবার ওপরের তলার এক অতুলনীয় বসার জায়গা। ওপরে অবারিত আকাশ আর নিচের বিস্তৃত শহর দেখতে দেখতে করা যাবে ভাবের আদান প্রদান কিংবা হারিয়ে যাওয়া যাবে অনন্তে। সূর্যাস্তের স্নিগ্ধ রূপ অনুভব করতে করতে ইতি ঘটবে তৃপ্ত এক দিনের। এভাবেই পরিসমাপ্ত হতে পারে এই অসাধারণ লাইব্রেরি ভ্রমণ।

মিলনায়তন
মিলনায়তন

এখানে আমি বাংলাদেশের একটি বইয়ের দোকানের কথা উল্লেখ করব এতে কিছুটা লাইব্রেরির সুবিধাও পাওয়া যায়। এবার দেশে গিয়ে দেখে এলাম ‘বেঙ্গল বই’ নামে চমৎকার এক বইয়ের দোকান হয়েছে, যেটার এখানকার লাইব্রেরির সঙ্গে বেশ মিল। স্বল্প পরিসরে অসাধারণ পরিবেশনা। ক্যালগেরির সেন্ট্রাল লাইব্রেরি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, এই বিশাল জাহাজের মতো পাল না তুললেও অন্তত বেঙ্গল বইয়ের দোকানের মতো অনেক অনেক লাইব্রেরি হোক বাংলাদেশে।
...

আফরিন জাহান হাসি: ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা।