বাদলের অস্ট্রেলিয়া যাত্রা

অস্ট্রেলিয়ায় বাবার সঙ্গে লেখিকা
অস্ট্রেলিয়ায় বাবার সঙ্গে লেখিকা

শিল্পী, নীলা ও নীপার বাবা অস্ট্রেলিয়া এসেছে এটা হাঁক-ডাক ছেড়ে বলার মতো কোনো বিষয় নয়। কিন্তু ফুলজাননেসার ছেলে ‘বাদল’ অস্ট্রেলিয়া এসেছে এটা সত্যি ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলার মতো ঘটনা। এ হলো সেই বাদল, যে কিনা ছয় ক্লাসে পড়ার সময় বাপ হারিয়ে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মায়ের উৎসাহে পড়া চালিয়ে গেছে। নানামুখী অভাবের সংসারে বাদলের পড়াটা ছিল খানিকটা বিলাসিতার মতো। আর সেই বিলাসিতার দাম দিতেই বাদল তাঁর মায়ের সঙ্গে রাত জেগে ঢেঁকির তলে ধান ভেঙেছে। মুড়ি–মুড়কি বানিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে কখনো ট্রেনে, কখনো রাস্তায় ফেরি করে নিজের পড়ার খরচ নিজে জোগাড় করে তবেই পড়েছে। পাড়ার সকলে যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, বাদলের অতি উৎসাহী মা তখন বাদল না ফেরা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে পায়চারি করেছেন, বাদল কখন ফিরবে আর একসঙ্গে দুমুঠো ভাত খাবে এই আশায়।

রাতে ঘুমানোর সময় বাদলের মায়ের মুখে বাদলের মেয়ে যখন জিন-পরি আর দেও-দানবের গল্প না শুনে চোখ বন্ধ করে নিজের বাপের দুঃখ-দুর্দশার এসব গল্প শুনত, তখন বন্ধ চোখের তলায় ছবির মতো সব যেন দেখতে পেত। একই গল্প দুই দিন বাদে বাদে শুনে বাদলের মেয়ের সব গল্প পাঠ্য বইয়ের মতো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। তবু শুনতে কখনো একঘেয়ে লাগেনি। বাদলের জীবনসংগ্রামে জয়ী হওয়ার গল্পটা মনে করে বাদলের মেয়ে একটা কথা ভেবে এখনো অবাক হয়, যে পরিবারের একটা মানুষও লিখতে পড়তে পারত না, সেই পরিবার থেকে বাদল কীভাবে এত স্বপ্নবাজ হলো।

এ যেন তথাকথিত প্রবাদ-প্রবচন—‘গরিবের ঘোড়া রোগের মতো’। অবশ্য বাদলের যে শুধু ঘোড়া রোগ ছিল তা নয়, বাদলের একই সঙ্গে ঘোড়া রোগ, হাতি রোগ, ভেড়া রোগ সবই ছিল। আর সে কারণেই হয়তো বাদল যা ভাবার নয় তাই ভেবেছে। যা করার নয় সারা জীবন তাই করেছে। যার জন্য বাদলের তিন মেয়েকে বাদল নিজের সর্বসুখ বিসর্জন দিয়ে পড়াশোনা করিয়েছে। কত লোকে কত কথা বলেছে, মেয়ে পড়িয়ে কী হবে। মেয়েরা কি আর ছেলের মতো বাপ–মাকে দেখে, অযথাই পয়সা খরচ ইত্যাদি ইত্যাদি। বাদল কারও কথারই ধার ধারেনি। এ কী যে সে বাদল, এ হলো সেই বাদল, যার একে একে তিন তিনটা মেয়ে হওয়ার পরেও বলে আলহামদুলিল্লাহ।

বাদল নামটা কেমন যেন মোহাচ্ছন্ন। অথচ, এই বাদল বৃষ্টির দিনে নাকি গ্রীষ্মের দাবদাহ গরমের দিনে জন্মেছিল, তা জানবার মতো বয়োবৃদ্ধ আজ আর কেউ বেঁচে নেই। তাই বাদল নাম রাখার পেছনের ইতিহাস আজ আর কারও জানবারও কথা নয়। তবে যেহেতু বাদল নামের আগে পরে ছোট বড় কোনো নাম ছিল না, তাতে বাদলের মেয়ে খুব সহজেই বুঝতে পারে অনেকটা অযত্ন অবহেলায় বাদলের মা কিংবা পাড়া প্রতিবেশীদের কেউ একজন কোনো এক ছল করে হয়তো বাদল ডেকেছিল। আর সে থেকেই বাদলের নাম বাদল হয়ে গেছে। আগেকার দিনের গ্রামের মানুষের নাম রাখার এমন কাহিনি হরহামেশা শোনা যায়। সে বিচারে বলতে গেলে বাদলের নাম যে বা যারা রেখেছিলেন তারা অনেকটা না বুঝেই সাহিত্যের পাতায় পাতায় কত শত উপমায় ব্যবহার করা সুন্দর একটা মাতাল করা নাম রেখে দিয়েছিলেন ‘বাদল’।

যদিও মাধ্যমিকের নাম নিবন্ধনের সময় বাদলের শিক্ষক আবদুল আজিজ মাস্টার বাদল নামের ইতিকথা না জেনেই নিজ উদ্যোগে বাদলের নাম পরিবর্তন করে নাম রেখে দিয়েছিলেন মো. ইয়াছিন আলী। সেই থেকে বাদল নাম এখন বিলুপ্ত প্রায়। ভুল করেও কেউ আর বাদল নামে ডাকে না। অথচ, এই বাদল নামটাই বাদলের মেয়ের বড় পছন্দ। তা ছাড়া, বাদল নামের সঙ্গেই তো জড়িয়ে আছে বাদলের জীবনের সকল না পাওয়া। আর ইয়াছিন আলী নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবনের পটপরিবর্তনের ধারা। কারণ, মাধ্যমিক পাস করেই বাদলের চাকরি জীবন শুরু। পোস্টম্যান থেকে পোস্টমাস্টার অতপর অবসর।

বাদলের মেয়ে একটা কবিতায় লিখেছিল, দিনে দিনে দিন গিয়েছে কত। সত্যিই তো, সেদিনের সেই বাদলের দুই মেয়ে থাকে এখন অস্ট্রেলিয়ায়। আর ছোট মেয়ে দেশে ডাক্তার। বাবা হিসেবে বাদলের কৃতিত্ব এখানেই। মেয়েদের মেয়ে হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। এরপর যা ঘটল, বাদলের বড় মেয়ে হঠাৎ একদিন বাদলকে বলল, তোমার আর মার অস্ট্রেলিয়া আসতে হবে কাগজপত্র রেডি কর। বাদলের বউ নাকি সেদিন মনে মনে বলেছিলেন—‘অস্ট্রেলিয়া যাব, এ যেন মুখের কথা।’ অতপর মেয়ের অনরোধ মোতাবেক একে একে সব কাজ শেষ করে সত্যি সত্যি যেদিন বাদল আর বাদলের বউ ভিসা পেয়ে গেলেন, সেদিন বাদলের বউয়ের স্রোতস্বিনী দুটি চোখ লোনাজলে কেবল চিকচিক করছিল। সে চোখ আর কেউ না দেখলেও বাদলের মেয়ে অস্ট্রেলিয়া বসে অন্তর চক্ষু দিয়ে দেখে নিয়েছিল। যা হোক, ভিসা পাওয়ার ঠিক দুই মাস পর বাদলের অস্ট্রেলিয়া আসার দিন ধার্য হলো। এবার শুরু হলো বাদলের অস্ট্রেলিয়া আসার পূর্ব প্রস্তুতি। আনন্দের আতিশয্যে বাদল প্রতিদিন বাজারে গিয়ে কিছু না কিছু কিনে নিয়ে এসে ব্যাগ গোছাতে শুরু করেন। এ ছাড়া, বাজারে যার সঙ্গেই কথা হয় তাকেই জানিয়ে দেন তার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা। পরিচিতদের মধ্যে এমন কেউ বাকি রইল না, যিনি জানেন না, বাদল অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছেন।

এদিকে বাদলের মেয়ে বাদলের চেয়ে আরও এক কাঠি ওপরে। বাদলের মেয়ের জনে জনে ডেকে ডেকে না জানিয়ে বরং গ্রামের চিরায়ত নিয়মে মাইক হাতে সবাইকে বলতে ইচ্ছে করে, ‘ভাইসব, ভাইসব আমার আব্বা–মা অস্ট্রেলিয়া আসিতেছে, ভাইসব, ভাইসব আমার আব্বা–মা অস্ট্রেলিয়া আসিতেছে।’ কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বাদলের মেয়ে বাদলের মতো পথে ঘাটে লোক পান না। তাই ডেকে ধরে বলাও হয় না। তারপরও দুই-চার দিন পর পর যার সঙ্গে যখন কথা হয়েছে বা দেখা হয়েছে তাকেই বলেছেন, তার বাপ-মা অস্ট্রেলিয়া আসছেন। সামান্য একটা কথা, কিন্তু বলার আনন্দ অসামান্য। বলার আনন্দ কেন হবে না, সারা জীবন বাবা–মাকে তারা শুধু ত্যাগ করতেই দেখে এসেছেন, ভোগের আনন্দ দেখবেন এই প্রথম।

অবশেষে কল্পনা ছাপিয়ে সত্যি সত্যি যেদিন বাদল অস্ট্রেলিয়া পা রাখলেন সেদিন বাদলের মেয়ে বাদলের সারা জীবনের ত্যাগের পুরস্কার দিতে বাদলের হাতটাকে নিজের হাতে শক্ত করে ধরে অস্ট্রেলিয়া ঘুরে দেখাতে থাকলেন। যেমনটা বাদল একদিন ধরে রাখতেন মেয়ের ছোট্ট কচি হাত।
...

লাভলী ইয়াসমিন: সেন্ট্রাল কোস্ট (গজফোর্ড), নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।