সবুজ মেঘের ছায়া-বাইশ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাকিব আর নদী হাসপাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেলটা প্রায় পড়ে এল। শীতের বিকেল। সাড়ে পাঁচটা বাজতে না বাজতেই বিকেলটা পড়ে আসে। ছয়টার আগেই সন্ধ্যা নেমে যায়।

বৃষ্টি না হলেও প্রকৃতিতে এখনো ভেজা ভাব। বিকেলটা পড়ে আসার কারণে হাসপাতালের বাইরে কার পার্কে একধরনের স্তব্ধতা নেমেছে। শনিবার বলে অনেক পার্কিং ফাঁকা পড়ে আছে। রাকিব একটা পার্কিংয়ে গাড়িটা পার্ক করে নদীকে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকল। হাসপাতালে ঢুকে সরাসরি পাঁচতলায় প্রফেসর ড. নিকোলাস রজারসনের কেবিনে চলে গেল।

কিন্তু ওরা প্রফেসর রজারসনের কেবিনে ঢুকতে গিয়ে দেখল, তাঁর কেবিনে পাঁচ-ছয়জন দর্শনার্থী। নদী ফিসফিস করে বলল, স্যারের কেবিনে যারা এসেছেন, তাঁরা আমাদের ডিপার্টমেন্টের টিচার।

রাকিব বলল, আমি তাহলে বাইরে দাঁড়াই।

নদী জিজ্ঞেস করল, কেন?

: তাঁরা তোমার ডিপার্টমেন্টের টিচার। আমার এখন কেবিনে গিয়ে লাভ কি? তুমি বরং ভেতরে যাও। তাঁরা বের হলে আমি কেবিনে ঢুকব।

: আপনি একা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন?

: এখানে একা দাঁড়িয়ে থাকার কী আছে? আমি তো দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকব। তুমি যাও।

নদী মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আচ্ছা। বলেই সে কেবিনের ভেতরে ঢুকে গেল।

রাকিব কেবিনের পাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। করিডর ধরে ডাক্তাররা আসা-যাওয়া করছেন। নার্স-আয়ারা ব্যস্ত হয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন। করিডরের জানালা গলে পড়ন্ত বিকেলের ধূসর-সাদা আলো ঢুকছে। এক বৃদ্ধ রোগী হুইল ওয়াকার ঠেলে ঠেলে হাঁটছেন। আরেক বৃদ্ধ রোগী পাশের কেবিন থেকে কাশছেন খুক খুক, খুক খুক।

রাকিব জানে, নিউজিল্যান্ডের বৃদ্ধ–বৃদ্ধাদের এ একটা কষ্ট। বৃদ্ধ বয়সে ও মৃত্যুর সময় তারা কখনই ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিত থাকেন না। আর তারা ওভাবেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন। এ জন্য নিউজিল্যান্ডের প্রতিটা শহর, শহরতলি ও সাবার্বে বৃদ্ধদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখা থাকে। ওল্ড হোম, রিটায়ারমেন্ট হোম, রিটায়ারমেন্ট ভিলেজ, রেস্ট হোম, আরও কত কী! এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন হাসপাতালেও বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। যারা নিজস্ব বাড়িতে থাকেন, তাদের জন্য প্রয়োজনে সার্বক্ষণিক পার্সোনাল কেয়ারার রাখা হয়। ডাক্তার-নার্স সময়-সময় এসে দেখে যান।

রাকিব নিজে নিজে মাথা নাড়ল। ভাবল, একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার জন্য যতই সুযোগ-সুবিধা থাকুক, তাদের যতই ডাক্তার-নার্স-আয়া সেবাযত্ন করুক, তাদের মনের শান্তি ও মনের আকুতি তো কেউ মেটাতে পারেন না। নার্স-ডাক্তাররা আসেন ওষুধপত্র দিতে, চিকিৎসা করতে। পার্সোনাল কেয়ারার বেতনভুক সেবা করেন। কিন্তু সেই বৃদ্ধ বয়সে নাতি-নাতনির কোলাহল, ছেলেমেয়েদের ভালোবাসা, পাড়াপড়শি ও আত্মীয়স্বজনদের মমতা-আন্তরিকতা, তারা কোথায় পাবেন?

রাকিব মাঝেমধ্যে নিজের ব্যাপারে ভাবে। বৃদ্ধ বয়সে সে বাংলাদেশে চলে যাবে। তাদের গ্রামে গিয়ে গোমতি নদীর পাড়ে একটা ছোট্ট বাড়ি বানাবে। ঘরটা থাকবে গোমতির দিকে মুখ করা। আত্মীয়স্বজন তার তেমন না থাকলেও কাজীবাড়ির অন্য লোকজন ও পাড়াপড়শি তো আছে। সে তাদের স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা নেবে। প্রতিটা বিকেলে একটা ছড়ি হাতে সে নদীর পাড় ধরে হাঁটবে। গোমতির দীর্ঘ পাড়ে দিঘল ছায়া ফেলে হাঁটতে গিয়ে কী একটা চমৎকারিত্বই না ফুটে উঠবে...!

রাকিবকে বেশিক্ষণ কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো না। নিকোলাস রজারসনের কেবিন থেকে মানুষগুলো বেরিয়ে গেলেন। নদীও বাইরে এসে রাকিবকে নিয়ে আবার কেবিনে ঢুকল।

কেবিনে ঢুকতেই একরাশ তাজা ফুলের গন্ধ রাকিবের নাকে এসে লাগল। রাকিব দেখল, প্রফেসর রজারসনের সিথান বরাবর ছোট্ট টেবিলটায় গুচ্ছ তাজা ফুল।

রাকিব তাজা ফুলগুলোর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে প্রফেসর রজারসনের দিকে তাকাতেই তিনি একটা দিঘল হাসি দিয়ে বললেন, হ্যালো ইয়ং পোয়েট, তোমার কী খবর?

রাকিব মৃদু হেসে বলল, জি ভালো। আপনি এখন কেমন আছেন?

প্রফেসর রজারসনের সিথানের বালিশটা একটু পেছনে ঠেলে ঠিক হয়ে বসে বললেন, ফুসফুসে নাকি পানি জমেছে। পানি নাকি ঘট ঘট করে। এ অবস্থায় কেমন আছি, বুঝতেই পারছ।

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে চেহারা বিষণ্ন করে বলল, জি, বুঝতেই পারছি।

প্রফেসর রজারসন হেসে বললেন, তুমি কিছুই বুঝতে পারনি। আসলে আমি ভালো আছি।

: জি, সেটা কেমন?

: দেখ, এ বয়সে ফুসফুসে পানি জমবে না তো কী পাথর জমবে? হা হা হা। তুমি চেহারা এমন বিষণ্ন কর না। ওই যে চেয়ারটা আছে। টেনে বস।

রাকিব জি বলেই চেয়ারটা টেনে বসল। নদী বেডের একপাশে বসল।

প্রফেসর রজারসন নদীর দিকে তাকিয়ে বললেন, বল, তোমার আজ ট্রেনিং কেমন হলো?

নদী মৃদু হেসে বলল, ভালোই স্যার। আসলে ট্রেনিংয়ের কিছুই ছিল না। এসব মিনিমার্ট বা ডেইরি শপগুলোতে কাস্টমার খুব কম আসে। তারপরও আমি আস্তে আস্তে শিখে যাব। আগামী সপ্তাহে আবার যাব।

: তুমি কাজ শুরু করবে কবে থেকে?

: দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যেই শুরু করে দেব। আগামী সপ্তাহে আমাকে অফিশিয়াল কাজগুলো শেখাবে।

: তাই, বেশ ভালো।

নদী এক মুহূর্তের জন্য চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল, স্যার, আমাকে হাসপাতাল থেকে ফোন দিয়েছিল। আপনি নাকি কী জরুরি কথা বলতে চান?

প্রফেসর রজারসন মৃদু হেসে বললেন, আরে, তেমন জরুরি না। খুব জরুরি হলে আমি তো তোমাকে আমার মোবাইল থেকেই ফোন দিতে পারতাম। আমি এমনই নার্সকে বলেছিলাম, আই ওয়ান্ট টু টিক উইথ মাই নেক্সট অব কিন অ্যাবাউট মাই সিচুয়েশন। নার্স তো সেটা সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছে। নেক্সট অব কিন তো তুমি। তাই হাসপাতাল থেকে তোমাকে ফোন দিয়ে বসেছে।

নদীও মৃদু হাসল। বলল, স্যার, আসলেই কি কোনো সিরিয়াস মেটার নয়?

: আরে না। আমার কী সিরিয়াস মেটার থাকবে। তবে হ্যাঁ, আমি যেদিন মারা যাব, সেটা সিরিয়াস মেটার হবে। সেদিন তোমাকেই কিন্তু সবার আগে ফোন দেবে। ইমার্জেন্সি কন্টাক্টেও কিন্তু তোমার নাম দেওয়া।

: স্যার, এভাবে বলবেন না।

: কেন, এসব কথা শুনলে কি মন খারাপ হয়ে যায়?

: জি, মন খারাপ হয়ে যায়।

প্রফেসর রজারসন বেশ শব্দ করে হেসে উঠলেন। বললেন, আচ্ছা, বলব না। আসলে গত তিন দিন ধরে তুমি হাসপাতালে আসনি তো, তাই তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল। আমার আরও ভালো লাগছে, তুমি ইয়ং পোয়েটকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ।

নদী বলল, আমি হাসপাতালে না এলেও দুই দিন আপনার বাসায় গিয়েছি। বাসাটা চেক করে এসেছি।

: বাসার সব ঠিক আছে তো?

: জি, স্যার। সব ঠিক আছে।

: আমার বাসার ডেকটা?

নদী হেসে ফেলল। বলল, জি স্যার।

প্রফেসর রজারসন বললেন, আমি আমার ডেকটাকে খুব মিস করছি। এখন কি জ্যোৎস্না চলছে?

নদী বলল, আমি ঠিক খেয়াল করিনি স্যার।

রাকিব বলল, না, স্যার। এখন অমাবস্যা।

প্রফেসর রজারসন বললেন, আহা, সেদিন তোমাকে বলেছিলাম, আমরা ডেকে বসে অমাবস্যা দেখব। অমাবস্যার একটা দারুণ সৌন্দর্য আছে। যে সৌন্দর্য শুধু অনুভব করা যায়। গত অমাবস্যাটা মিস করেছি। এবারের অমাবস্যা তো তাহলে মিস করে ফেললাম।

রাকিব বলল, নেক্সট অমাবস্যাটা দেখব। প্রমিজ।

প্রফেসর রজারসন বলল, ইয়ং পোয়েট, তুমি প্রমিজ শব্দটা বলো না।

: কেন স্যার।

: তুমি বলেছিলে, একদিন তুমি আমার ডেকে বসে জ্যোৎস্না দেখবে। তাও আবার সামারের মধ্যে। কিন্তু সামার কবে চলে গেছে। অটাম গিয়ে এখন উইন্টার। জ্যোৎস্না আর দেখা হলো না। সেই তুমি এখন বলছ অমাবস্যা দেখবে?

রাকিব একটা লজ্জার হাসি দিল। বলল, সরি স্যার। এবার মিস হবে না। আপনি সুস্থ হয়ে বাসায় আসুন।

প্রফেসর রজারসন বললেন, আমি তো সুস্থই। আমাকে শুধু শুধু হাসপাতালে আটকে রেখেছে।

নদী একটু অধিকারের গলায় বলল, হয়েছে স্যার। আপনাকে শুধু শুধু হাসপাতালে আটকে রাখা হয়নি। আপনি নিজেকে নিয়ে এতটা অবহেলা করলে হবে না।

প্রফেসর রজারসন মৃদু হেসে বললেন, দেখ ইয়ং পোয়েট, এই পাগলিটা বলে কী? এরই মধ্যে সেও আমার শত্রু হয়ে উঠেছে। আমাকে হাসপাতালে আটকে রাখতে চায়। আমার বাড়ি ও আমার সেই ডেকটা যে ফাঁকা পড়ে আছে, সেটার ব্যাপারে কারও দুঃখ নেই। একটু আগে তুমি বললে, এখন পুরো অমাবস্যা চলছে। কুয়াশায় ঢাকা কনকনে শীতের রাতে ডেকে বসে খোলা আকাশের নিচে অমাবস্যা দেখার আনন্দটা যে আমি মিস করছি, ওটা তাকে কে বলবে?

নদী বলল, আপনি আগে সুস্থ হয়ে উঠুন। এ রকম অমাবস্যা অনেক দেখা যাবে।

: হাসপাতালে থাকলে আমি কখনোই সুস্থ হব না। বাসায় গেলে এক নিমেষেই সুস্থ হয়ে যাব। বিশ্বাস না হলে আমাকে একবার বাসায় নিয়ে চল।

: আপনি পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি অন্তত আপনাকে বাসায় নিব না।

: আমি তোমার কথা শুনতে গেলে তো!

: জি, আপনাকে আমার কথাই শুনতে হবে।

প্রফেসর রজারসন আবার বেশ শব্দ করে হেসে উঠলেন। বললেন, নদী, তুমি ঠিক আমার মার মতো অধিকার খাটাচ্ছ। আমার মা এমনটা করতেন। ছোটবেলায় জ্বর বা অসুখ হলে এমনভাবে শাসাতেন। আহা, সেই কতকাল আগের কথা!

রাকিব জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনার মা নিশ্চয়ই বেঁচে নেই?

প্রফেসর রজারসন বলল, আরে না। সেই কতকাল আগে মারা গেছেন! চল্লিশ বছর তো হবেই। জানো ইয়ং পোয়েট, আজকাল না আমার জন্মস্থান, আমার সেই গ্রামটার কথা মনে পড়ে। সেই পুরোনো ওল ফ্যাক্টরি। কয়েক শ বছরের পুরোনো গির্জা। সেই খোলা সবুজ ঢেউখেলানো মাঠ। শীতের স্নো-ফল...!

: আপনার জন্মস্থান কোথায় স্যার?

: সে অনেক দূর। ইংল্যান্ডের ব্রেডফোর্ড শহরের অদূরবর্তী ছোট্ট শহর কুইন্সবেরিতে। অবশ্য আমার যখন জন্ম হয় তখন কুইন্সবেরি ঠিক শহর ছিল না। একটা গ্রাম ছিল। নিটোল গ্রাম। আমার বাল্যকালের কয়েকটা বছর সেখানে কাটে।

: আমি তো ভেবেছিলাম, আপনার জন্ম নিউজিল্যান্ডে।

: না, তবে খুব অল্প বয়সে বাবা-মার সঙ্গে নিউজিল্যান্ড চলে আসি। প্রথমে বসবাস শুরু করি ডানেডিনে। কলেজে উঠে অকল্যান্ড চলে আসি। এখন যেমন হাইস্কুলেই টুয়েলভ ক্লাস শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে যায়, আমাদের সময় এমনটা ছিল না। আমাদের সময় হাইস্কুল ও কলেজ আলাদা ছিল।

: আমাদের বাংলাদেশে এখনো হাইস্কুল ও কলেজ আলাদা।

: ওই তো, ব্রিটিশ এডুকেশন সিস্টেম। ইন্ডিয়াতেও আমি তাই দেখেছি। ইংল্যান্ডের অনেক শহরে এখনো আলাদা করে কলেজ আছে।

: স্যার, হ্যামিল্টনে আপনার কত বছর?

: উনপঞ্চাশ-পঞ্চাশ বছর তো হবেই।

: উনপঞ্চাশ-পঞ্চাশ বছর! সে তো দীর্ঘ বছর!

: হ্যাঁ, ইয়ং পোয়েট, অনেক দিন। কিন্তু আমার মনে হয়, ওই তো সেদিন এসেছি। আমার হ্যামিল্টন আসার প্রথম দিনটা এখনো স্পষ্ট মনে আছে।

: এই হ্যামিল্টনে কীভাবে স্যার?

: কেন, হ্যামিল্টন শহরটা কি তোমার ভালো লাগে না?

: না না স্যার, অনেক ভালো লাগে। আমার মনে হয়, বাকি জীবনটা এই শহরেই কাটিয়ে দেব।

: আমি তো প্রায় পঞ্চাশ বছর কাটিয়ে দিলাম। এই হ্যামিল্টনে আসা ও বসবাস করার একটা গল্প বলি। গল্পটা ইন্টারেস্টিং। তুমি শুনবে?

রাকিব আগ্রহ নিয়ে বলল, জি, বলুন স্যার।

প্রফেসর রজারসন নদীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আবার বিরক্ত হবে নাতো? তুমি কিন্তু এই গল্পটা আগে শুনেছ।

নদী স্মিত হেসে মাথা নেড়ে বলল, না স্যার। মোটেও না।

প্রফেসর রজারসন বললেন, তুমি বিরক্ত হলে হাসপাতালের করিডর ধরে খানিকক্ষণ হেঁটে আসতে পার। আমি ততক্ষণে ইয়ং পোয়েটকে গল্পটা বলে ফেলতে পারি।

নদী কপট রাগের ভাব নিয়ে বলল, স্যার!

প্রফেসর রজারসন হেসে ফেললেন, হা হা, হা হা! আচ্ছা, তুমি বসেই থাক। উঠতে হবে না। বলেই তিনি রাকিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে গল্পটা শোনো। আমি তখন অকল্যান্ডে। অনেক বছর আগের কথা। অনেক বছর বলতে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। তখন আমার বয়স কতই বা ছিল? এই ধরো, ছাব্বিশ। অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে মাস্টার্স করে একটা চাকরি নিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডির জন্য আবেদন করছি। অকল্যান্ডের সেই চাকরিটা ছিল একটা স্টিল মিলে। মেকানিক্যাল সুপারভাইজার হিসেবে। জীবনের প্রথম চাকরি। তখন অকল্যান্ডের মাউন্ট ইডেন আবাসিক এলাকা হিসেবে এত বিস্তৃতি পায়নি। মূলত মাউন্ট ইডেন এলাকা তখন ইডেন পার্ক রাগবি স্টেডিয়াম, অকল্যান্ড প্রিজন ও বিভিন্ন শিল্প-কারখানা হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। এখনকার মতো তখন প্রত্যেকটা মানুষের তেমন নিজস্ব গাড়ি ছিল না। সবাই যাতায়াতের জন্য ট্রাম ব্যবহার করত। বাসও ছিল। তবে খুব কম। আর ছিল ঘোড়ার গাড়ি। তবে আমার ভাগ্য ভালো ছিল, আমার চাকরিস্থল থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটার দূরত্বে আমি এক বেডরুমের একটা ছোট্ট বাসা পেয়ে গিয়েছিলাম।

প্রফেসর রজারসন একটু থামলেন। তিনি পর পর কয়েকবার ভারী নিশ্বাস নিলেন।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনি কি অসুস্থবোধ করছেন?

প্রফেয়ার রজারসন বললেন, ঠিক অসুস্থবোধ নয়। একটু শ্বাসের কষ্ট হচ্ছে।

: ডাক্তার ডাকব?

: আরে না। আমার বয়স হয়েছে। শ্বাস কষ্ট তো হতেই পারে।

নদী বলল, গল্পটা না হয় আরেকদিন বলবেন?

রাকিব সায় দিয়ে বলল, জি, স্যার। গল্পটা আমি আরেকদিন শুনব।

প্রফেসর রজারসন বললেন, আরেকদিন যদি গল্পটা না বলতে পারি? এর আগেই যদি মরে যাই?

নদী কিছুটা রাগের স্বরে বলল, স্যার...এসব কী বলছেন?

প্রফেসর রজারসন আবার জোরে হেসে উঠলেন, হা হা হা। জিজ্ঞেস করলেন, নদী, তুমি মৃত্যুকে কি ভয় পাও?

নদী আস্তে করে বলল, মৃত্যুকে সবাই ভয় পায়।

: আমি পাই না।

: কেন পান না স্যার?

: মৃত্যুটা একটা আনন্দের। দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমণ শেষে ঘরে ফেরার যে একটা আনন্দ, মৃত্যুটা ঠিক তেমনই ঘরে ফেরার একটা আনন্দ। দেখ না, আমি ঘরে ফেরার জন্য কেমন পাগল হয়ে উঠেছি?

: স্যার, আপনার ঘরে ফেরার সঙ্গে মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই।

: সম্পর্ক নেই নাকি?

: না স্যার, নেই।

: আচ্ছা, ঠিক আছে মেনে নিলাম। তবে ইয়ং লেডি, আমি এত তাড়াতাড়ি মরব না। আমি জানি, আমি এক শ বছর বাঁচব। এখনো এক শ বছর হতে প্রায় চব্বিশ বছর বাকি। টুয়েন্টি ফোর ইয়ার্স টু গো...! আচ্ছা, এখন আমি ইয়ং পোয়েটের কাছে আমার গল্পটা বলি। তুমি কথার মাঝখানে ইন্টারফেয়ার করবে না।

নদী কিছু না বলে একটু লজ্জায় হাসল। রাকিবের ঠোঁটেও হাসি।

প্রফেসর রজারসন কী ভেবে আবার শব্দ করে হাসলেন। পরক্ষণ হাসি থামিয়ে বললেন, আজ বেশি হাসছি। যাক, আমি গল্পটা শেষ করি। শোনো ইয়ং পোয়েট, আমি তখন প্রতি সকালে হেঁটেই অফিসে যেতাম। অফিসে যাওয়ার পথে প্রায় প্রতিদিন সকালে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হতো। ভদ্রলোকের বয়স ছিল সত্তরের কোঠায়। ভদ্রলোক মর্নিং ওয়াকে বের হতেন। মর্নিং ওয়াক শেষে তিনি বাসায় ফিরতেন। আর ঠিক সেই সময়টায় আমি অফিসে যেতাম। পথের একটা নির্দিষ্টস্থানে আমাদের প্রায়ই দেখা হতো। আমি ভদ্রলোককে দেখামাত্রই সুন্দর করে সৌজন্যে বলতাম, গুড মর্নিং, হাউ আর ইউ? কিন্তু ভদ্রলোক কোনো জবাব দিতেন না। মেজাজ খারাপ করে আমার দিকে তাকাতেন। এমন একটা ভঙ্গি করতেন, যেন আমি গুড মর্নিং, হাউ আর ইউ বলে কোনো অন্যায় কাজ করে ফেলেছি।

প্রফেসর রজারসন আবার থামলেন। এবার তিনি কোনো শারীরিক অসুস্থবোধ বা নিশ্বাস নেওয়ার জন্য থামেননি। তিনি থেমেছেন সিথানের পাশের ছোট্ট টেবিলের ওপর রাখা গ্লাস থেকে পানি পান করার জন্য।

পানি পান করে প্রফেসর রজারসন আবার গল্পটা শুরু করলেন, বুঝছ, এভাবে তিনটা বছর। প্রথম প্রথম ভদ্রলোকের প্রতি আমার মেজাজ খারাপ হতো। মন খারাপ করে ভাবতাম, কী রে মানুষ! এমন তো নয় যে আমরা দুই বর্ণের জাতি। ভদ্রলোকও ছিলেন ইউরোপিয়ান সাদা। আমিও ইউরোপিয়ান সাদা। পরে আমার জেদ চেপে যায়, আমাকে যে করেই হোক ভদ্রলোকের মুখ থেকে গুড মর্নিং-এর উত্তরে গুড মর্নিং শুনতে হবে। কিন্তু পুরো তিনটা বছর চেষ্টা করে আমার সব চেষ্টা বৃথা যায়।

রাকিব ঝুঁকে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তারপর?

: তারপর কী, মাস্টার্স তো আমি অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে আগেই করেছিলাম। মাস্টার্সের পরপর পিএইচডি করার জন্য অকল্যান্ড, ওয়াইকাটো ইউনিভার্সিটিসহ আরও কিছু ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করে রেখেছিলাম। ওয়াইকাটো ইউনিভার্সিটি থেকেই প্রথম আমি আমার আবেদনের সাড়া পাই। একদিন সেই স্টিল মিলের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে হ্যামিল্টন চলে আসি। আসার আগে নিজে নিজে প্রমিজ করে আসি, হ্যামিল্টন গিয়ে আর যা-ই হোক কারও সঙ্গে দেখা হলে গুড মর্নিং বলব না।

: তারপর কি আর গুড মর্নিং বলেননি?

: আরে শোনো না, মজার ব্যাপারটা তো এখানেই। হ্যামিল্টন এসে একদিন সকালে আমি হেঁটে ওয়াইকাটো ইউনিভার্সিটির দিকে যাচ্ছি। এক ভদ্রলোককে দেখলাম মর্নিং ওয়াক করে আমার দিকে হেঁটে আসছেন। আমি গুড মর্নিং বলব না বলে তার দিকে মনেপ্রাণে না তাকানোর চেষ্টা করছি। হঠাৎ শুনি, ভদ্রলোক বলছেন, গুড মর্নিং সান, হাউ আর ইউ?

প্রফেসর রজারসন একটু থেমে আমার জোরে জোরে শ্বাস নিলেন। একটি জানালা গলে বাইরেও তাকালেন। তারপর বলল, তুমি বুঝতে পারবে না ইয়ং পোয়েট। আমার যে সেদিন কী আনন্দ লেগেছিল! আমার তখন মনে হয়েছিল, এই হ্যামিল্টনই হবে আমার যথাযোগ্য বাসস্থান। তারপর প্রায় পঞ্চাশ বছর এই হ্যামিল্টনে। হ্যামিল্টনের মায়া ও ভালোবাসা আমি পৃথিবীর কোথাও পাই না। না অন্য কোনো শহরে। না অন্য কোনো দেশে।

প্রফেসর নিকোলাস একটা ভারী নিশ্বাস ফেললেন। তিনি আরও কিছু বলতে যাবেন ঠিক তখনই ডাক্তার ও নার্স কেবিনের দরজা ঠেলে ঢুকলেন।

রাকিব প্রফেসর রজারসন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ডাক্তার ও নার্সের দিকে তাকাল। নদীর দিকেও একবার তাকাল।

ডাক্তার ও নার্সকে দেখে প্রফেসর রজারসন গল্প থামিয়ে গলা বাড়িয়ে বললেন, দেখ, আমাকে তোমরা এখানে আটকে রেখেছ।

নার্স বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, জি মানে?

: মানে অতি সাধারণ। তোমরা আমাকে এখানে আটকে রেখেছ। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

: কী, কেবিনে কোনো অসুবিধা হচ্ছে আপনার?

: না ঠিক তা নয়। তবে এ মুহূর্তে আমি আমার বাসার ডেকটা খুব মিস করছি।

নার্স হেসে ফেলল। বলল, ও, তাই!

রাকিব–নদী দুজনই হাসল। ডাক্তার অবশ্য হাসলেন না। তিনি প্রেশার মাপায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

প্রফেসর রজারসন ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী ব্যাপার ডাক্তার, আপনি যে হাসলেন না?

ডাক্তার এবার মৃদু হেসে বললেন, চিন্তা করবেন না, আপনাকে আমরা বেশি দিন আটকে রাখব না।

প্রফেসর রজারসন জিজ্ঞেস করলেন, সেই বেশি দিনটা কত দিনের?

ডাক্তার বললেন, এই ধরেন, এক মাস কিংবা এক সপ্তাহ।

প্রফেসর রজারসন বললেন, ধ্যাত, আমি তো ভেবেছিলাম আজই চলে যাব। রাতে এই ইয়ং পোয়েট ও ইয়ং লেডিকে নিয়ে ডেকে বসে রাতের অমাবস্যা দেখব। আহা, শীতের রাতে অন্ধকারে ইজি চেয়ারে বসে রাতের অমাবস্যা দেখা, আহা! আহা! (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: