অরিত্রী ও আমাদের স্কুল জীবন

অরিত্রী অধিকারী। সংগৃহীত
অরিত্রী অধিকারী। সংগৃহীত

আমার স্কুল জীবনের কথা মনে হলে যার কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে তিনি হলেন হাইস্কুলের পরেশ স্যার। পরেশ চন্দ্র রায়। খুব রাগী, কড়া ছিলেন স্যার।

ক্লাসে ঢুকলেই পুরা ক্লাস নিশ্চুপ। স্যার অঙ্ক ও বিজ্ঞান পড়াতেন। অঙ্ক ক্লাসে অঙ্ক খাতায় ভুল হলে স্যার চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে বেঞ্চের ওপর রাখা বইয়ের মধ্যে ঠাস ঠাস করে বারি দিয়ে বলতেন, অঙ্ক ভুল কেন? মনযোগ কই থাকে? আসমানে?

একদিন আমি বললাম, জি স্যার।

স্যার অবাক হয়ে বলেন, আসমানে মানে? আমার সঙ্গে ইয়ার্কি! কান ধর।

আমি কান ধরে চুপ করে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছি। বান্ধবী শিরিন বলল, স্যার ও এয়ার হোস্টেস হতে চায়।

স্যার শিরিনকে বললেন তুই কী হতে চাস? উকিল! তোরে আমি জিজ্ঞেস করছি? আগ বাড়িয়ে কথা বলা উকিলের কাজ। তুই কি উকিল হবি?

শিরিনের উত্তর, না স্যার।

আগ বাড়িয়ে কথা বললি কেন? কান ধর।

আমরা দুজনেই কান ধরে দাঁড়িয়ে আছি। পুরো ক্লাস আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

আমার দিকে তাকিয়ে স্যার বললেন, ও তাহলে তোর আসমানে উড়ার শখ হইছে। তো উড়বি যখন পাইলট হওয়ার ইচ্ছা নাই কেন? চিন্তাগুলো বড় হতে পারে না? বড় হইব কেমনে! অঙ্কে তো কাঁচা। বল সূত্র বল দেখি, বলেই স্যার একের পর এক সূত্র জিজ্ঞেস করতেন। আর না পারলে বলতেন, এই সব অপদার্থ নিয়ে যে কী করি। ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার। ব্রেইন তো ভালো। না পড়লে তো মরিচা পরে যাবে ব্রেইনে। কেরানির চাকরি তো জুটব না কপালে, এভাবে লেখাপড়া করলে। শেষে তো মানুষ বলব, স্যার পড়ায় নাই। কাল থেকে একটা অঙ্ক যেন ভুল না হয়।

এভাবে প্রতিদিন স্যার একেকজনকে বলতেন। কেউ না পারলে বেতের বারি, কান ধরা কমন ছিল।

অঙ্কের বাহানায় স্যার আমাদের অনেক প্রশ্ন করতেন। আসলে জানতে চাইতেন আমাদের ভাবনাগুলো। তখন তো বুঝিনি এখন তাই মনে হয়। কী অসাধারণ ছিলেন স্যার। বিশেষ করে বিজ্ঞান ক্লাসে স্যার যখন প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিতেন, বলতেন, ব্যাঙ কাটতে পারবি তো? সাহস আছে তো কাটাকাটির? না পারার তো কোনো কারণ দেখি না, তোদের চরিত্র তো ব্যাঙের মতোই। খালি লাফালাফি।

একবার ব্যাঙ ধরতে গিয়ে হাত থেকে ছুটে যায়, আর এই ব্যাঙের পেছনে ছুটতে গিয়ে একেবারে হেড স্যারের রুমে। ফজলুল হক স্যার ছিলেন হেড স্যার। ভারী চশমা পরতেন। গম্ভীর গলায় স্যার বললেন, আমার রুমে কী?

স্যার ব্যাঙ..., বলেই আর কথা বলতে পারছি না। ভয়ে কথা আটকে গেছে। শিরিনও চুপ। স্যার রেগে গিয়ে বললেন কি বললি?

আমি ব্যাঙ...? আমারে তোদের তাই মনে হয়? পিয়ন ছিল চান মিয়া নামের একজন। তাকে হেড স্যার বললেন, বেত নিয়ে আয়। আর পরেশকে ডাক দে। আজকে পিঠের ছাল তুলব।

হেড স্যার পরেশ স্যারকে ডাকলেন। বললেন, এই সব অপদার্থ কী মানুষ হবে না। বেয়াদব–স্টুপিড বলেই যেই না স্যার মারতে অগ্রসর হলেন, অমনি পরেশ স্যার খুব অবাক করে দিয়ে বললেন, বাচ্চা পোলাপাইন মাফ করে দেন। আসলে ব্যাঙ ধরতে আসছে, ভয়ে কথা বলতে পারছে না। ছেড়ে দেন। শেষে পিয়ন চান মিয়া ব্যাঙ ধরে নিয়ে আসে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে। ক্লাস শেষে শিরিন বলে দেখ, আমরা পরেশ স্যারকে বলি স্যার কত কড়া অথচ আজ দেখ হেড স্যারের রুমে স্যার কীভাবে আমাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলল। আসলে স্যার আমাদের কত ভালোবাসে, ওপর দিয়ে বোঝা যায় না। সত্যি স্যারেরা আমাদের সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসায় ছিল না কোনো স্বার্থ। যেমন মাইর তেমন ভালোবাসা।

ইংরেজি পড়াতেন যতীন্দ্র স্যার। অসম্ভব শুদ্ধ উচ্চারণ। চমৎকার করে পড়াতেন। স্যার ছিলেন কিছুটা শান্ত টাইপের। ট্রান্সলেশন জিজ্ঞেস করতেন। না পারলে বলতেন তোদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না, ভবিষ্যৎ অন্ধকার। টেন্স নখদর্পণে রাখবি, বুঝলি। ট্রান্সলেশন কর, ‘ডাক্তার আসার পূর্বে রোগী মারা গেল।’

দীপু নামের এক ছাত্র ছিল কিছুটা দুষ্ট। তবে মেধাবী। সে বলত, স্যার, রোগী এত অসুস্থ ছিল, হাসপাতালে নেয় নাই কেন? রাস্তাঘাটের যে অবস্থা ডাক্তার আসতে তো দেরি করবেই।

স্যার বলতেন, এদিকে আয়, বুঝছি তোর বেতের বারি লাগবে। যেই না স্যার মারতে আসতেন, অমনি দীপু ট্রান্সলেশন করে ফেলত। স্যার হেসে ফেলতেন। আর না পারলে বেতের বারি ঠাস ঠাস।

আসলে শাসনের বিপরীতে ভালোবাসাটাও ছিল প্রচণ্ড রকম। এমনিতে বোঝা যেত না। কিন্তু পরিস্থিতিতে আমরা ঠিকই বুঝতে পারতাম স্যারদের ভালোবাসা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ছাত্রদের মানুষ করা।

গত কয়েক দিন ধরে ভিকারুননিসা নুন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রী আত্মহত্যা নিয়ে তোলপাড় চলছে। অভিযোগ উঠেছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তারও হয়েছেন। ক্লাসে অরিত্রী নকল করেছে মোবাইল দেখে, শিক্ষক ধরেছেন, সেটা ঠিক আছে, তাই বলে তাকে অপমান করতে হবে, ক্ষমা চাওয়ার পরও। কী এমন ক্ষতি হতো ক্ষমা করে দিয়ে ওয়ার্নিং দিয়ে দিলে, যে এটাই তোমার লাস্ট চান্স। শিক্ষকেরা শাসন করবেন, শিক্ষকেরা ভালোবাসবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। বাবা–মায়ের পর শিক্ষকরাই তো আমাদের শেখান সবকিছু।

ক্ষমা একটি মহৎ গুণ। এটা তো শিক্ষকেরাই আমাদের বুঝিয়েছেন, শিখিয়েছেন।

ভিকারুননিসা স্কুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, একজন ছাত্রকে টিসি দিতে পারলেই নাকি অন্য একজনকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ভর্তি করা যাবে। কেউ কেউ এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। অরিত্রী গেলে আরেকজন আসবে। সঙ্গে টাকাও আসবে। স্কুল কমিটির মেম্বারদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে যে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তারা ভর্তি বাণিজ্য করেন। এটা তো স্কুল না, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মনে হয়। আর অবৈধভাবে আয় করা অনৈতিক বাবারাও তাদের সন্তানদের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ভর্তি করান এবং সমাজে মাথা উঁচু করে বলেন, জানেন আমার সন্তান ওই নামী স্কুলে পড়ে।

আসলে পুরো সিস্টেমেই গলদ। আর তা সাফার করে ছাত্রছাত্রী। এই অবুঝ বাচ্চাগুলো কোনো কূলকিনারা পায় না। শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি, বাবা, সবখানেই গলদ।

অরিত্রীর মতো হাজারো সন্তান এই সব সিস্টেমের বলি হচ্ছে। উদ্দেশ্য যদি মহৎ না হয়, ভালো স্কুল শুধু জিপিএ পাঁচ দিতে পারবে। কিন্তু মানুষ করতে পারবে না ছাত্রছাত্রীকে। স্কুল কমিটির কাজ কী? তারা তাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করে? ভিকারুননিসা স্কুল কমিটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উঠেছে তাদের ভর্তি বাণিজ্যের নিয়ে। যে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের মানুষ করবে সেখানেই যদি বাণিজ্য চলে তাহলে বাচ্চারা মানুষ হবে কী করে?

আজকালকার বাবা-মা ভালো স্কুলের পেছনে দৌড়াচ্ছেন। কিন্তু সন্তানকে মানুষ করার পেছনে দৌড়াচ্ছেন না। সন্তানকে সময় দিতে হবে, বন্ধুর মতো আচরণ করতে হবে।

আমাদের শিক্ষকদের কথা মনে হলে এখনো শ্রদ্ধায় মন ভরে যায়। আমাদের শাসন করেছেন যেমন সত্যি, তেমনিভাবে ভালোবাসাটাও ছিল নিঃস্বার্থ। ওই শাসনের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ‘তোরা মানুষ হ’। সেটা বুঝতে পারতাম রেজাল্টের পর শিক্ষকদের সঙ্গে যখন দেখা করতে গিয়েছি। তখন দেখেছি স্যারদের চোখ ছল ছল আনন্দে। এ এক অন্যরকম আনন্দ। স্যারদের উদ্দেশ্য ছিল মহৎ।

বর্তমানে অনেক শিক্ষকও নিয়োগ পান টাকার বিনিময়ে। তাদের উদ্দেশ্য মহৎ হবে কী করে? অবশ্য সব শিক্ষকই নন। অনেকে মেধার জোরেই চাকরি পান, শ্রমও দেন সততার সঙ্গে।

আপনারা যদি সন্তানদের মানুষ করতে চান, তাহলে এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন। এই ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ না হলে এই সব সমস্যার সমাধান হবে না। আরও অরিত্রী ভবিষ্যতে বাবা-মাকে কাঁদিয়ে চলে যাবে বহু দুরে। যেখান থেকে আর চাইলেও কেউ ফিরিয়ে আনতে পারবেন না।

(৯ ডিসেম্বর ২০১৮)