একটি সরল নদীর গল্প-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শীতের সন্ধ্যায় সাড়ে পাঁচটা বাজতে না বাজতেই অন্ধকার নেমে আসে। যদিও নিউজিল্যান্ডে সন্ধ্যা বা রাতের অন্ধকার বলতে বাড়ির পেছনের উঠোনের সামান্য অন্ধকার। সাধারণত নিউজিল্যান্ডে বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে বিদ্যুৎ যাওয়ার কোনো নজির নেই। তাই শহরের বাইরে না গেলে সন্ধ্যা ও রাতের প্রকৃত অন্ধকার চোখে পড়ে না।

শীতের সন্ধ্যার অন্ধকার এরই মধ্যে জমা হয়েছে বাসার পেছনের উঠোনে। বাসার পেছনে একটা বড় কমলা গাছ। আর আছে একটা ফিজিওয়া গাছ। সেখান থেকে অনবরত ঝিঁঝি পোকা ডাকছে—ঝিঁ-ই-ই-ঝিঁরিৎ, ঝিরিৎ, ঝিঁ-ই-ই-ঝিরিৎ, ঝিরিৎ।

বাইরে শীত পড়েছে বেশ। স্থানে স্থানে ধোঁয়া ওঠার মতো কুয়াশা উড়ছে। জাহিদের শীতকাল ভালো লাগে না। অথচ এই শীতকালেই কিউই ফলের অরচার্ডের সবচেয়ে কঠিন কাজটা তাদের করতে হয়। খুব সকালে উঠে ঘাসের ওপর বিছিয়ে থাকা বরফের স্তর মচমচ করে ভেঙে সবাই কিউই ফলের গাছের প্রুনিং করে। শীতকালের কিউই ফল গাছের এই প্রুনিংকে বলা হয় উইন্টার প্রুনিং।

কিউই ফল গাছের এই উইন্টার প্রুনিং জাহিদের কাছে খুব কঠিন কাজ মনে হয়। জাহিদ নিউজিল্যান্ডে প্রায় ছয় বছর ধরে বসবাস করছে। এর আগে সে কখনো উইন্টার প্রুনিং করেনি। নিউজিল্যান্ডে আসার পর পর জাহিদ যখন কিছুদিন পাপামোয়া ছিল, তখন টিপুকিতে কিছুদিন কিউই ফলের পিকিং ও একটা প্যাকিং হাউসেও কাজ করেছিল। তারপর তো সে হেস্টিংস পাড়ি জমায়। কিছুদিন আগেই সে তাওরাঙ্গা শহরে এসে আবার বসবাস শুরু করেছে। এবারই সে প্রথম উইন্টার প্রুনিং করছে।

হকস বে অঞ্চলের আপেল অরচার্ডের সব কাজ জাহিদের নখদর্পণে ছিল। সেই কাজগুলো কঠিন হলেও কিউই ফলের কাজের মতো এত কঠিন নয়। কিন্তু হকস বে অঞ্চল ছেড়ে তাওরাঙ্গা শহরে আসতে হয়েছে শুধুমাত্র আজমল হোসেনের জন্য। আজমল হোসেনের নিউজিল্যান্ডে বৈধভাবে বসবাসের সব মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তিনি এখন লুকিয়ে লুকিয়ে অবৈধভাবে তাওরাঙ্গা শহরের বাঙালি কন্ট্রাক্টরদের মাধ্যমে কিউই ফলের বাগানে কাজ করছেন। জাহিদকেও তাই বাধ্য হয়ে কাজ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া উপায় কী? সে না থাকলে আজমল হোসেন যাবেন কোথায়?

এ ছাড়া অবশ্য লিডিয়ার ব্যাপারটাও ছিল। সব ঝামেলা শেষ করার পরও জাহিদের কাগজের বউ লিডিয়া অযথাই ফোন করে তার কাছে টাকা চাইত। এটা-সেটা বলে রাগারাগি করত। কখনো আগের মতো হুমকি দিয়ে বসত। যদিও লিডিয়া এখন তার কিছুই করতে পারবে না। জাহিদের নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্ট রেসিডেন্সি হয়ে গেছে। আর ওদের সেপারেশন হয়ে গেছে কয়েক মাস আগেই।

জাহিদ বাসার পেছনের জমে থাকা অন্ধকার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আজমল হোসেনকে দেখার চেষ্টা করল। তিনি নিশ্চয়ই বেডরুমের একপাশে বসে শেক্‌সপিয়ার সমগ্রের বাংলা অনুবাদ পড়ছেন? এই বইটা যে তিনি কতবার পড়েছেন! তিনি বলেন, এসব বই পড়লে নাকি জ্ঞান হয়। কিন্তু জাহিদ বুঝতে পারছে না, একই বই এতবার পড়ার মধ্যে কী জ্ঞান হয়?

জাহিদ আবার বাইরে তাকাল। অন্ধকারটা ঠিক জমাট নয়। বাসার ভেতরের আলো জানালা গলে বাইরে গিয়ে পড়েছে। দুইটি বর্গাকার আলো। ঠিক বর্গাকার নয়, খানিকটা কৌণিক বর্গাকার। তার বাসায় দুটোই জানালা। একটা লাউঞ্জে, অন্যটা বেডরুমে।

জাহিদদের তাওরাঙ্গার বাসাটা ঠিক পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাসা বলা যায় না। এটা বাসার পেছনে একটা স্লিপ আউট। অনেকে যেটাকে গ্র্যানি ফ্ল্যাট বলে। মূলত এটা বাড়ির পেছনে বাড়ি। যাদের বড় পরিবার, তারা ওটাকে শখের ফ্ল্যাট হিসেবে ব্যবহার করে। আর যাদের পরিবার ছোট, তারা ওটাকে ভাড়া দিয়ে বাড়তি কিছু পয়সা ব্যাংকে জমা করেন।

জাহিদ ও আজমল হোসেন এই স্লিপ আউটটা হেদায়েত হোসেনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে। হেদায়েত হোসেনের চার বেডরুমের বাসার পেছনের উঠোনে করোগেটেড আয়রন ও ওয়েদার বোর্ডের তৈরি এই স্লিপ আউটটা। একটা বেডরুম। বেডরুম লাগোয়া বাথরুম। ছোট্ট একটা লাউঞ্জ। লাউঞ্জের একপাশে কিচেন। বাইরে যাওয়ার একটাই মাত্র দরজা।

হেস্টিংস শহরে জাহিদদের যে বাসা ছিল, সেটা যথার্থ অর্থে ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ দুই বেডরুমের বাসা। বড় একটা লাউঞ্জ ছিল। কিচেনটা অনেক বড় ছিল। হঠাৎ করে তাওরাঙ্গা শহরে এসে এই স্লিপ আউটে বসবাস করতে গিয়ে জাহিদকে বেশ সমস্যার মধ্যেই পড়তে হয়েছে। আজমল হোসেনের সঙ্গে তার একই বেড রুমে থাকতে হচ্ছে। প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই। প্রাইভেসির ব্যাপারটা কোনো সমস্যা না। সমস্যা যেটা হয়েছে, আজমল হোসেন খুব নাক ডাকেন। এত জোরে জোরে নাক ডাকেন যে, একই রুমে তাঁর পাশের বেডে ঘুমানো দায় হয়ে যায়। এমনিতে রাতে ঘুম না হলে ভোরে উঠে কিউই ফলের বাগানে পায়ের নিচে বরফের স্তর কড়মড় করে ভেঙে উইন্টার প্রুনিং করা খুবই দুরূহ ব্যাপার।

এ বাসায় ওঠার পর জাহিদ কিছুদিন বেডরুমে ঘুমালেও এখন আর সে সেখানে ঘুমায় না। সে লাউঞ্জের লম্বা সোফাটাতে ঘুমায়। টিভি দেখতে দেখতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে।

জাহিদ জমে থাকা অন্ধকার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার হেদায়েত হোসেনের বাসার দিকে তাকাল। হেদায়েত হোসেন মানুষটা খারাপ নন, ভালোই। একটু চুপচাপ ধরনের। বয়স বেশি নয়, চল্লিশ বছরের মতো। নিউজিল্যান্ডে আছেন প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে। তাওরাঙ্গা-টিপুকি অঞ্চলে তিনি আরও দশজন বাঙালি কনট্রাক্টরদের মধ্যে একজন কন্ট্রাক্টর। এরই মধ্যে বেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাওরাঙ্গা শহরের এই বাড়িটা বাদেও আরও দুটো বাড়ি আছে। ঢাকা রামপুরায় প্লট কিনে আটতলা একটা বাড়ি বানিয়েছেন। হেদায়েত হোসেনের অধীনেই জাহিদ ও আজমল হোসেন কাজ করে।

তাওরাঙ্গা-টিপুকি শহরের কিউই ফলের বাগানের কন্ট্রাক্টররা অনেকটা হকস বে অঞ্চলের আপেল অরচার্ডের কনট্রাক্টরদের মতোই। অরচার্ডের মালিকের কাছ থেকে কিউই ফলের বড় বড় বাগান নিয়েই তারা কমিশনে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করান। তবে আপেল অরচার্ডে কাজ করার চেয়ে কিউই ফলের অরচার্ডের কাজে পয়সা বেশি। কিন্তু কাজটা খুব কঠিন। আপাতত জাহিদের কাছে তাই মনে হয়। কিন্তু জাহিদ অবাক হয়ে দেখছে, আজমল হোসেন এ কাজটা আপেল বাগানের কাজের চেয়ে বেশ স্বচ্ছন্দে করছেন।

আজমল হোসেন কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, জাহিদ তা খেয়াল করেনি। জাহিদ খানিকটা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনি, ঘুমাননি?

আজমল হোসেন বললেন, না, বইটা পড়ছিলাম।

: কোন বইটা, শেক্‌সপিয়ারের বাংলা অনুবাদ?

: আছে তো ওই একটা বই। আর কোনটা পড়ব?

: তাওরাঙ্গা সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে ইংরেজি বই এনেও তো পড়তে পারেন?

: এমনিতে ইংরেজি পত্রিকা পড়তে খারাপ লাগে না। কিন্তু সাহিত্যের বই ইংরেজিতে পড়তে তেমন আনন্দ পাই না। অনুবাদ করা থাকলে আনন্দ পাই। আর শেক্‌সপিয়ারের বাংলা অনুবাদ সমগ্রটা কত বড়! যতবার পড়ি ততবারই মনে হয় নতুন করে পড়ছি।

জাহিদ মৃদু হেসে বলল, তাই! ভালো।

আজমল হোসেনও সায় দিয়ে হাসলেন। এক মুহূর্ত চুপ থেকে কী ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী মন খারাপ?

জাহিদ বলল, নাহ, নাতো। হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন স্যার?

: না মানে, তুমি এভাবে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছ?

: এমনিই স্যার।

: এমনিই কেউ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে না। আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?

: জি স্যার, করুন।

: তোমার কি কিউই ফ্রুটের কাজটা ভালো লাগছে না?

জাহিদ একটু চুপ থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, জি স্যার। আসলেই ভালো লাগছে না। কিউই ফ্রুট অরচার্ডের কাজটা আমি ঠিক পছন্দ করছি না। প্রায় পাঁচ-সাড়ে পাঁচ বছর আপেল অরচার্ডে কাজ করেছি তো, তাই ওই কাজটা আমার নখদর্পণে ছিল। কিউই ফ্রুটের কাজটা আমার কাছে খুব কঠিন মনে হচ্ছে।

আজমল হোসেন বললেন, আমার কাছে কিন্তু মনে হচ্ছে না। বরং আপেল বাগানের কাজটা আমার কাছে কঠিন মনে হতো।

: গত কয়েক দিন ধরে তাই তো দেখছি। সত্যি বলতে স্যার, আপনাকে অনেক আগেই আমার তাওরাঙ্গা-টিপুকিতে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।

: এখানে এলে আমাকে আশ্রয় দিত কে?

: আশ্রয় মানে?

: এই যে, তুমি আমাকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছ?

: ছি, কী বলেন স্যার?

: এই আশ্রয় শব্দটা নেগেটিভ অর্থে নিচ্ছ কেন?

: কীভাবে নেব স্যার?

: পজিটিভ অর্থে নেবে। আচ্ছা, আশ্রয় শব্দটা বাদ দাও। তুমি আমাকে উপকার তো করছ। তুমি আছ বলেই এত দিন নিউজিল্যান্ডে আছি। নয়তো আমার কী যে হয়ে যেত! প্রায় ছয়টা বছর ধরে তুমি আমাকে আগলে রেখেছ! আজ আমার জন্য তোমাকে হেস্টিংস ছেড়ে তাওরাঙ্গা আসতে হলো।

: হেস্টিংস আমি এমনই ছেড়ে দিতাম স্যার। অন্তত লিডিয়ার জন্য।

: লিডিয়ার জন্য কেন?

: দেখলেন না, তাওরাঙ্গা আসার আগে দিয়ে কী ঝামেলাটা বাঁধাল? আমার পার্লামেন্ট রেসিডেন্সি হয়ে গেছে কয়েক মাস হয়ে গেছে। লিডিয়ার সঙ্গে টাকাপয়সার ঝামেলা বহু আগেই শেষ। কিন্তু তারপরও সে টাকাপয়সা চেয়ে কীভাবে হুমকি দিতে শুরু করেছিল?

: হ্যাঁ, মেয়েটা বেশ লোভী।

: শুধু লোভী নয় স্যার, মহালোভী। সে ভেবেছে, সারা জীবনই সে আমার কাছ থেকে হুমকি-ধমকি দিয়ে টাকাপয়সা আদায় করে নিবে। রেসিডেন্স হওয়ার আগে অন্য ব্যাপার ছিল। তার সবকিছু মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন কেন? (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>


ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: