ম্যাপল ঝরে যাওয়ার মানচিত্র

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

লং আইল্যান্ডের গলিপথে হেঁটে যেতেই হঠাৎ চোখে পড়ল, স্বচ্ছ ও মৃদু স্রোতস্বিনী টলটলে লেকের জলে ভেসে যাচ্ছে লাল, সবুজ, হলদে আর খয়েরি ম্যাপলের দল। মেঘবাড়ি ভেদ করে রংধনুর মিঠাই রং চোখেমুখে আলতো করে মিহি আলো ছড়িয়ে গেল। এই ফল সিজনে ঝরাপাতার গল্প, রং করা বসন্ত দিন, অবশেষে উজান গাঙে ফেলে আসা শালুক দিন, চিঠির ঘ্রাণ, সলতে পোড়ানো হারিকেনের ধিপধিপ আলো, হাটবারে চটের ব্যাগে বাজারের বড় ইলিশ, উঠোন ঘরের চৌকিতে পৌরাণিক গল্পকথা আর আদিম বাউলিয়ানার কাছেই চুপিচুপি ফিরে যাওয়া। আমার আমিতেই সহজ সমর্পণ!

লেক থেকে আরেকটু সামনে এগোলেই বন্ধু মৌটুসীর বাড়ি। মাঝে মাঝে অকারণেই বিষণ্নতা জাপটে ধরে। আজ সকালটায় ধোঁয়া ওঠা চা, জয়তীর গান আর এক আঁজলা শিউলিও মন ভালো করার কারণ হতে পারেনি। সোনারোদও না! রেহাই পেতে ড্রাইভ করে ওর কাছেই চলে এসেছি। পথে সবুজ পাতা কানাকানিতে বলল, ‘ঝরে যাওয়া মানেই নতুনের আবাহন, দেখে নিয়ো ফুল ফোটার দিনে ব্যালকনির কর্নারে আমাকেই আগে দেখতে পাবে। আদর করে কোঁচড়ে তুলে নিয়ো।’

লাল, খয়েরি পাতাগুলো আরও বর্ণিল হতে হতে টুপটাপ ঝরে পড়ছে। রংটুকু ছড়িয়ে যাচ্ছে মন থেকে মনে। কেউ ফ্যাশন হাউস থেকে বাহারি পোশাকে যাচ্ছে ডেটিংয়ে। কেউ বা অতীত অভিমান ভেঙে হাতের রাখি বদল করছে। এমনও হয় ঘর বাঁধব বাঁধব করে কখন যে বেলাটুকু পোহায় ঠাহর করতে পারে না অনেকেই। বন্ধুত্বেই কেটে যায় এক জীবন। আর ক্যারিয়ার! সংসার নামক বিষয়টি আজকাল ব্যাকডেটেড সেন্টিমেন্ট। ঘটা করে বিয়ে। ভিন্ন আমেজে রং করা নতুন দিন!

মৌটুসী বেশ কয়েক বছর ধরেই সিঙ্গেল প্যারেন্টিং করছে। ওর তিন বছরের বেবি নামিরাহকে নিয়ে একলা জীবন। সবকিছু একা সামলে নিচ্ছে। এক কঠিন জীবন! অথচ ইউনিভার্সিটির তুমুল দিনগুলোতে রাজনীতি, মিটিং মিছিলে ওরা ছিল অক্লান্ত সৈনিক। জীবনযুদ্ধের কঠিন সময়টুকুতে একসঙ্গে থাকবে বলে প্রতিজ্ঞাও করেছিল।

কিংশুক বেশ সুদর্শন। দরাজ গলা। সহজেই ভক্ত জুটে যায়। রমরমা শ্যাম্পেইন নাইটে কাচের দেয়ালে প্রতিফলিত হয় নর্তকীর আর্তনাদ, বুকের ক্ষরণ! অতি আনন্দের একটা কালো ছল থাকে ঠিক জীবন ঘেঁষা নয়, জীবনের বাইরে এক বিভীষিকাময় জীবন। কান্নাটুকুও যার যার, বাইরের মানুষের কতটুকুই সাধ্য অমন অতল সমুদ্র ছুঁয়ে যাওয়ার। যে ফিরে গেছে, সে চাইলেই পুরোনো পথে হাঁটতে পারে না। ততক্ষণে যে হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি কপাট প্রকৃতির ইশারাতেই বন্ধ হয়ে গেছে।

ঘর ভাঙার অচিন ঘরে কে ফিরতে চায়। মৌটুসীকে খেলাঘর বানানোর অছিলায় প্রায়ই বলি, ‘বাবুই পাখির মায়াবী ঘরে ফিরে আয় আবার...’। ও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে! চোখদুটো বলে দেয়, সব ফেরায় ঘর থাকে না, থাকতে নেই। যে চলে গেছে, ফিরবে না জেনেই গেছে। যদিও বা ফিরে সে তো আদল অবয়ব নয়। নিজেকে অন্য কোথাও রেখে আসা ভিন্ন একজন।

আদা চা নিয়ে বসেছি, জানলা ঘিরে। ওই দূর দেখা যায় ম্যাপল পাতার ঝরে পড়ার উৎসব। ছিটেফোঁটা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছে পোড়া দহন। ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজছে—

‘ভ্রমর কইও গিয়া, শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া...’

মুখরিত জীবন। ঘর না থাকার ঘর জুড়েও বেঁচে থাকে উৎসব। তখন নিকষ কালো আঁধার, ঝিঁঝির সানাই, হঠাৎ উঠোন ঘিরে মায়াবী জোছনা বুক পাঁজরে তানপুরা বাজায়। প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণও অলিখিত এক মেডিটেশন। পূর্বাহ্ণের ডানাভাঙা পাখিটাও বাঁচতে শেখে।

ভোর নামে। কুয়াশার পথটুকুতে কিছুই দেখছি না আর। তবুও হাঁটতে থাকি। পথ জানা নেই। আধো আধো আলোতে অদূরেই দেখতে পাই ছন দিয়ে ঘেরা কটা ঘর, একটি বিছরা আর পেছনটায় হিজল পুকুর। সহজ মানুষদের প্রাচীন ঘ্রাণটুকুর কাছে ভিড়তে ভিড়তেই হারাতে থাকে বুকের ব্যথা, পাহাড়ঘেরা দুর্বোধ্য কষ্টবোধ। মৌটুসীর সপ্রতিভ চোখের কোনায় দুফোটা জল! কখনো হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি প্রকোষ্ঠই যেন এক একটি নয়া ঘর! শুধুই আপনা মাঝে বিলীন হওয়ার।

চলো অনিন্দ্য, আমরা আঁকি...
অগোচরে হারিয়ে যাওয়া আকাশের এক মুঠো নীল
শালবন, বৃক্ষছায়া
হেমন্তবেলায় ফোটা ফোটা বৃষ্টির ছাঁট...
মেঘের-ভোর...
ম্যাপল ঝরে যাওয়ার মানচিত্র!