শিক্ষা, শিক্ষক ও একটি জাতির গল্প-শেষ পর্ব

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

মেরুদণ্ডের কারিগর, ছাঁচ ও মেরুদণ্ডের কাঁচামাল অর্থাৎ শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থী—এই তিন রত্নের একান্ত আন্তরিক ইচ্ছা না থাকলে বাংলাদেশের বর্তমানের শিক্ষাক্ষেত্রে হযবরল অবস্থা কি পরিবর্তন যোগ্য? কঠিন কিংবা সহজ যে ধরনের প্রশ্নই এটা হোক না কেন, এর সমাধানের বিকল্প কোনো পথ আমাদের সামনে খোলা নেই। বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের সঠিক উপায়ে প্রশিক্ষিত ও যথেষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদের উন্নয়ন করতে হবে। তা না হলে, বিশ্বায়নের ব্ল্যাকহোলের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার মেট্রোরেলের ফ্রি টিকিট পেতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খুব বেশি বেগ পেতে হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।

উন্নত থেকে উন্নয়নকামী সকল রাষ্ট্রই নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে ব্যস্ত। অন্যদিকে আমাদের সম্মানিত অগ্রজেরা উচ্চপর্যায়ে এখনো দলীয়, নিজের চেয়ারের জন্য হুমকি নয় এমন কিংবা আরও অনেক অলীক বিষয় বিবেচনা করেই একজন শিক্ষককে নিয়োগ দিচ্ছেন! ফলাফল দেশের গবেষণা ও জ্ঞান সংশ্লেষণের দৈন্য দশা! দশ চক্রে ভগবান ভূতের মতো দশার চাপে শিক্ষক এখন বহু পাওয়া গেলেও আদর্শ শিক্ষক কিংবা আজন্ম শিক্ষক হতে আগ্রহীদের এই পেশা থেকে নানান অজুহাতে দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। মেরুদণ্ডের গঠনের চারটি স্তরের শিক্ষক নিয়োগের সমাধান নিয়ে এই লেখাটি শেষ করব বলে সমস্যা সম্পর্কিত আলোচনা এখানেই ইতি টানব।

প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে একটি লম্বা সময় ধরেই আমরা নারীদের অগ্রাধিকার দিতে এসএসসি পাস অনেক শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছি। তাদের পিটিআই-এর ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি উচ্চতর ডিগ্রিকে বাধ্যতামূলক না করায় তারা অনেকেই (পুরুষ শিক্ষকসহ) এইচএসসির পরে আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়তো আগ্রহী হতে পারেননি।

উচ্চশিক্ষা শুধু দুটি সার্টিফিকেট নয়। শিক্ষার এ পর্যায়গুলো শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে থাকা অনেক কুসংস্কার, জড়তা, শঠতা ও হীনম্মন্যতা ইত্যাদি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। মেরুদণ্ডের চাকতির প্রধান এ কারিগরদের এমন বেহাল দশা তাদের থেকে ১০০ তো দূরে থাক ৪০ ভাগ সেবা নিতেও বাধার সৃষ্টি করছে। এই সমস্যার সঙ্গে যুক্ত আছে প্রশ্ন ফাঁস কিংবা গুচ্ছভাবে নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার মতো অনৈতিক কিছু মাধ্যম। এটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে দিনে দিনে অধিক পরিমাণে কলুষিত করছে। অপরদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে এই সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজিং কমিটি কিংবা অদক্ষ প্রধান শিক্ষকের সুপরিয়রিটি বজায় রাখার নিমিত্তে অযোগ্য ব্যক্তির নিয়োগও চোখে পড়ার মতো! এ বিষয়গুলো সঠিকভাবে সমাধানের পাশাপাশি বিদ্যমান শিক্ষক ও শিক্ষক হতে আগ্রহীদের জন্য অন্তত ছয় মাসের নৈতিকতা ও শিক্ষকতার আদর্শ বিষয়ক কোর্স বাধ্যতামূলক করা উচিত। এতে অন্তত এই শিক্ষকদের মধ্যে যারা নিজেদের পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন তারা পরিবর্তিত হওয়ার একটি অবলম্বন পাবেন। এতে শিক্ষার সর্বপ্রথম ও দ্বিতীয় স্তরে ঘটমান নিম্নমুখী অনেকাংশে লোপ পাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদেরও অযথা কোচিং কিংবা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সংগ্রহ করে নিজের সন্তানের হাতে তুলে দেওয়ার মতো মহৎ গুনে (!) গুণান্বিত হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। মনে রাখবেন, নিজে ঠিক না হলে দেশ কোনো দিন ঠিক হবে না।

কলেজ লেভেলে আমাদের শিক্ষার্থীরা দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যান। এক সাধারণ কলেজে এবং দুই ডিপ্লোমা কোর্সগুলোতে। বিশ্বায়নের এই যুগে মধ্যম লেভেলের যোগ্য ও দক্ষ জনগোষ্ঠীর চাহিদা দিন দিন বাড়ার ফলে ডিপ্লোমা কোর্সের গুরুত্বও দিন দিন বেড়েই চলছে। এই সেক্টরে আমাদের মনোযোগী হয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশগুলোতে খেতের কামলা কিংবা রাস্তা বা নর্দমা পরিষ্কারের শ্রমিক পাঠানো কমিয়ে দিয়ে ডিপ্লোমা কোর্সধারী দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এই উদ্যোগ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির পাশাপাশি আমাদের সম্মানিত প্রবাসী জনগোষ্ঠীকে তুলনামূলক সম্মানজনক পেশাতে নিযুক্ত করতে মুখ্য ভূমিকা রাখবে। কলেজ লেভেলের এই গুরুত্ব আমাদের সমাজে দিন দিন বাড়বেই বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এ পর্যায়ের শিক্ষক নিয়োগে বর্তমানে নেওয়া পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য একটি সিদ্ধান্ত। কিন্তু পদ্ধতির ফাঁক-ফোকর গলে ইতিপূর্বে বিরাট যে অংশ এ পর্যায়ের শিক্ষকতাতে ইতিমধ্যে যুক্ত হয়েছেন তাদের সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের মতো কোনো বাধ্যতামূলক কিছু প্রশিক্ষণ ও সেই প্রশিক্ষণের ফলাফল ও কার্যকরণ সাপেক্ষে তাদের চাকরি স্থায়ীকরণের উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের মানদণ্ড ও প্রক্রিয়া দুটোই এই পৃথিবীর আর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মেরুকরণের প্রভাব সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ভিত্তিকে অন্যতম মানদণ্ড বিবেচনা করে শিক্ষক নিয়োগে স্কুল-কলেজ পর্যায়ের সনদের চেয়ে পিএইচডি বা পোষ্টডক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর অর্জনকে প্রাধান্য দিতে হবে। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মোটিভেট না করতে পারা ও গবেষণাতে লবডঙ্কা মার্কা শিক্ষকের স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার গুরুত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জ্ঞান তৈরির কারখানাতে থাকা উচিত কিনা তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। তবে ভাবতে ভাবতে আরও পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলে কিন্তু স্বাধীনতার এক শ বছরেও আমরা উচ্চতর কলেজ ব্যতীত সত্যিকারের অর্থে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পাব না।

একই সঙ্গে আমাদের বিদ্যমান কমন যে মানসিক সেটআপ—বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো কাউকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না, প্রমোশন দেওয়া যাবে না, বয়স ৫০ না হলে অধ্যাপক হতে পারবেন না ইত্যাদি, এ ধরনের বা আরও নিম্ন পর্যায়ের মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এসব মন মানসিকতাই গত ৪৮ বছরে আমাদের হাজার হাজার মেধাবী তরুণকে বহির্বিশ্বের শিক্ষা ও গবেষণাকে উন্নত করতে অন্যতম নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। লাইফ সায়েন্সে পিএইচডি করেও একজন লাইফ সায়েন্সের শিক্ষক হওয়ার অযোগ্য। কারণ তার রসায়নে স্নাতক! আবার ড্রাগ ডিসকভারি নিয়ে বা পেপটাইড নিয়ে কাজ করে নেচার বা পিএনএএস কিংবা সায়েন্সের মতো জার্নালে প্রথম বা করেসপনডেন্ট অথার হিসেবে পাবলিকেশন থাকলেও পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক হওয়ার অপরাধে তিনি ফার্মেসি কিংবা বায়োমেডিক্যাল ফিজিকস বিষয়ের শিক্ষক হতে পারবেন না। এ টাইপের নিয়ম যারা করেন আর যারা মানেন তারা এ দেশের উচ্চশিক্ষার অগ্রসরের পথে বড় বাধা। এমন মানসিকতা ও মানব উর্বরমস্তিষ্ক নিঃসরিত ক্ষতিকর নর্দমার গন্ধযুক্ত বুদ্ধির বেড়াজাল থেকে আমাদের শিক্ষাকে বাঁচাতে না পারলে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জে নামার আগেই আমরা অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাব এতে কোনো সন্দেহ নেই।

পরিশেষে বলব, বিষয়ভিত্তিক কিংবা ভাষাকেন্দ্রিক অদক্ষতার জন্য কোনো কোনো বিষয়ে আপনার মতের অমিল হলেও উল্লিখিত সমস্যা ও এগুলোর সমাধানের জন্য প্রচেষ্টা শুরু করার এখনই মোক্ষম সময়। এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার কোনো অবকাশ নেই। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের ক্লাস লোড কিছুটা কমিয়ে তাদের গবেষণার কাজে সময় দেওয়াতে উৎসাহিত করতে হবে। এতে অনেকেই একমত হবেন। সুতরাং আমাদের নিজেদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে এবং একটি সুন্দর মনের ভালো মানুষে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের স্বার্থে আমাদের একত্রিত ও একতাবদ্ধ হতে হবে এমন সব উদ্ভট নিয়মের বিরুদ্ধে। যে নিয়ম আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের একমাত্র অস্ত্র শিক্ষকতা পেশাকে কলুষিত করতে কাজ করে যাচ্ছে! আদর্শ শিক্ষকে ভরে যাক আমাদের এই সুন্দর দেশটা। আদর্শ শিক্ষক গড়াই হোক আমাদের একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। এই আদর্শ শিক্ষকদের হাত ধরেই আমরা বিনির্মাণ করব এক উন্নত, শান্তি, সাম্য, সহমর্মিতা, ঐক্য, সততা ও পারস্পরিক সম্মানবোধের বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের সত্যিকারের স্বপ্নের বাংলাদেশ। (শেষ)


শেখ মাহাতাবউদ্দিন: পোষ্টডক্টরাল গবেষক, হেনরি ফোর্ড হসপিটাল, মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র ও সহযোগী অধ্যাপক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা, বাংলাদেশ। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: