থ্যাংকস গিভিং ও ব্ল্যাক ফ্রাইডের আমেজ

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রে গত বৃহস্পতিবার ছিল থ্যাংকস গিভিং ডে। প্রতি বছর নভেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার আমেরিকায় থ্যাংকস গিভিং ডে উদ্‌যাপন করা হয়। পরদিন থাকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে। অর্থাৎ নভেম্বর মাসের চতুর্থ শুক্রবার হচ্ছে ব্ল্যাক ফ্রাইডে। এদিন জিনিসপত্র সবচেয়ে বেশি সেল থাকে (মূল মূল্য থেকে প্রায় অর্ধেক মূল্য) ও প্রচুর বিক্রি হয়। স্টোরগুলো খোলা থাকে মধ্য রাত থেকে।

অনেকে থ্যাংকস গিভিংয়ের পার্টি শেষ করেই বেড়িয়ে পড়েন কেনাকাটার জন্য। লিস্ট করে রাখেন আগে থেকেই। মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে কেনার জন্য। ভিড় লেগে যায় পার্কিংয়ে। আর পুলিশও সুযোগ খুঁজে কেউ একটু রং পার্কিং করলেই টিকিট। এদিন প্রচণ্ড ঠান্ডা থাকে। এ সময় ওয়েদার এমনই থাকে। কিন্তু তাতেও কেউ থেমে থাকে না। না উৎসবে, না কেনাকাটায়। যান্ত্রিক জীবনে এ যেন একটু নিশ্বাস নেওয়া। বিশেষ করে মধ্যম আয়ের মানুষেরা। স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে ব্ল্যাক ফ্রাইডে মানে জিনিস কেনার ধুম।

থ্যাংকস গিভিং ডেতে সরকারি ছুটি থাকে। ১৭৮৯ সালের ২৬ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন প্রথম জাতীয় পর্যায়ে থ্যাংকস গিভিং দিবসকে স্বীকৃতি দেন। ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন এই দিনটিকে প্রথমবারের মতো বার্ষিক ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। থ্যাংকস গিভিং দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো, সবাই একত্রিত হয়ে খাওয়া দাওয়া ও আনন্দের মধ্য দিয়েই সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানানো। পরিবার, প্রিয়জন ও আপনজনদের সঙ্গে নিয়ে খাওয়া হয় টার্কি। বন্ধু-বান্ধব হইচই আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন সবাই। অনেকে থ্যাংকস গিভিংয়ের পার্টি শেষ করেই ঘুমান না। মধ্য রাতেই বেরিয়ে পড়েন কেনাকাটার জন্য।

১৬২০ সালে ‘মে ফ্লাওয়ার’ নামের এক জাহাজে চড়ে ১০২ জন নানা ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে ধর্ম চর্চা করতে ইংল্যান্ড ছেড়ে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে বের হয়েছিলেন। কয়েক মাস পর তারা আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস উপকূলে এসে থামেন। যাত্রীদের অনেকেই অর্ধাহারে ও শীতের কোপে অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাদের মধ্যে যারা সুস্থ ছিলেন, তারা জাহাজ ছেড়ে তীরে এসে নামেন। ওখানেই তারা প্লিমথ নামে একটি গ্রাম গড়ে তোলেন। স্কোয়ান্তো নামের এক উপজাতি আমেরিকান ইন্ডিয়ানের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। স্কোয়ান্তো তাদের নিজে হাতে শিখিয়ে দেয় কীভাবে কর্ণ বা ভুট্টা চাষ করতে হয়। কীভাবে মাছ ধরতে হয়। কীভাবে ম্যাপল গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে হয়।

১৬২১ সালের নভেম্বরে প্লিমথবাসী তাদের উৎপাদিত শস্য কর্ণ সফলভাবে নিজেদের ঘরে তুলতে পেরেছিল। তাদের ফলন এত বেশি ভালো হয়েছিল যে, গভর্নর উইলিয়াম এ উপলক্ষে সব আদিবাসী ও নতুন প্লিমথবাসীর সৌজন্যে ভূরিভোজের আয়োজন করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে সবাই প্রথমে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান তাদের সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার এবং এমন সুন্দর শস্য দান করার জন্য। তারপর উপস্থিত সবাই সবাইকে ধন্যবাদ জানান সারা বছর একে অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য। এই অনুষ্ঠানটিই পরে আমেরিকার প্রথম থ্যাংকস গিভিং ডে হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

এবার ভেবেছিলাম এই ঠান্ডার মধ্যে থ্যাংকস গিভিং ডেতে কোথাও যাব না। কিন্তু নিউইয়র্কে থাকে আমার ভাগিনা রিয়াদ। সে বলল, আন্টি চলে আসো। সকাল ১০টার দিকে নিউজার্সি থেকে আমরা রওনা হলাম। নিউইয়র্কের কাছাকাছি গিয়ে দেখি জ্যাম। বোঝাই যাচ্ছে সবাই দাওয়াত খেতে যাচ্ছে। গাড়ি চলছে পিঁপড়ার মতো।

আমার পাশের লেনে দেখি গাড়ির ভেতর থেকে একটা বাচ্চা আমাকে হাই করছে। প্রথমে ভাবলাম আমাকে না হয়তো অন্য কাউকে। কারণ গাড়ির জানালা বন্ধ। আওয়াজ আসছে না, তবে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। হাত নাড়ছে। পরে দেখি আমাকেই বলছে। আমিও তাকে স্বাগত জানালাম। লাভ সাইন দেখালাম হাত দিয়ে। বাচ্চাটি আমাকে বেলুন দেখাল। টার্কি ড্রেস দেখাল গাড়ির ভেতর থেকে। যেন বোবা দুজন মানুষ ভালোবাসা বিনিময় করছি সাইন দেখিয়ে। ওর মা সম্ভবত পাশে ছিল। তিনি দেখছেন আর হাসছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত জ্যামে পাশাপাশি লেনে ছিলাম ওই অচেনা বাচ্চাটির সঙ্গে সময়টা কেটেছে।

নিউইয়র্কে আমরা পৌঁছাই প্রায় ১২টার দিকে। দেখি রিয়াদ ও ওর স্ত্রী জিনিয়া অনেক কিছু রান্না করে রেখেছে। বলল, এবার টার্কি না মুরগি রান্না করেছি। দেখলাম দেশে ঈদে যে রকম রান্না, সেরকম বিভিন্ন আইটেম রান্না করে রেখেছে। বলল, প্রতি বছর তো টার্কি খাও এবার মুরগি খাও। পোলাও, মুরগি, ইলিশ মাছ, কাবাব, ঝাল খাসির মাংস। আহা, যেন দেশেই দাওয়াত খেলাম।

খাওয়া শেষে একটু বের হলাম। বাংলাদেশি দোকানে যাব, দেখি প্রায় সব দোকান বন্ধ ছুটির কারণে। আর রাস্তা একেবারে ফাঁকা। দুই-তিনটা দোকান খোলা ছিল। একটা দোকানের সামনে গাড়ি পার্ক করেই ভেতরে গেলাম কিছু মিষ্টি ও দই কিনলাম। ফিরে এসে দেখি রং পার্কিংয়ের জন্য পুলিশ টিকিট দিয়েছে ১১৫ ডলার। উফ, এই পুলিশ যে কোথা থেকে এল। তারা ওত পেতে থাকে। ফাঁদ পেতে ইঁদুর যেমনে ধরে তেমনি আমেরিকান পুলিশগুলোও এ রকম। আসলে তাদের ডিউটি তারা সর্বোচ্চভাবে পালন করে। এর ভালো দিক হচ্ছে জনগণ চাইলে ইচ্ছামতো যা খুশি করতে পারে না। আইন ভঙ্গ করলেই শাস্তি। ফলে জনগণ মেনে চলতে বাধ্য।

বারো রকম মানুষ বাস করে আমেরিকায়। আইন কঠোর না হলে চলবে কেমন করে। হাসছিলাম আর ভাবছিলাম, দশ মিনিটের জন্য গাড়িটা ঠিক জায়গায় পার্ক করলেই হতো। দোকানের সামনে অ্যালাউ না। ভেবেছিলাম অল্প কিছু সময়, ফলাফল ১১৫ ডলার ফাইন। হ্যাঁ, এটাই আমেরিকা। দোকান থেকে আবার রিয়াদের বাসায় গেলাম। বললাম টিকিটের কথা। ওরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। বলল, দই মিষ্টি কিনলে ৫০ ডলার, আর ফাইন ১১৫ ডলার। তোমার লাভের চেয়ে লোকসানের খাতা ভারী। সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলাম রিয়াদের বাসায়। অনেক আনন্দ হলো। আসলে এই প্রবাসে এই আনন্দের মূল্য অনেক।

পরে রওনা হলাম বাসায়। পথে আসতে আসতে ভাবছিলাম, আমার হয়তো আপনজনরা এখানে আছে, তাই আনন্দ করতে পারি। কিন্তু যারা একা থাকেন, পরিবার ছাড়া, যাদের যাওয়ার মতো তেমন কেউ নেই তাদের কেমন লাগে! জীবনের প্রয়োজনে সে মানুষগুলো আনন্দ হারিয়ে যায় ব্যস্ততার ভিড়ে। এটাই বাস্তবতা। এটাই প্রবাস জীবন।