সবুজ মেঘের ছায়া-তেরো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আজ অফিসে তেমন কাজ নেই। কেমব্রিজের প্রজেক্টটা নিয়ে বেশ ঝামেলায় আছে বলে হ্যামিল্টনের ফ্লিটচার কন্সট্রাকশন ফার্ম ছোট ছোট অনেক কাজ নিচ্ছে না। তাই মাল ডেলিভারির চাপটা কম। মাল ডেলিভারির চাপ থাকলে রাকিবেরও কাজের চাপ বেশি থাকত।

কেমব্রিজ থেকে ফিরে রাকিব প্রথমেই তাদের সার্ভিস ম্যানেজার ম্যালকম ফক্সকে রিপোর্ট করে। পরে নিচের ক্যাফেটেরিয়া থেকে স্যান্ডউইচ দিয়ে হালকা দুপুরের খাবার খেয়ে এখন সে তার চেয়ারে গা ছেড়ে বসে আছে। এখন সবে সোয়া একটা বাজে। রুমের হিটারটা চলছে হালকা এক ধরনের শো শো শব্দ করে। এ ছাড়া তাদের পুরো অফিস রুমটা প্রায় নিস্তব্ধ। তাদের এই অফিস রুমটায় পাঁচজন বসে। ছোট ছোট বক্সের মতো কেবিন বানিয়ে তারা আলাদা আলাদা বসে। রাকিবের মুখোমুখি কেবিনটা ডেভিড ইটনের।

ডেভিড ইটন মূলত আমেরিকান। টেক্সাসের। তার জন্ম সেখানে। বেড়েও উঠেছে সেখানে। তার বাবা টেক্সাসের, কিন্তু মা নিউজিল্যান্ডের। মার নাগরিকত্বের সূত্রে সে নিউজিল্যান্ডের নাগরিক হয়েছে।

ডেভিড ইটন রাকিবের পরে দুই বছর আগে ফ্লিটচার কোম্পানিতে জয়েন করেছে। এর আগে সে অকল্যান্ডের একটা কন্সট্রাকশন ফার্মে কাজ করত। অকল্যান্ডের কন্সট্রাকশন ফার্মটা বন্ধ হয়ে গেলে তার চাকরিটা আপনাআপনি চলে যায়। পরে সে এখানে এসে জয়েন করে।

ফ্লিটচার কোম্পানিতে জয়েন করার প্রথম দিন থেকেই রাকিবের সঙ্গে একধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটা শুধু মুখোমুখি কেবিনের জন্য নয়। কথাবার্তা ও ব্যক্তিত্বের কারণেও তাদের এই বন্ধুত্ব। ডেভিড ইটনও রাকিবের মতো চুপচাপ স্বভাবের। যদিও আমেরিকানরা জোরে শব্দ করে কথা বলে। নিউজিল্যান্ডের মানুষের মতো আস্তে নয়। ডেভিড ইটন নিউজিল্যান্ডের মানুষেরই স্বভাব পেয়েছে। তবে ইটনের প্রধান সমস্যা তার গার্লফ্রেন্ড ও নিউজিল্যান্ডের বিড়াল। আমেরিকার মেয়েরা নাকি সংসারজীবনে ছোটখাটো ব্যাপারগুলো বড় করে দেখে না। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের মেয়েরা তা দেখে। উনিশ থেকে বিশ হলেই সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটায়।

এখন পর্যন্ত ডেভিড ইটনের নিউজিল্যান্ডে যতগুলো গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছে, এদের প্রায় সবগুলোর সঙ্গে নাকি তার বিচ্ছেদ ঘটেছে বিড়ালের কারণে। প্রথম গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে ডাইনিং টেবিলে। এক সকালে সে অফিসে আসার সময় নাশতা করার জন্য বসে। তার গার্লফ্রেন্ডের বিড়ালটা বারবার তার পা ঘেঁষছিল বলে সে বিড়ালটাকে পা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তার গার্লফ্রেন্ড সেটা দেখে ফেলে। আর তা দেখে তো গার্লফ্রেন্ড অগ্নিশর্মা। পা দিয়ে বিড়ালটাকে সরিয়ে দেওয়া মানে তাকে অপমান করা...! ডেভিড ইটন অফিস থেকে ফিরতেই তার সেই গার্লফ্রেন্ড তার সঙ্গে বিনা নোটিশে সম্পর্ক কাট করে।

ডেভিড ইটনের দ্বিতীয় গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারটাও প্রায় একই রকম। রাতে তারা ঘুমিয়ে থাকলে তার গার্লফ্রেন্ডের বিড়ালটা তাদের ঠিক মাঝখানে জায়গা করে শুয়ে থাকত। এতে ডেভিড ইটন খুব বিরক্ত হতো। তার মনে হতো বিড়ালটা যেন তার সঙ্গে তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ঈর্ষা করে। সে বিড়ালটাকে যতই একপাশ করে দিত, বিড়ালটা ততই তাদের মাঝখানে এসে শুতো। আরও সমস্যা হতো, সে যখন তার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে বিছানায় সান্নিধ্যে যেত। বিড়ালটা রীতিমতো নখ দিয়ে আঁচড়াতে শুরু করত। ক্রোধান্বিতভাবে ডাকত, মিয়াঁও, মিয়াঁও, মি-ইয়াঁ-ও!

এক সকালে ডেভিড ইটন বিছানায় তার গার্লফ্রেন্ডের সান্নিধ্যে। আবেগ ও উত্তেজনা তখন তুঙ্গে। এমন সময় বিড়ালটা তাকে নখ দিয়ে আঁচড় দেয়। সেই আঁচড় সহ্য করতে না পেরে ডেভিড ইটন বিড়ালটাকে দেয় এক লাথি। ধড়াম করে একটা শব্দ হয়। বিড়ালটা রুমের দেয়ালে আঘাত খেয়ে মেঝেতে গিয়ে পড়ে। অবশ্য বিড়ালের তেমন কিছুই হয় না। শুধু মিয়াঁও শব্দ করে বিড়ালটা অভিমানে রুম থেকে চলে যায়। পরে যা হওয়ার ডেভিড ইটনের তাই হয়। সেদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে এসে ইটন দেখে, তার জিনিসপত্র সব লাউঞ্জের মেঝেতে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। তার গার্লফ্রেন্ডের অগ্নিমূর্তি। এর মানে তার আবার বিড়ালে কারণে বিচ্ছেদ...! ডেভিড ইটন তা মেনে নেয়।

ডেভিড ইটনের তৃতীয় গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে সম্পর্কের বিচ্ছেদের ঘটনাটা তো আরও ভয়ানক। পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। অথচ ঘটনাটা কিছুই ছিল না। ইটন ড্রাইভওয়ে থেকে তাড়াতাড়ি করে গাড়ি বের করার সময় গাড়ির চাকা তার গার্লফ্রেন্ডের বিড়ালের ওপর তুলে দিয়েছিল। গাড়ির চাকার নিচে পড়ে বিড়াল পিষ্ট হয়েছে, অন্যদিকে সে পিষ্ট হয়েছে গার্লফ্রেন্ডের যন্ত্রণায়। তাদের তো বিচ্ছেদ হয়েছেই, তাকে থানা-পুলিশ কোর্টকাচারি পর্যন্ত পোহাতে হয়েছে...!

ডেভিড ইটন এখন তার কেবিনে বসে মনোযোগ দিয়ে কী একটা কাজ করছে। খুব সম্ভব কম্পিউটারে ডেটা এন্ট্রি করছে। তার দৃষ্টিটা কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে। রাকিবের হাতে এখন কাজ নেই। ডেভিড ইটনের হাতে কাজ না থাকলে এখন গল্প করা যেত।

অফিসে কাজ না থাকলেও রাকিব এখন বের হতে পারছে না। ওয়েলিংটনের হেড অফিস থেকে কেমব্রিজের প্রজেক্টের ব্যাপারে লোক এসেছে। ওরা এখন সার্ভিস ম্যানেজার, ম্যানেজার ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারের সঙ্গে বোর্ড রুমে মিটিং করছে।

অন্য সময় হাতে কাজ না থাকলে রাকিব সাড়ে তিনটা-চারটার দিকে অফিস থেকে বের হয়ে যেতে পারত। কিন্তু আজ সে পারবে না। পাঁচটা পর্যন্তই অফিস করতে হবে।

রাকিবের মোবাইলটা তখনই বেজে উঠল। অপরিচিত নম্বর। ফোন ধরবে কী ধরবে না, বুঝতে পারল না। অফিসে থাকলে সে অপরিচিত নম্বরের ফোন ধরে না। অনেক সময় অফিসের কারও ফোন না হলে পরিচিত নম্বরের ফোনও ধরে না।

ফোন ধরবে না ধরবে না করে রাকিব কী মনে করে ফোনটা ধরল। ফোনের ওপাশের অপরিচিত গলাটা তৎক্ষণাৎ পরিচিত হয়ে উঠল। হেস্টিংস থেকে জাহিদ ফোন দিয়েছে।

জাহিদ অভিযোগ করল, রাকিব, তুমি তো ভুলেই গেছ। সেই যে হেস্টিংস থেকে তুমি যাওয়ার পর একবার কথা হলো, তারপর তো আর কথা হলো না। তুমি তো কখনো ফোনও দিলে না।

রাকিব সহজ গলায় বলল, আসলে তোমার নম্বরটা সেভ করতে ভুলে গেছি। একবার-দুবার মনে হয়েছিল তোমাকে ফোন দিয়ে আজমল স্যারের খবর নেই। কিন্তু সেভ না করাতে আর করতে পারিনি।

: অসুবিধা নেই। তবে ইচ্ছে যদি করতে, কারও কাছ ফোন নম্বরটা নিয়ে ফোন দিতে পারতে। কারও কাছ থেকে ফোন নম্বরটা নিয়ে ফোন দেওয়াটা কোনো ব্যাপারই ছিল না।

: হুম, তা অবশ্য ঠিক বলেছ। আসলে কী, আমার নিজ থেকে কাউকে সহজে ফোন দেওয়া হয় না। এটা আমার একটা বদ অভ্যাস বলতে পার।

ফোনের ওপাশে জাহিদ হেসে ফেলল। বলল, সরল স্বীকারোক্তি, তাই না? বেশ বেশ। এ জন্যই তুমি ব্যতিক্রম। তা বলো, কী খবর তোমার?

রাকিব বলল, কোনো খবর নেই। এখন অফিসে বসে আছি।

: ও, সরি সরি। রং টাইমে ফোন দিলাম।

: কোনো অসুবিধা নেই। আজ অফিসে কাজের কোনো চাপ নেই।

: আসলে একটা জরুরি বিষয়ে আলাপ করার জন্য ফোন দিয়েছি।

: জরুরি বিষয়, কী সেটা?

: আজমল স্যারকে নিয়ে।

: স্যারের আবার কী সমস্যা হলো?

: বিরাট সমস্যা হয়েছে।

: আবারও কোনো ঝামেলা বাঁধিয়েছেন?

: কোনো ঝামেলা বাঁধাননি। তবে তিনি একটা মহা ঝামেলায় পড়েছেন।

: কী ঝামেলা?

: ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত ঝামেলা।

: ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত কি ঝামেলা?

: হ্যাঁ, রাকিব। আজ আমাদের আপেল অরচার্ডে হাফ বেলা কাজ ছিল। বাসায় ফিরে লেটার বক্স চেক করে দেখি, ইমিগ্রেশন থেকে আজমল স্যারের একটা চিঠি। স্যার সঙ্গে সঙ্গে খুললেন। খুলে পড়েই আমার হাতে দিলেন। স্যারের হিউম্যানিটি গ্রাউন্ডের আবেদন বাতিল হয়ে গেছে।

: এখন উপায়?

: আর কোনো উপায় নেই।

: আজমল স্যারকে কি বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে?

: এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। হিউম্যানিটিজ গ্রাউন্ড হলো ইমিগ্রেশনের লাস্ট গ্রাউন্ড। ইমিগ্রেশন থেকে দুই সপ্তাহের সময় দিয়েছে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য। দুই সপ্তাহের পর তিনি এ দেশে পুরোপুরি অবৈধ।

: স্যার দুই সপ্তাহ পর যদি না যান?

: তুমি তো ভালো করেই জানো, ইমিগ্রেশন ও পুলিশ তখন বাসায় এসে হানা দেবে। স্যারকে ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে রাখবে। এ দেশে স্যারের যা অ্যাসেট আছে, সব নিয়ে তাকে এয়ারপোর্ট থেকে ডিপোর্ট করবে।

রাকিব ফোনের এপাশে চিন্তিতভাবে মাথা ঝাঁকাল। একবার তার মুখোমুখি কেবিনের ডেভিড ইটনের দিকে তাকাল। ডেভিড ইটন তখনো ব্যস্তভাবে কম্পিউটারে ডেটা এন্ট্রি করছে। তার তাকানোর কোনো ফুরসত নেই।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, স্যারকে নিউজিল্যান্ডে রাখার আর কোনো উপায় নেই, জাহিদ?

জাহিদ বলল, রাকিব, তুমি তো আমার আগে নিউজিল্যান্ডে এসেছ। তোমার জানার কথা, একবার যে এই সমস্যায় পড়ে, এর থেকে তার রিলিফ হওয়ার কোনো পথ নেই।

: জাহিদ, আমি তোমার অনেক আগে নিউজিল্যান্ডে এলেও এ রকম পরিস্থিতিতে আমি কখনো পড়িনি। আমার নিউজিল্যান্ডের নাগরিকত্ব হয়েছে খুব সহজে। আমি নিউজিল্যান্ডে নাগরিকত্ব পাওয়ার কষ্টটা বুঝতেই পারিনি।

: রাকিব, আমরা বুঝতে পেরেছি। খুব করেই বুঝতে পেরেছি। আমার তো তা-ও কপাল ভালো। কোনোমতে নিউজিল্যান্ডের নাগরিকত্ব হয়ে গেছে। কিন্তু আজমল স্যারের?

: অনেকে এ দেশে তো অবৈধ হয়েও দুই-চার বছর থাকে। আরও শুনেছি কেউ কেউ পাঁচ-সাত বছরও থাকছে। স্যার কি এভাবে থাকতে পারেন না?

: হ্যাঁ, পারেন। তবে তাকে লুকিয়ে থাকতে হবে। সবার আগে যে কাজটা করতে হবে, স্যারকে হেস্টিংস শহরটা ছাড়তে হবে। দূরের কোনো শহরে গিয়ে থাকতে হবে। যেখানে তাকে কেউ চেনে না। তা করতে হবে এই এক সপ্তাহের মধ্যে। এমনিতেই তিনি কয়েক মাস আগে একটা ঝামেলায় জড়িয়ে হেস্টিংস পুলিশ স্টেশনে নাম লিখিয়েছেন। এখানকার পুলিশ তাকে চিনতে এক সেকেন্ডও দেরি করবে না। এর সবটাই তো তুমি জানো। তুমিও সেদিন এখানে ছিলে।

রাকিব ফোনের এ পাশে আবার মাথা ঝাঁকাল। বলল, হ্যাঁ, জাহিদ। আচ্ছা, একটা কাজ করতে পার। আজমল স্যারকে তাওরাঙ্গা বা টিপুকি শহরে পাঠিয়ে দিতে পার। সেখানে তো অনেক পাঞ্জাবি অবৈধ অভিবাসী লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করে। অনেক অবৈধ বাঙালিও আছে। তারা পাঁচ-সাত বছর ধরেই থাকছে। আজমল স্যারকে ওখানে পাঠিয়ে দাও।

জাহিদ হতাশ গলায় বলল, রাকিব, তুমি কী যে বলো না! স্যারকে কোথাও পাঠালে কী তিনি কাজ করতে পারবেন। আমি এখানে আছি বলে আগলে রাখছি। সাইদ ভাইও খুঁজে খুঁজে কাজ বের করে দেন। নতুন শহরে তিনি একা গিয়ে কী করবেন? এ ছাড়া তিনি গাড়ি চালাতেও জানেন না। গাড়ি বাদে তিনি এত দূরে দূরে গিয়ে অরচার্ডে কীভাবে কাজ করবেন?

: এখন উপায়?

: আমিও তাই ভাবছি। তবে একটা উপায় আছে।

: কী উপায়?

: আমাকেও স্যারের সঙ্গে নতুন শহরে মুভ করতে হবে।

: তোমার হেস্টিংসের কাজ?

: এ ছাড়া উপায় কী, রাকিব? আমি ভেবেছিলাম, এই হেস্টিংসেই পলিটেকে গিয়ে একটা সার্টিফিকেট কোর্স করে কোনো একটা জবে ঢুকব। অরচার্ডের এই পরিশ্রম তো আর সারা জীবন করতে পারব না। তোমাদের মতো চাকরি খুঁজতে হবে। প্রয়োজনে অকল্যান্ড বা তোমাদের হ্যামিল্টনে চলে গেলাম। কিন্তু স্যারকে ফেলে এ মুহূর্তে কোথায় যাব? (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: