প্রতিভা বিকাশের পাথেয় গাকুয়েন্সাই

স্কুল ফেস্টিভ্যালের একটি দৃশ্য
স্কুল ফেস্টিভ্যালের একটি দৃশ্য

বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা নিজেদের মেধার প্রমাণ দেয় মুখস্থবিদ্যার প্রাপ্ত সিজিপির মাপকাঠিতে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে প্রতিভাবান মেধাবীরা তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ স্কুল কলেজে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে কতটা পায় তা নিতান্তই ভাবার বিষয়। মোটা মোটা বইয়ের ভারে, পরীক্ষা আর ভালো রেজাল্টের দৌড়ে প্রতিভা নিয়ে ভাবার সময় কই! শিক্ষা আর শিক্ষার্থীদের প্রতিভা আর মেধা প্রয়োগের দৃশ্যায়নটা কিছুটা ভিন্ন জাপানিদের। জাপানিরা দেখতে এতটাই নিরীহ আর সাদাসিধে যে, সত্যিই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়ে যাবে, তাদের দ্বারা কোনো কিছু কী সম্ভব! কিন্তু বাস্তব হলো এরা স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় যা পড়ে কিংবা যা করে তা আমাদের জানা আর শিক্ষার অনেক ওপরে।

স্কুল ফেস্টিভ্যালের একটি দৃশ্য
স্কুল ফেস্টিভ্যালের একটি দৃশ্য

আমার এ গল্প জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবছর নিয়মিত হয়ে আসা স্কুল ফেস্টিভ্যাল নিয়ে। জাপানিজরা বলে গাকুয়েন্সাই। কারিকুলামের লেখাপড়ার বাইরে জাপানি শিক্ষার্থীদের মেধা, মনোনয়ন, প্রতিভা, দায়িত্বশীলতার এবং পরিশ্রমী হওয়ার বহিঃপ্রকাশ হলো এই গাকুয়েন্সাই। প্রতিবছর নভেম্বর মাসে পর পর তিন দিনকে বেছে নেওয়া হয় এই অনুষ্ঠানের জন্য। নভেম্বর জাপানে অটামের মাস (আমরা যাকে হেমন্ত বলি), প্রকৃতি বদলে যেতে থাকে এ সময়। শীত শীত একটা আমেজ চারপাশে। গাছে গাছে সবুজ পাতা বদলে যেতে থাকে হলুদ আর লালে। আর তাই এই সময়টাকেই আরও উৎসবমুখর করতে আয়োজক কমিটি নভেম্বর মাসকে বেছে নেন স্কুল ফেস্টিভ্যাল আয়োজনের জন্য। এই আয়োজনকে সত্যিকার অর্থে জমজমাট করতে প্রায় ৮ থেকে ১০ মাস লাগাতার কাজ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজক কমিটি। এর তত্ত্বাবধানে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট লেভেলে পড়া শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন বর্ষে পড়া শিক্ষার্থীদের ওপর বর্তানো থাকে বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব। আর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা নিয়োজিত থাকে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সার্বিক কর্মকাণ্ডে। নির্দিষ্ট জায়গায় সাইকেল পার্কিং, নিরাপত্তা, বহিরাগত দর্শনার্থীদের দিক নির্দেশনা, ময়লা আবর্জনা ব্যবস্থাপনা, প্রদর্শনী, অনুষ্ঠান পরিচালনা, গাকুয়েন্সাইয়ে অংশ নেওয়া বিভিন্ন স্টলের খাবার ব্যবস্থাপনার বিষয়সহ যাবতীয় জায়গায় বিভিন্ন দলের দায়িত্বে থাকে এই সকল শিক্ষার্থীরা। ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে এ সময় কড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাত জেগে অতিরিক্ত পাহারার সামালও দেয় এই শিক্ষার্থীরাই।

স্কুল ফেস্টিভ্যালের একটি দৃশ্য
স্কুল ফেস্টিভ্যালের একটি দৃশ্য

দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা মঞ্চে সরাসরি অংশগ্রহণ করে। লাগাতার কয়েক মাস ধরে প্রতিদিন চলে রিহার্সাল। প্রত্যেক শিক্ষার্থী জড়িত থাকে গান, নাচ, থিয়েটার কিংবা মিউজিক ক্লাবের সঙ্গে। জাপানের সব শিল্পীই কোনো না কোনো ইউনিভার্সিটির ক্লাব থেকেই বের হয়ে আসে। আর তাই এই ক্লাবগুলোতে চলে চর্চার মাধ্যমে সুনাম অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টা। ফলে ফেস্টিভ্যালে দেখা যায় চোখধাঁধানো চমৎকার কিছু পারফরমেন্স। নাচ, গান, মিউজিকে থাকে আলাদা সব আয়োজন। অসাধারণ বিটবক্সিং অথবা ফোক, রক গান বিমোহিত তো করবেই, জ্যাজ মিউজিক, পিয়ানো কিংবা ভায়োলিনে তোলা বিভিন্ন মুডের টিউন কিংবা স্ট্রিট শোর গান কিংবা কৌতুক অভিনয়, কোনো অংশেই কম আনন্দ দেবে না। একই সময় ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় চলতে থাকে লাগাতার অনুষ্ঠান। কোথাও গান গায় একদল। এর কাছেই কোথাও চলে অভিনয়। একটু দূরেই হয়তো কারও গিটারের তারের ঝংকারে বাতাসে ভাসে চেনা কোনো সুর। এমন নানান আয়োজনে সময় কোথা দিয়ে পালিয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না।

স্কুল ফেস্টিভ্যালের একটি দৃশ্য
স্কুল ফেস্টিভ্যালের একটি দৃশ্য

তিন দিনের এই আয়োজনকে উপভোগ করতে সর্বসাধারণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সুযোগ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্যও এ এক অমূল্য সুযোগ—বিশ্ববিদ্যালয়কে জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন ও নতুন মেধার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। এই পরিচিত পর্বটা চলে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে, ভিন্ন ভিন্ন ল্যাবরেটরির কাজের পরিচিতিমূলক পোস্টার ও প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে। আর সঙ্গে থাকে ভিন্ন সব ল্যাবের মজাদার কিছু কাজের নমুনা। এ ছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা রিওগাকসেরা (আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী) এই ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ করেন তাদের নিজস্ব দেশীয় কায়দায় রান্না উপহার দিয়ে। যার ফলে ভিন্ন ভিন্ন দেশ তাদের দেশ ও সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করতে পারে আর জাপানিরাও সবার একটা পরিচিতি পায়। জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাও সময় ও সুযোগ অনুযায়ী অংশগ্রহণ করে থাকে এই স্কুল ফেস্টিভ্যালে। এর মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, চীন ও উজবেকিস্তানসহ অন্য সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও পরিচিতি পায় বাংলাদেশি খাবার—তন্দুরি চিকেন, কাবাব, নান কিংবা মসলা চা পরিবেশনের মাধ্যমে।

স্কুল ফেস্টিভ্যালের একটি দৃশ্য
স্কুল ফেস্টিভ্যালের একটি দৃশ্য

সবচেয়ে বেশি শিক্ষণীয় বিষয় হলো, এই স্কুল ফেস্টিভ্যাল শেষে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি। গাকুয়েন্সাইয়ের শেষ দিন সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান রীতিমতো মতো চমকে দেওয়ার মতো। আর তিন দিনের এত আয়োজনের সামান্যতম কোনো কিছুই পাওয়া যাবে না পরের দিন সকালে। পরদিন আর দশটা দিনের মতোই নিয়মিত কর্মব্যস্ত একটা দিন। এটা কেবল সম্ভব জাপানিদের পরিশ্রমী মানসিকতা আর কঠোরভাবে নিয়মকে মেনে চলার মাধ্যমে। বইয়ের পড়াশোনার বাইরেও যে পরিশ্রম, শিক্ষা আর সংস্কৃতিকে সম্মান দেখিয়ে, কাজে লাগিয়ে প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ মেধাবী জাতি তৈরিতে এগিয়ে যাওয়া যায়, জাপান থেকে এ শিক্ষাটি আত্মস্থ করে নেবার ব্যাপারটি ভাবলে লাভ বই ক্ষতি হবে না।

স্কুল ফেস্টিভ্যালের একটি দৃশ্য
স্কুল ফেস্টিভ্যালের একটি দৃশ্য


...

কোহিনূর কেয়া: শিক্ষার্থী, টোকিও ইউনিভার্সিটি অব এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, জাপান।

স্কুল ফেস্টিভ্যালের একটি দৃশ্য
স্কুল ফেস্টিভ্যালের একটি দৃশ্য