একটি সরল নদীর গল্প-তিন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এক সপ্তাহ ধরে একা নাগাড়ে বৃষ্টি হওয়ার পর গতকাল থেকে রোদ ওঠা শুরু হয়েছে। আজ সকাল থেকে রোদ যেন অনেকটা উপচে পড়ছে। রোদটা যেন ফরসা যুবতীর উপচানো যৌবনের মতো...!

ফরসা যুবতীর উপচানো যৌবনের মতো রোদ। বাক্যটা রাকিবের বেশ পছন্দ হলো। সে তখনই মনে মনে কবিতার কয়েকটা লাইন বানিয়ে ফেলল। এক টুকরো কাগজ হলে বেশ ভালো হতো। কবিতার লাইন কয়েকটা যে এখনই টুকে রাখতে পারত।

ফরসা যুবতীর উপচানো যৌবনের মতো রোদ। খাঁজ ভাঙা বুকে
বুবুরা আঁচল নাড়িয়ে দিঘল মেঘের রেখায় বহুদূর যায়
শীতল বুকের ওম দেওয়া বুনো হাঁস অচেনা বাতাসে যুবতী যৌবনে নাচে
যৌবনে যুবতী সন্ধ্যার উজানি ঘাটে বসে...।

রাকিব একটা পাইন গাছের প্রশস্ত ছায়ায় বসে আছে। তার দৃষ্টির সামনে বিস্তৃত লেকের ছোট ছোট ঢেউ। ঢেউয়ের ওপর নরম রোদের আবেশ ঢালা স্পর্শ।

রোদের এই নরম স্পর্শটার সঙ্গে রাকিব যেন মৌনতার সংস্পর্শ খুঁজে পেল। মৌনতার এই ছোট্ট ছোট্ট হাত। ছোট্ট ছোট্ট হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরা। মৌনতার মিষ্টি মিষ্টি পাকনা কথা। তার এই চঞ্চলতা...। রাকিবের তখন তার মেয়ে সাদিয়ার কথা মনে পড়ে গেল। মৌনতার আজ জন্মদিন। সে আজ ছয় বছরে পড়েছে। রাকিব হিসাব করে দেখল, তার মেয়ে সাদিয়া আজ হয়তো মৌনতার সমবয়সী হতো না। খানিকটা বড়ই হতো। প্রায় সাড়ে সাত বছর হতো।

মৌনতার জন্মদিন উপলক্ষে নাবিদ ও জুঁই হ্যামিল্টন লেকের পাড়ে পিকনিক স্পটে একটা ছোটখাটো পার্টির আয়োজন করেছেন। খুব বেশি মানুষ নিয়ে নয়। মাত্র ছয়টা পরিবার ও তাদের ছেলেমেয়েকে নিয়ে। বাড়তি হিসেবে রাকিব। নদী তো এখন তাদের পরিবারেরই একজন।

রাকিব লেকের জল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নদীর দিকে তাকাল। নদী খানিকটা দূরে একটা পোর্টেবল টেবিলের ওপর মৌনতার জন্মদিনের কেক সাজাতে ব্যস্ত। তার সঙ্গে বেশ কয়েকটা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। মৌনতাও সেখানে।

নদী আজ লাল রঙের একটা শাড়ি পরেছে। শাড়ির লাল রঙের ওপর ছোট ছোট কালো পাতার কাজ। লাল রঙের শাড়িটা নদীকে ঠিক মানায়নি। শ্যামলা চেহারায় লাল শাড়ি কখনো মানায় না। সে টিয়ে রঙের একটা সবুজ শাড়ি পরলে বেশ মানাত।

তারপরও নদীকে আজ শাড়ি পরা অবস্থায় প্রথম দেখে রাকিবের বেশ ভালো লাগছে। কেমন নিজের মানুষ মনে হচ্ছে। নদী আজ মুখে হালকা প্রসাধনী মেখেছে। ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক। হয়তো শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে সে আজ ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক দিয়েছে। কিন্তু নদীর লাল রঙের লিপস্টিকটাও ঠিক মানায়নি। কেমন তাকিয়ে আছে।

রাকিব ভাবল, নদী হয়তো সাজ সম্বন্ধে এত সচেতন নয়। আহা, নদী যদি টিয়ে রঙের শাড়ির সঙ্গে ঠোঁটে খয়েরি লিপস্টিক দিয়ে আসত, তাকে কী দারুণই না লাগত!

কতক্ষণ আগেও নদী রাকিবের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে গেছে। সঙ্গে মৌনতাও ছিল। কিন্তু এখন রাকিব একা। নিস্তব্ধ ছায়ার ভেতর তার একাকী বসে থাকতেই ভালো লাগছে। রাকিব মনে মনে কবিতার লাইটগুলো নিয়ে আবার নাড়াচাড়া শুরু করল। কবিতার লাইনগুলোর সঙ্গে আরও কয়েকটা লাইন মনে এলে।

এই সাদা মেঘ, এই দীর্ঘ যুবতীর নিঃসীম যৌবন
ঘরহীন বুবুদের দিঘল চরে মহাজনী নৌকা মাথা নাড়ে,
তাবৎ নৌকার মাঝি, মহাজন চোখ ইশারায় ডাকে
সন্ধ্যায় বুবুরা হাঁটে ওঠে, গোমতীর ঘাটে।
এ যে শত বছরের জঞ্জাল।

এবারও কবিতার লাইনগুলো রাকিব ঠিক গুছিয়ে তুলতে পারল না। সে এক প্রশস্ত জল পেরিয়ে লেকের ওপাশে তাকাল। তার দৃষ্টির ভেতর যেন আকাশটা নেমে এল।

পশ্চিম আকাশে খানিকটা মেঘ করেছে। কিন্তু ধূসর মেঘ নয়, সাদা মেঘ। সাদা মেঘটা আবার পেঁজা তুলো মেঘ।

মেঘটা শুধু পশ্চিম আকাশেই। এ ছাড়া, আকাশের বাকি অংশে চোখ নরম করা নীল লেপটে রয়েছে। এখন প্রায় দুপুর বলে বাইরে শীত তেমন লাগছে না। তারপরও শীতের হীন হীন বাতাস বইছে।

লেকের জলের ছোট ছোট ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অসংখ্য হাঁস এলোমেলো সাঁতার কাটছে। অনেক রাজহাঁস লেকের জলে ভাসছে। অসংখ্য বুনো কবুতরগুলো লেকের পাড়ে। এসব হাঁস, রাজহাঁস ও বুনো কবুতরের অভয়ারণ্য এই হ্যামিল্টন লেক। শুধু হ্যামিল্টন লেক নয়, নিউজিল্যান্ডের সমস্ত লেকগুলোতেই হাঁস, রাজহাঁস ও বুনো কবুতরের অভয়ারণ্য। একটা রুটি টুকরো টুকরো করে দিলে বা এক মুঠো মুড়ি ছিটালে হাঁস, রাজহাঁস, বুনো কবুতরগুলো পায়ের কাছে এসে নির্ভয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

এক ভদ্রলোক রাকিবের দিকে এগিয়ে এলেন। রাকিব তাকে ঠিক চিনে না। কিন্তু ভদ্রলোক কাছে এসেই নিজ থেকে পরিচয় দিলেন, আমি আনিস মাহমুদ। আপনি আমাকে ঠিক চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি।

রাকিব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি আমাকে চেনেন, কীভাবে?

আনিস মাহমুদ বললেন, আপনাকে সরাসরি আগে কখনো দেখিনি। এই প্রথম দেখলাম। কিন্তু আপনার অনেক কথা শুনেছি।

: আমার অনেক কথা? কার কাছ থেকে শুনেছেন?

: অনেকের কাছ থেকেই।

: অনেকের কাছ থেকে! কী কথা শুনেছেন?

: ওই তো, আপনি নদীর বয়ফ্রেন্ড।

: আমি নদীর বয়ফ্রেন্ড? কী বলেন!

: হ্যাঁ, অনেকেই বলে। আপনারা নাকি...! আনিস মাহমুদ কথাটা শেষ করতে পারলেন না। নাবিদ তখনই সেখানে উপস্থিত হলো। জিজ্ঞেস করল, আনিস ভাই, আপনি রাকিবের সঙ্গে কী কথা বলছেন?

আনিস মাহমুদ অযথাই হাসলেন, হে হে, হে হে। বললেন, না, তেমন কোনো কথা না। তিনি একা বসে আছেন তো, তাই কথা বলতে এলাম।

নাবিদ বলল, রাকিব একা বসে থাকতেই পছন্দ করে। উনি কবি মানুষ।

আনিস মাহমুদ আবারও হেসে বললেন, হে হে, হে হে, তাই নাকি? তিনি কী কবিতা লেখেন?

: অনেক কবিতাই লেখে।

: একটা কি শুনতে পারি?

: না, এখন না। অন্যদিন শুনবেন। এখন তাকে বিরক্ত করবেন না। তাকে একা থাকতে দিন। আপনি ওদিকে আসুন।

: ওদিকে কেন?

: আহা, আসুন তো। বলেই নাবিদ আনিস মাহমুদকে অনেকটা টেনে সেখান থেকে নিয়ে গেল।

রাকিব নাবিদ ও আনিস মাহমুদের পথের দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

নাবিদের সঙ্গে রাকিবের প্রথম পরিচয় সেই মাউন্ট পিরংগিয়ায়। সেখান তাদের মধ্যে যা আলাপ হয়, এর সবকিছুই ছিল বৈষয়িক। এর বেশি কিছু নয়। তারপর এত দিন তাদের মধ্যে আর কোনো কথাবার্তা হয়নি। সামনাসামনি তো দূরের কথা, ফোনেও না। কিন্তু গত তিন দিন আগে এক সন্ধ্যায় হঠাৎ নাবিদের ফোন পেয়ে রাকিব বেশ অবাকই হয়। রাকিব আরও অবাক হয় নাবিদ যখন তাকে নাম ধরে তুমি করে বলছে।

রাকিব ভাবল, নাবিদ ভাই তাকে তুমি করে ডাকতেই পারেন। তিনি বয়সে বেশ বড়। তার চেয়ে কমপক্ষে এগারো-বারো বছরের বড় তো হবেনই। পরে সে নদীর সঙ্গে ফোনে কথা বলে বুঝতে পারে, মৌনতার জন্মদিনে তাকে আসার অনুরোধটা মূলত নদীই নাবিদকে করেছে।

রাকিব আবার ঘাড় ঘুরিয়ে নদীকে দেখার চেষ্টা করল। নদী তখনো মৌনতার সঙ্গে বাচ্চাদের নিয়ে জন্মদিনের কেক ও মোমবাতি সাজাতে ব্যস্ত।

রাকিব আবার ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে পেছনে পাইন গাছটায় ঠেস দিয়ে লেকের জলে তাকাল। দুপুরের নিঃসীমতা যেন লেকের জলে স্তব্ধ হয়ে আছে। লেকের পাড়ে সারি সারি খেজুর গাছ। কোথাও হাঁটু জল অবধি শরীর ডুবিয়ে মোড়তার জঙ্গল বিছিয়ে আছে। পাড়ের কোথাও আবার কাশবন। শীতের শেষে কাশফুলগুলো ধূসর রং ধারণ করেছে। উত্তরের হিন হিন বাতাসে কাশফুলগুলো একটা আরেকটা গা স্পর্শ করছে। এক বাঙালি ভদ্রলোক নিজে নিজে শখের বশে হাঁসদের জন্য রুটি ছিড়ে ছিড়ে দিচ্ছেন। অনেকগুলো হাঁস ভদ্রলোকের চারপাশে এসে ভিড় জমিয়েছে। ভদ্রলোক হাঁসগুলোকে রুটি ছিড়ে দিতে দিতে শিশুর মতো হাসছেন। ভদ্রলোকের এই শিশু সরল হাসিটা রাকিবের বেশ ভালো লাগছে। হাঁসগুলো সমস্বরে ডাকছে প্যাক-প্যাক, প্যাক-প্যাক।

নদী এরই মধ্যে রাকিবের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রাকিব তা খেয়াল করেনি। নদীর ডাকে সে চমকে উঠল।

নদী বলল, এই যে কবি সাহেব।

রাকিব বলল, ও, তুমি এসেছ?

: হ্যাঁ, আচ্ছা একটা কথা বলি, আপনি কতক্ষণ এভাবে একা একা বসে থাকবেন? নতুন কোনো কবিতা নিয়ে ভাবছেন না তো?

: তা তো ভাবছি এখানে আসার পর থেকেই। এত কোলাহলে না থেকে এখন যদি শুধু তুমি আর আমি পাশাপাশি এখানে বসে থাকতাম, তাহলে একটা আস্ত কবিতা লিখতে পারতাম।

নদী মৃদু হেসে বলল, না হয় একদিন এখানে এসে আপনি আর আমি পাশাপাশি বসব। বেশি দূরে তো নয়।

রাকিব সায় দিয়ে বলল, হুম, তা অবশ্য ঠিক।

নদী বলল, মৌনতা কী বলে জানেন, সে বলে আপনার নাকি ভাব এসেছে!

রাকিব মৃদু শব্দ হাসল। বলল, মৌনতা খুব মেধাবী হবে। আচ্ছা, ওদিকের কী খবর বলো?

নদী বলল, কেক সাজানো হয়ে গেছে। সব মোমবাতি কেকের চারপাশে বসানো হয়েছে। এখনই কেক কাটবে। এখন সবাই ওখানে দাঁড়াবে। আপনিও আসুন, প্লিজ।

রাকিব সায় দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, চল। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>