গাছের ছায়ায় যে বাড়ি

পল্লিকবির বাড়িতে
পল্লিকবির বাড়িতে

যা কিছু দেখি, মনে হয় দেখেছি আগে। আসলে এভাবে আসা হয়নি। স্বজনেরা পল্লিকবির বাড়ি ভ্রমণ করেছেন। ছবি দেখেছি তাঁদের কাছ থেকে। আর কবির কবিতাতো আছেই। এর মধ্য দিয়ে কবি ও তাঁর বাড়ি সম্পর্কে একটি চিত্রকল্প নির্মিত হয়ে গেছে সেই অনেক আগে। সবকিছু আপন ভাববারও এটাই কারণ।

সেদিন বিরাট এক বহর নিয়ে গিয়েছি আমরা। এ দলে তিন প্রজন্মের প্রতিনিধি। কোনো এক ভুঁইয়ের আলপথ কল্পনা করলে বলতে হয়, একেবারে মাথায় আমার মামণি অনজু হালদার। তারপর তাঁর ছেলেমেয়ে ও পুত্রবধূরা। এর মধ্যে মেশানো তৃতীয় প্রজন্মের দোয়েল শ্যামারা। তারা কেউ কোলে কাঁখে আবার কেউবা হাত ধরে ঘুরছে পল্লিকবি জসীমউদদীনের আঙিনা। কেউবা আবার মুক্ত বিহঙ্গের মতো এখান থেকে ওখানে যাচ্ছে। তারা আর বড়দের ধার ধারছে না।

পল্লিকবির বাড়িতে
পল্লিকবির বাড়িতে

গ্রামের কবি। নকশিকাঁথা ছাড়া কী চলে! নিজের তত্ত্বাবধানে সূক্ষ্ম হাতের কাঁথা সেলাই করেছেন। সুরাইয়া এর নির্মাতা। একটি কাঁথার প্রতিটি ফোঁড়ে থাকে নারীর স্বপ্নের বয়ান। তাঁর সুখ-দুঃখের অভিব্যক্তিও ফুটে ওঠে এর মধ্য দিয়ে। এখানে এই কাঁথায় কী তাহলে কেবল ওই নারীর সুখ দুঃখ কিংবা স্বপ্ন সাধই ব্যক্ত! নাকি পল্লিকবির হৃদয়ের ভাষাও বর্ণিত কাঁথার প্রতিটি বুননে। তা না হলে কেনই-বা লেখা হবে তাঁরই হেফাজতে এ কাঁথার বুনন। এ বহরের সীমা সরকারই প্রশ্নটা তুলেছেন। আমি বলি, তাইতো!

ছোটদের ওপর জসীমউদদীন ছড়া লিখেছেন বিস্তর। ‘এত হাসি কোথায় পেলে’ বলে তাঁর বিস্ময় প্রকাশ পেয়েছে এসব রচনায়। বাঙালির হাসির গল্প লিখেছেন। শিল্পী মোস্তফা মনোয়ার ছবি এঁকেছেন সেটা ধরে। এ সবই ঝুলিয়ে রাখা তাঁর বাড়ির কন্দরে কন্দরে।

সেজ ভাই, মেজ ভাইয়ের ঘর আলাদা করে দেখানো হয়েছে। তবে সব জায়গায় তাঁর সৃষ্টির সংযোজন। সেখানে হৃদয় কাড়া লেখা। তাতে ভিন্ন এক আহ্বান। পালের নাও পালের নাও পান খেয়ে যাও—ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও। এ নিয়ে কথা হয়। সজল হালদার বোঝাতে চেষ্টা করেন ছোটদের। বোনকে খুশি করতে এ চাওয়া, সে জন্য এই আকুলতা! দেবাহুতি চেয়ে থাকে মুখের দিকে। কবি কী মোহনীয় করেই না তুলে ধরেছেন শিশু মনের উপলব্ধি। গ্রামের ছোটরা...এই বর্ষা, এই নদী, এই নাও...দেখে দেখে বড় হয়। তাদের মনও গড়ে ওঠে এরই ছন্দে ছন্দে। এসব কবিকে আকর্ষণ করে। সে জন্যই তিনি পল্লিকবি।

পল্লিকবির বাড়িতে
পল্লিকবির বাড়িতে

আমরা এ ছবি দেখাই এই প্রজন্মের সন্তানদের। তূর্য, নীরব, সূর্য...আগ্রহ নিয়ে দেখে। ওম, উর্বশী … দৌড়ে দৌড়ে সামনে যায়। আগে ভাগে দেখার পাল্লায় সে হারাতে চায় সবাইকে। আমি বলি, হ্যাঁ দেখতে হবে সব।

কবির আঙিনায় প্রবেশ করার পর পরই এগুলো দেখা হয়ে যায়। বৃষ্টি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে। টিপ টিপ করে নামে, কখনো-বা থামে। তবে সেই সঙ্গে গরমের চোটও কম নয়। ঘেমে সব একাকার।

হাসু মিয়ার পাঠশালার পাশ দিয়ে সরু পথ। এগিয়ে যাই আরও সামনে।

পাখিরা কিচিরমিচির করে। মানুষ আসে দলে দলে। আমরা চলি সমান তালে। এরই মাঝে ছবি তোলার হিড়িক পড়ে। আমরা তুলি, তোলে অন্যরাও। বৃষ্টি বুঝি এবার একটু বেশিই নামে। ফিরে আসি শুরুর ঘরটিতে। এবার ডানমুখো হয়ে ঢুকতে হয়। চোখ পড়ে ছবির ওপর। এখানে আবিষ্কৃত হয় ইতিহাসের নানান বাঁক। সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধনে যা দেয় অনন্য এক ব্যঞ্জনা। আধুনিক গানে গীতা দত্ত সুনাম কুড়িয়েছেন। তাঁর ছবি। সেখানে কবির নাতি আমন, আছে তাঁর নাতনি মধুবালা, মৃদুলা আর দুলি। হাসি তাদের মুখে।

বন্ধু ভাগ্য কম নয় পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের। তাঁদের সঙ্গে ধারণ করা ছবিগুলো আমাদের নিয়ে যায় সেই সময়ে। যখন তাঁরা একসঙ্গে মিশেছেন এবং গল্প করেছেন। শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে বলা হয়েছে ড. দীনেশ চন্দ্র সেনকে। ১৯৬৭ সালে এডিনবার্গে সাক্ষাৎ হয় হেনরি মিলারের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রামেরই সন্তান। তাঁরও সঙ্গে কবির আলাপ জমে ওঠার কথা। এক ফ্রেমে দেখা যায় তাঁদের। ১৯৭২ সালের ছবি। এ সব চিত্র দেখে আপ্লুত হই আমরা।

ভাইবোনদের সঙ্গে কবির সম্পর্ক ছিল নিবিড়। তাই তো তিনি চিঠি লিখেছেন নিয়মিত। তাঁর শেষ পত্রটি এখানে তুলে ধরা হয়েছে সযত্নে।

পল্লিকবির বাড়িতে
পল্লিকবির বাড়িতে

পল্লিকবি বলেই গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছিলেন। গান ছিল তাঁর ভীষণ প্রিয়। সে কারণে শিল্পী পেয়েছেন তাঁর কাছ থেকে অগাধ সম্মান। তাঁর সংগ্রহে উজ্জ্বল হয়ে আছেন নজরুলসংগীতের শ্রেষ্ঠ গায়িকা আঙুর বালা আর বিখ্যাত শিল্পী কানন দেবী। তৃপ্তি হালদার তুলে ধরেন এর প্রেক্ষাপট। শুনি তাঁর কথা, ভেতরে-ভেতরে সমৃদ্ধ হই। গানের ভুবন ছাড়া চলচ্চিত্রেও কবি ছিলেন প্রচণ্ড আগ্রহী। নার্গিস আর দিলীপ কুমারের ছবি তাঁকে বড় বেশি টেনেছে। সে সব ছবি দেখলাম।

১৯৬৬ সালের এক ছবি। সেখানে কবিপত্নী তাঁর সঙ্গে। পুত্র বাবু ও হাসুর ছবিও প্রদর্শনীতে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে ধরে রাখা হয়েছে। বোঝা যায়, কবির পারিবারিক বন্ধনটি ছিল সুদৃঢ়।

‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায় পল্লি কবি শহুরে বন্ধুকে আহ্বান করেছেন তাঁর গ্রামে।

আমরা গ্রামের হয়ে দেখলাম তাঁর গ্রাম।

গাছের ছায়ায় লতায় পাতায়…আমরা তা দেখলাম। দেখে বিস্মিত হলাম। গ্রামের ওপর কতটুকু টান থাকলে এই ছড়া, এই কবিতা লিখতে পারেন একজন, ভাবি আমি। বৃষ্টি নামে। কিন্তু দেখা অবিচল।

একপর্যায়ে পুরোপুরি না হলেও বৃষ্টি থামে। এবার যাত্রার পালা।

দেখি অন্ধকার নেমে এসেছে।

পল্লিকবির বাড়িতে
পল্লিকবির বাড়িতে

আমরা রাস্তায় নামি। আসমানির ঘর দেখা হয় না। মনে পড়ে দেবাহুতির। ডালিম গাছের তলের দাদির কবরও গল্প হয়ে থাকে। তূর্য বলে, বাকি রইল যে! আমি বলি, একদিনে হয় না শেষ। ওদের সান্ত্বনা দিই, আবার আসব আমরা। উল্কা হালদার ব্যস্ত ছোটদের নিয়ে। তাঁরই তাড়া ছুটতে হবে এখন।

আমাদের বহর চলে শহরের দিকে। রাতেই যেতে হবে গ্রামের ঠিকানায়।

আমার মামণি অত শত চিন্তা করেন না। না হয় থেকে যাবেন শহরে। হ্যাঁ, এখানে যে তাঁর এক পুত্রের বাসা। যিনি আছেন আমাদের এই বহরে।

নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত।