পুত্রবধূর আয়নায় শাশুড়ি!

লেখিকা ও তাঁর শাশুড়ি মা
লেখিকা ও তাঁর শাশুড়ি মা

যে রাতে মানুষটা আমার কাছ থেকে চলে যায় আমি পাগলের মতো কাঁদি। আমার বিয়ের ৮৬ দিন পর আমাকে রেখে আমার প্রিয়তম চলে যায় মানচিত্রের অন্য সীমানায়। যে মানুষটার অস্তিত্বই ছিল না আমার জীবনে মাত্র ৮৬ দিন আগেও, সেই মানুষটাই যেন সেদিন সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন করে যাচ্ছিল স্বয়ং আমাকে। সেদিন নিজেকে খুব শূন্য শূন্য লাগছিল।

আমি পাগলের মতো কাঁদি। কাঁদে সেও। প্রিয়তমের সে কান্নার গভীরতার প্রমাণ মেলে মাস না ঘুরতেই! সে আবার চলে আসে আমার কাছে। আকাশ পাড়ি দিয়ে। এদিকে আমিতো লজ্জায় শেষ। প্রিয়তম আসছে শুনে আমি ঘর থেকেই বের হই না। তার ওপরে আমার দুষ্টু দেবরগুলো লজ্জা দিতে খালি এসে বলে, বাব্বা! ভাবী–ই–ই কী সুতা দিয়ে টান দিলেন গো। আমাদের যে ভাইয়া আট বছরেও দেশমুখী হয়নি, সে ভাইয়া মাস না ঘুরতেই আবার হাজির। কাহিনি কী!

নাহ, সেই কাহিনি বলার জন্য আমার এই লেখা নয়। এর কাহিনি ভিন্ন। নতুন বউ ঘরে। তাই প্রিয়তম দুনিয়ার জিনিস ভর্তি করে এনেছে লাগেজে করে। ডাইনিংরুমের বিশাল টেবিলে আমরা বসা। আমরা বলতে আম্মা, ওনার ছেলে (আমার প্রিয়তম), আমার দেবর, ননদ ও আমি মিলে আমরা। হঠাৎ কী হলো। এই–সেই শত প্রসঙ্গের মাঝে আম্মাকে তাঁর ছেলে আচমকা বলে বসল দুনিয়ার সবাইকে সবকিছু বিলানোর আগে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু রাইখেন। অন্তত ওষুধগুলো। আপনি বেশি করেন! ছেলের এই কথা শুনে আম্মা তো শুরু করলেন কান্না। এই দেখে আমিতো ভয়ে শেষ।

এমন মানানসই ডাইনিং এ কী বেমানান আলাপ।

আমার চেহারাটা তখন এমন করুণ। কথা না বলেই যেন বলছি, আম্মা আমি আপনার ছেলেকে কিছু শিখায় দিইনি আম্মা। আমি জি বাংলা নাটকের দুষ্টু বউমার মতো কিচ্ছু করিনি! বিশ্বাস করেন। আকর্ষিক এসব দেখে মুহূর্তেই আমার সব কেমন যেন হয়ে গেল। এলোমেলো। আমার বুকটা ধুঁক ধুঁক করছে ভয়ে। এমন পরিস্থিতির সঙ্গে আমি পরিচিত না মোটেও।

কিছুক্ষণ পর দেখি মা–ছেলে সবাই খুব স্বাভাবিক। শুধু আমিই স্বাভাবিক হতে পারছি না। এমন কেউ বলে? আম্মার ছেলেকে বললাম, যাও আম্মার কাছে মাফ চাও। ভুল করেছ তা বলো। সেতো কোনোভাবেই যায় না। মহা মুশকিল। সে আমাকে বলে, শোনো, তুমি দুই দিন আগে আসছ আমাদের ঘরে। কিছুই জান না। বুঝছ!

আমি যে কিছুই জানি না, তা বুঝি, কোরবানির ঈদের পরের দিন। কোরবানি উপলক্ষে আমরা সবাই গ্রামের বাড়ি। মেয়েদের মেহেদি রাঙা হাতে সাজ সাজ মিছিল। ছেলেদের সোজা বলে দিলাম, আমাদের নতুন শাড়ির আঁচল সামলাতে হবে। কাজ ধরব না একদম! মেহেদি উঠে যাবে যে। আজ সব কাজ ছেলেরাই করবে। হুমমম!

অতঃপর অনেক বড় একটা গরু কোরবানি হলো। মাংস সব কাটাকাটি হলো। পাতিলে মাংস তোলার আগে ছেলেরাই আনন্দ নিয়ে আস্ত গরু কাটাকুটি করল। একবেলা পেটভরে সবাই হালুম হুলুম খেলাম। কিন্তু এ কী কোরবানির পরদিনই আমাদের ঘরে কোনো মাংস নেই।

কারণ কোরবানির দিন আম্মা আমাকে তার সঙ্গে বসিয়েছিল। তারপর বলেছিল, দেখ আমি কী করি। শেখো। আমি এই বাড়ির বউ। তোমরাও যেন এই বাড়ির সব থেকে ভালো বউ হতে পার। আমি না থাকলে তোমরাই তো এসব করবা। এই কথা বলে, সম্পূর্ণ গরুর সবগুলো মাংস গ্রামের সব গরিব মানুষকে কী সুন্দর করে যে ভাগ করে দিলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আর ভাবলাম, আম্মার কত্ত বড় মন। এই বড় মনের কারণই ছিল সেদিন আম্মার ছেলের আম্মাকে, বেশি করেন বলার কারণ!

কারণ বুঝে নতুন বউ হাসে। এমন করেই আজ অবধি। এরপর থেকে দেখেই আসছি, দেখেই আসছি। ভালো লাগে যখন দেখি আম্মার উদার একটা মন। মানুষকে কিছু দিতে পারলেই ওনার সব খুশি। আম্মা মেহমান পছন্দ করেন। আমাদের বাসায় সব সময় মানুষ তিনজন থাকলে তাকে ছয় দিয়ে গুন দিতে হয়। মেহমানদের অনেক সুন্দর করে তিনি যত্ন নেন। কার কী পছন্দ ওনার তা নখদর্পণে। আমার ভালো লাগে। আমার আম্মু বলেন, আমার মেয়েগুলো মানুষ পছন্দ করে। মানুষ পাইলেই লবণ মরিচ দিয়ে মেখে খেয়ে ফেলতে চায়। আমার বেয়াইনও তাই।

এ ছাড়া, আমার কাছে আম্মার অন্যতম গুণ যেটা তা হলো, আম্মা কখনই বউদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন না। মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে উপযাচক হতে আমাদের সমাজের কিছু মানুষদের তো দেখি। আম্মা তাদের মতো না। আমার কী যে ভালো লাগে। আমি কোনো দিন শাশুড়ি হলে এই গুণগুলোকে গয়না বানাব!

এই যে অন্তরের গয়না অন্তরে গুছিয়ে রাখা ছবিটাতে আম্মা আর তার পুত্রবধূ। আমরা দুজন পছন্দ করে কাছাকাছি রঙের শাড়ি পরেছি। আমি কোথাও যেতে কাছের মানুষদের পোশাক পছন্দ করে দিতে ভালোবাসি। আম্মার আলমারির খোলা ডালা দেখে সেদিনও বলেছি; ‘ওবাজি আম্মা কী সুন্দর সুন্দর শাড়ি আন্নের! এইটা পইরবেন নে?’ আম্মা সব সময় প্রথমে একটু লজ্জা পেয়ে পরে সেই শাড়িটাই পরেন। কী যে ভালো লাগে আমার! এ যে শুধু একটা শাড়ির সৌন্দর্য না। এটা যে পুত্রবধূর মতামতকে শ্রদ্ধা করার সৌন্দর্যও। আম্মার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায় আমার এমন করেও।

ছবিতে আমাদের পরনের দুই শাড়িই আম্মার। কিন্তু এ কী! সুন্দর আছে বলাতে আম্মা সেটাও দিয়ে দিতে প্রস্তুত। আমি নিইনি। সুন্দর বললেই দিয়ে দিতে হবে নাকি! তবু জানি, কোনো একদিন বাইরে থেকে ঘরে ফিরে দেখব আমার বিছানায় গোছানো শাড়িটি। আজ নয় বছর ধরে দেখছি। পুত্রবধূর আয়নাতে আম্মা যে এমনই।