অভিবাসী জীবনে ভাইফোঁটা

ভাইফোঁটা
ভাইফোঁটা

আমাদের যাপিত জীবন ভালোবাসাময়। তবে খুঁজে নিতে হয়। এই ভালোবাসার সম্পর্কের নির্ভেজাল চরিত্র বোন-দিদি কিংবা আপা। সংসারের সব সম্পর্ক কলুষিত হলেও মা-ছেলে, ভাই-বোনের সম্পর্ক আজও নৈবেদ্যের থালায় সাজানো পুষ্প চন্দনের মতো পবিত্র।

বোন জানে ভাইয়ের ফিরতে রাত হবে। তবু ঠিক সময়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দেবে। স্কুলের রাস্তায় রোদ জ্বলা দুপুরে, মন পুড়ে, প্রতিবেশিনীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা ভাইটিকে, বোনেরা কখনই বাউন্ডুলে মনে করে না। শুধু নিজের কোলের দিকে ঝুল টেনে বলবে ওই ডাইনি তার ভাইকে জাদু করেছে। এ বড় দারুণ পক্ষপাত যা কখনোই পক্ষপাতদুষ্ট হয় না।

বোন ঘরের গয়না। যা সংসারকে সাজিয়ে রাখে। হৃদয়হীন এই সংসারে যাদের হৃদয় শত দুঃখে কষ্ট পায় না, তারাই বোন।

বোনেদের হৃদয়ে যখন শরৎচন্দ্র সর্বজনীন আতিথ্য পেলেন, এই বিরাট পৃথিবীতে আমরা জানলাম; বোনের মমতার আঁচলের কাছে বিশাল আকাশটাও ছোট হয়ে যায়। বুকের ভেতর যখন ধু ধু বালুচর, একটু বৃষ্টির আশে খাঁ খাঁ করে হৃদয়, বড়দিদি যেন আড়াল থেকে হাত বোলান স্নেহের পরশে। শরৎবাবু, বড়দিদিকে জানাবেন সে কথা; সংসারে আজও অমলিন বোনের স্নেহ-শাসন-মমতা।

ভাইফোঁটা
ভাইফোঁটা

আজও মেজদিদি হেমাঙ্গিনির কেষ্ট ডাক কানে গুঁজে পরম স্নিগ্ধতায়। শৈশবের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে নিজের বোনেদের মুখ। স্মৃতির উনুনের বাতাসের ঝাপটায় মেঘ জড়ো হয় চোখের কোণে; অঝোরে বৃষ্টি ঝরায়।

জীবনযুদ্ধে ক্লান্তপ্রাণ বোন কখনও অযাচিতভাবে ভাইদের কাছে আসতে হয়, অবহেলা অবজ্ঞায় দুঃখ পায় ঠিক; তবে কষ্ট চেপে রাখে না। দিদিদের স্নেহ-মমতায় ক্লান্তি আসে না, ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় সেই ভাইদের জন্য বছর-বছর, যমের দুয়ারে কাঁটা বিছায়।

ভাইফোঁটা যা আবহমান কাল থেকে চলে আসা রীতি। কথিত আছে মহাবীর জৈনের মহাপ্রয়াণে তাঁর একজন অনুগত সঙ্গী নন্দীবর্ধন যখন খুবই ভেঙে পড়ে খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেন, তখন তাঁর বোন অনসূয়া তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে এসে বুঝিয়ে সুজিয়ে তাঁকে স্বাভাবিক করে তুলে কপালে রাজতিলক এঁকে দিয়ে তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করে তাঁকে রাজকার্যে উৎসাহিত করে তোলেন। ঘটনাচক্রে সেই দিনটি নাকি ছিল কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া; সেই থেকেই নাকি ভাইফোঁটার শুরু। তা ছাড়াও ভাইবোন হিসেবে যম ও যমী বা যমুনার মিথ চিরকালই চালু আছে। এই তিথিতে বোন যমুনার ব্রত উদ্‌যাপন, ভাই যমের দীর্ঘায়ু কামনা করে তার কপালে ফোঁটা দেওয়া থেকেই ভাই দ্বিতীয়ার শুরু এই মত আজও প্রচলিত।

নরকাসুরকে জয় করে আসা কৃষ্ণকে বোন সুভদ্রার ফোঁটা দেওয়ার প্রসঙ্গও উচ্চারিত হয় ভাইফোঁটা শুরুর সময়কাল হিসেবে। আর একটি কাহিনিও অনেকের মুখে ঘোরে এই প্রসঙ্গে, তা হলো পরাক্রমী বলী যখন বিষ্ণুকে পাতালে বন্দী করে ফেলেছিলেন তখন লক্ষ্মী বলীকে ভাই বলে মেনে নিয়ে বলির কপালে ফোঁটা এঁকে দেন। বিনিময়ে পান উপহার, আর তা হলো বিষ্ণুর নিঃশর্ত মুক্তি। প্রত্যেকটি ঘটনার দিনক্ষণ এক-কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। সেই থেকেই ভাইফোঁটার সূত্রপাত হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।

মিথ থেকেই হোক আর গল্পকথা থেকে, এই পর্বগুলো সংসারের প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসাকে বেঁধে রেখেছে ভালোবাসার বিনি সুতার বন্ধনে।

আঠারো বছর কার্তিকের শুক্লপক্ষের ভ্রাতৃদ্বিতীয়া অসম্পূর্ণ ছিল এই অভিবাসী জীবনে। সুপার ভিসার কল্যাণে আমার ছোড়দি এখন কানাডায় তাঁর মেয়ের কাছে।

ভাইফোঁটা
ভাইফোঁটা

‘নির্দয় বিধি রে তুমিই সদয় হইয়া
ভাইরে আইনো, নইলে আমার পরান যাবে জ্বইলা
তোরা কে যাস কে যাস...।’

বিধাতা সদয়। তাই বোনের উপস্থিতিতে এবার ভাইফোঁটা পূর্ণতা পেল। পিঠা-পুলি আর মিষ্টিতে, ধান-দুর্বার আশীর্বাদে কপালে নিলাম বোনের দেওয়া ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা। বোনেদের কাছে যা স্নেহ-মমতা ও সান্ত্বনার অমৃত মন্থন।

সময় হলে যেতে হবে, ভাইবোন সবাই জানি; ওপরে হাসেন অন্তর্যামী।

তবু ভাই-বোনের প্রতীক্ষার মিলনের এই পল, এই তিথির মঙ্গলদ্বীপ, সকল ভাইবোনেদের জীবনে ঘোচাক অন্ধকার।
...

হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব: টরন্টো, কানাডা। ইমেইল: <[email protected]>