ক্রসফায়ার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাত সাড়ে আটটা। বিকেল থেকেই মনটা খুব বিষণ্ন। কিছুক্ষণ পরপরই চোখ দুটো ভিজে যাচ্ছে। মায়ের অনুরোধে গত সপ্তায় বাসায় গিয়ে মামার সঙ্গে দেখা করে এসেছি। আজ যাওয়ার আগে তিনি আবারও দেখা করে গেছেন। এসবের কী দরকার। আমার মোটেই ভালো লাগে না।

হলে আমার সঙ্গে এক রুমেই থাকে নিপা, শুভা আর জবা। ওরা কী না কী মনে করে তাই চোখের জল আড়াল করছি। জুনিয়র এই মেয়েগুলো পড়াশোনা নিয়ে একটু-আধটু মগ্ন থাকলেও জবা মেয়েটা পড়ালেখা মোটেই করে না। কেমন যেন বোকা টাইপের। সব কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে। প্রাইভেসি বলতে কিচ্ছু বোঝে না। জলের মতো টাকা খরচ করে। ওর এই বোকামির সুযোগ নেয় অনেকেই।

একদিন রাত তিনটা। ঘুম থেকে ডেকে তুলে ফিসফিস করে বলে, রুপা আপা, খালাতো বোনের বিয়েতে একটা ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ওই রাতে নীরবে ওর সঙ্গে অনেক কথাও হয়েছে। ওর নাম নিলয়।

: ও আচ্ছা।

: আপা বিশ্বাস করেন, এমন স্মার্ট ছেলে জীবনে দেখিনি। আমার শরীরে অন্য রকম একটা অনুভূতি হয়েছিল। কী যে ইচ্ছে করছিল আপা! লজ্জায় ওর হাত ধরতে পারিনি। প্রথম দেখা তো। যদি ভেবে বসে কী বেহায়া মেয়েটা!

: ও আচ্ছা।

: আপা, এখন আবার ওই রকম লাগছে। ছেলেটাকে কাছে পেতে খুব ইচ্ছে করছে। ঘুমোতে পারছি না। কী করি বলেন তো। মোবাইলে ছবি তুলে এনেছি। দেখবেন, আপা?

: সরি জবা। সকালে দেখব।

: না আপা। এখনই দেখেন।

মনে হলো জবা যেন ফোনটা আমার চোখে চেপে ধরেছে। চোখ খুলতেই দেখি আইফোনের ধবধবে স্ক্রিনে ছবিটা।

: হ্যাঁ, অনেক সুন্দর ছেলেটা। তোমার পছন্দ ভালো।

: ঠিক বলেছেন, আপা।

: জবা, এক কাজ করো। বারান্দায় গিয়ে ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে এসো। সবাই ঘুমোচ্ছে তো। যাও।

: আপা, নম্বর তো নিইনি। তবে একটা উপায় আছে। এখন তো রাত অনেক হয়ে গেছে। সকালের আগে আর হচ্ছে না। উ-ফ-ফ।

পরদিন বিকেলেই দেখি টিএসসিতে জবা আর নিলয় নিবিড় ভাবে বসে আছে। বেশ চুটিয়ে প্রেম করে যাচ্ছে ওরা। পরিচয়পর্ব শেষ না হতেই কয়েকজন ছাত্র এসে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে বহিরাগত ছেলের এমন দুঃসাহস দেখে বাঁকাত্যাড়া প্রশংসা শুরু করল। মুহূর্তের মধ্যেই কলার ধরে টানাটানি! পরিস্থিতি শান্ত করতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়। নিলয় যেমন স্মার্ট তেমনই ভদ্র। ‘সরি সরি’ বলে খুব সহজেই পরিস্থিতি সামলে জবাকে আমার কাছে দিয়ে সে কেটে পড়ে।

হলে এসে বললাম, জবা, এটা ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি না। যা কিছুই করো, পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে ব্যালেন্স করে তারপর...।

: আপা, আমি যে কী তা ওরা জানে না। আমার সঙ্গে এই আচরণ! টিএসসি কারও বাপ-দাদার সম্পত্তি না। চালচুলো নেই ওই ছেলে—আবার ক্যাডারের ভাব নেয়। পিছে পিছে ঘুরলেই কারও মন পাওয়া যায় না। ছবি তুলে রাখছি। ক্রসে ফেলে দেব না! নিলয়ের ওপরও আমার খুব রাগ হয়েছে। সে পরিস্থিতিটা ইগনোর করে কুনো ব্যাঙের মতো সরে পড়েছে। ইটস ওকে, আই ডোন্ট কেয়ার।

সন্ধ্যা হয়ে আসে। শুধু নিপা এখনো ফেরেনি। এদিকে জবা আর শুভা নানান গল্পে মেতে আছে।

নাহ, ওদের এই হইচই আর ভালো লাগছে না। শতবর্ষী বটগাছের তলায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসি। রোকেয়া হলের মেইন ফোরটি ওয়ানে থাকি। বিল্ডিংয়ের অদূরেই গাছটা। এই গাছগুলোর ছায়ায় খুব ভালো লাগে আমার। নিজেকে কাছে পাওয়া যায়। ঘন-কালো ছায়ায় শৈশবের ঘ্রাণ। ছোটবেলায় বাবা মারা গেছেন। তিন ভাই-বোনকে নিয়ে দিশেহারা মা। ফুফু, খালাম্মা, কাকা আমাদের ভাগাভাগি করে নিয়ে যান। ছয় মাস যেতে না যেতেই মা কান্নাকাটি করে আবার ফিরিয়ে আনেন। এ নিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন ঝামেলা। মা অনড়—না খেয়ে মরে গেলেও ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরেই মরবেন। একে একে ছেড়ে গেলেন সবাই। কেউ পাশে দাঁড়াতে রাজি নন। শুরু হয় অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ।

হায়রে অভাব। দিনে এক-আধবার খাওয়া। আবার কখনো তাও জোটে না। মা এখানে-ওখানে যান। কাছের দূরের সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেন। কোথাও আশা নেই। আশার ঘ্রাণও নেই। ঠিক এ সময় হঠাৎ উদয় হন ইমু মামা। সাত বছর বয়সে বাবার সঙ্গে বাজারে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর কীভাবে যেন ঠাঁই হয় ঢাকায় কোনো এক অরফানেজে। সেখান থেকে নিঃসন্তান এক ব্রিটিশ দম্পতি অ্যাডপ্ট করে তাঁকে নিয়ে যান। ওই গড প্যারেন্ট বছর খানিকের ব্যবধানে মারা গেলে ইমু মামা একেবারেই বদলে যান। বাংলাদেশে এসে নিজের মা-বাবাকে খুঁজতে থাকেন। এত আরলি এজে দেশ ছেড়ে যাওয়া লোকজন—বাংলা তেমন জানার কথা নয়। তবে ইমু মামা বাংলা ভালোই জানেন। মাঝে মাঝে সিলেটের আঞ্চলিক টান চলে আসে।

মামা থাকেন ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে। মা কীভাবে ইমু মামাকে আবিষ্কার করেছেন আজও জানি না। বাবা মারা যাওয়ার দুই বছর পর তখন প্রাইমারি শেষ করে বসে আছি। হাইস্কুলে যাওয়া আর হবে না। কোনো উপায়ই নেই। কাঁদতে ইচ্ছে করত। কেঁদে আর কী হবে। অপ্রয়োজনীয় চোখের জল কোনোকালেই আমার ভালো লাগে না। এমনই সময় কোনো এক দিন ইমু মামা আসেন। আশাহীন ঘরে দেখা দেয় আশার আলো।

আমাদের তিন ভাইবোনের লেখাপড়া কী করে হবে, মামা শুধু এটুকুই দেখভাল করেন। এ নিয়ে কত কলঙ্ক। মা আর আমাদের দুই বোনকে নিয়ে কত অপবাদ। আত্মীয়স্বজন সবাই আমাদের বিপক্ষে দাঁড়ায়। মা কিছুই পরোয়া করেন না। আমরাও লেখাপড়া চালিয়ে যাই। বছর দু-তিন পরপর মামা দেশে আসেন। আমাদের বাড়িতে দুপুরে খাওয়া শেষে সামান্য কিছু ভাত-তরকারি মা রেডি করে দেন। মামা খাবারের বাটিগুলো ব্যাগে করে বেরিয়ে পড়েন। পর্যটন এলাকাগুলোর পাশাপাশি নদী-মাঠ-বিল-হাওরে ঘুরে বেড়ান। খুব অল্প সময়ই ঢাকায় থাকেন। ছোটবেলায় মামার সঙ্গে একবার সেন্ট মার্টিন বেড়াতে গিয়েছিলাম। বড় হয়ে আর কোথাও যাইনি। কেমন যেন লজ্জা করে।

মাকে ‘আপা’ ডাকেন। দুজনে কথা বলার সময় বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে তারা আপন ভাইবোন নন। এই মামা কেন আমাদের ‘কিছুই নেই’ পরিবারটিকে এমন করে শিক্ষিত করে তুলছেন, তার স্ত্রী-সংসার কেন নেই—এসবের কিছুই জানি না। মাকেও এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে আমার একদম ইচ্ছে করে না।

আজ সন্ধ্যা সাতটায় ছিল তার ফ্লাইট। এখন রাত দশটা বাজে। মামা এখন আকাশে উড়ছেন। মনটা তার ভালো নেই। দেশকে মিস করছেন। মিস করছেন আমাদের। মায়ের হাতের রান্না, দেশীয় শাকসবজি, সাধারণ তরকারি সব মিস করছেন। তার চোখে জল। যদিও অন্ধকার আকাশ। উইনডো ওপেন করে ওই অন্ধকারকেই দেখছেন তিনি আর অশ্রু গোপন করছেন। মামা আমাদের এত মিস করলেও আমরা কখনো তাকে মিস করি না। মা-ও তাকে নিয়ে কখনো কিছু বলেন না।

মনে আছে, একবার বিদায়ের সময় অপু আর তিনা মামাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছিল। ওদের কান্না দেখে আমি হাসছিলাম।

বিকেলে আমাদের হলের সামনে গেস্টরুমে বসে মামা আমাকে ফোন করেন। যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। পরীক্ষার আর মাত্র চার দিন বাকি। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। বেশ বিরক্তি নিয়েই তার সঙ্গে দেখা করতে যাই।

আমাকে দেখে মামা কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। একসময় নিজেকে স্বাভাবিক করে বলেন, মা, যাচ্ছি। আবার কখন দেখা হবে জানি না।

বলার ছলে বললাম, দেখা হবে না কেন। নিজের দেশ। আসতে তো হবেই।

: হ, মা। ভালো লাগে না। কেন যে কিচ্ছু ভালো লাগে না জানি না।

বার কয়েক চোখ মুছে আমার হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে চলে যান। সঙ্গে কেউ নেই। এয়ারপোর্টে যাচ্ছেন একা।

পুরুষের চোখের জল আমার অসহ্য লাগে। থাবড়াতে ইচ্ছে করছিল।

না, এখন আর ওই ইচ্ছে করছে না। নিজেও কাঁদছি। ইমু মামার সঙ্গে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গেলে কী এমন ক্ষতি হতো।

জীবনে এই প্রথম তার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। সংসারে কিছু মানুষ আছে; যাদের কথা ভাবতে ভালো লাগে। পাশে থাকলে আরও ভালো লাগে। মামা মনে হয় তেমনই একজন। আমার খুব ইচ্ছে করছে; তার সব স্মৃতি আমাকে খুব নাড়া দিচ্ছে।

হ্যাঁ, চারদিকে তেমন কেউ নেই এখন। ঝাপসা জোছনায় গাছের ছায়ায় বসে আমি কিছুক্ষণ কাঁদব।

আকাশ ভারী হয়ে ওঠে ঠান্ডা বাতাসে। হয়তো বৃষ্টি হবে। খুব ভালো লাগছে। ঠিক তখনই নিপা দৌড়ে আসে।

আপা, আপনি ফোন রেখে চলে এসেছেন। আর এদিকে একাধারে রিং হয়েই চলেছে।

নিপা শোনো, আমার এখন ফোন রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না। তুমি মোবাইলটা অফ করে আমার বালিশের নিচে রেখে দাও প্লিজ।

নিপা চলে যেতে না যেতেই ঝপাঝপ বৃষ্টি শুরু হয়। এক দৌড়ে হিম সবুজ ঘাস ছাওয়া মাঠের মাঝখানে গিয়ে আকাশে মুখ করে দাঁড়িয়ে অঝোর বৃষ্টিতে ভিজছি। বুকটা আরও উন্নত করে অনুভব করছি বৃষ্টির হিম পরশ। ঘন ঘন বজ্রপাতও হচ্ছে। কখনো কখনো ক্রসফায়ার বলে ভ্রম হয়।

খুব চিৎকার করে ডাকছি, মামা...। যে আকাশে তুমি উড়ছ, সেখানেও কী ক্রসফায়ার হয়? দেখো মামা, বৃষ্টিতে ভিজে একাকার এই আমি। থরথর করে কাঁপছি। তাও আমার শরীর জুড়োয় না। মনে হয় এ জীবনে অতৃপ্ত ভালোবাসার চেয়ে বড় কোনো ক্রসফায়ার নেই।

এ সময় হঠাৎ শুনি নিপার ডাক। চোখ খুলতেই দেখি বড় এক ছাতা নিয়ে আমার মাথার ওপর ধরে ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে।

নিপা কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, সরি, আপা। ফোন রিসিভ করে ফেলেছি। এমন অনুরোধ শুরু করল যে উপেক্ষা করতে পারিনি।
...

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>