প্রসঙ্গ: অরিত্রী

অরিত্রী অধিকারী। সংগৃহীত
অরিত্রী অধিকারী। সংগৃহীত

আমরা নতুন বাড়ি যেখানে বানিয়েছি, দুই বছর আগে সেখানে জঙ্গল ছিল। জঙ্গল সাফ করে নতুন কমিউনিটি বানানো হয়েছে। প্রতিটা কমিউনিটিই এভাবেই বানানো হয়ে থাকে।

স্বাভাবিকভাবেই এখানে একসময় বন্যপ্রাণীর বাস ছিল। এখন নেই। এ কারণেই নতুন কমিউনিটিতে প্রথম কয়েক বছরে দেখা যায় নতুন বসতি এলাকায় বব ক্যাট (বন বিড়াল), কায়োটে (ছোট জাতের নেকড়ে) বা হরিণ ঘুরে বেড়ায়। এ ছাড়া নানান জাতের পাখি, খরগোশ বা কাঠবিড়ালির বিচরণ তো নিয়মিত ঘটনা।

এই প্রাণীগুলো সুন্দর। দেখতে ভালো লাগে। আমাদের ক্ষতিও করে না। উল্টো আমরা কেউ কেউ এদের জন্য খাবার রেখে দিই। যাতে বেশি বেশি করে আসে। এখন বলি উৎপাতের কথা।

ইঁদুর একটি বিরাট যন্ত্রণার নাম। এরা বাড়ির ভেতর (বিশেষ করে গ্যারেজে) চলে আসে। আমার বাড়ির গ্যারেজেও কয়েক রাত আগে আমি একটা ইঁদুর দেখেছি। পৃথিবীতে এই একটা প্রাণী আমি ভয়াবহ রকমের ভয় পাই। শৈশবে ভারতে প্লেগ রোগের ঘটনায় অনেক মানুষের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলাম। তখন থেকেই এ ব্যাপারে আমার মাথায় ফোবিয়া কাজ করে। আমি ইঁদুর মারার ট্র্যাপ দিয়ে গ্যারেজ ভরে রেখেছি। ফাজিলটা বোধ হয় ইঁদুর সমাজের বিরাট কোহলি। ট্র্যাপ থেকে খাবার খেয়ে যাচ্ছে কয়েক দিন ধরে। ধরা পড়ছে না, মরছেও না। উল্টো ফাঁদ পাততে গিয়ে নিজের আঙুল ইনজুরড করে ফেলেছি। ইনশা আল্লাহ, এর বিনাশে আমি সফল হব। দোয়া রাখবেন।

ইঁদুর ছাড়াও বিছা একটি যন্ত্রণা। ওষুধ ছিটাতে হয়। সাপ একটি সমস্যা। বিশেষ করে যাদের সুইমিং পুল থাকে, প্রায়ই দেখা যায় তাদের পুলে নাগিন ড্যান্স হচ্ছে। কার্বলিক অ্যাসিড ছিটাতে হয়। আর আছে মাকড়সা। ছোট ছোট স্পাইডারম্যানের যন্ত্রণায় বাসায় টেকা দায়। সব জায়গায় জাল বিছিয়ে বসে থাকে। যদিও সেই জালে ভিলেন (পোকা, মাছি) ধরে খেয়ে আমাদের উপকারই করে।

নিরীহ এই প্রাণীটিকে অনেকেই ভয় পান। আমাদের প্রতিবেশিনী এতটাই ভীত যে তিনি ভয়ে আছেন মাকড়সা মারতে গিয়ে তিনি না তার পুরো বাড়ি এক দিন পুড়িয়ে দেন।

এটাই পয়েন্ট। মাকড়সা মারতে বাড়ি পোড়াবেন কেন? একবার পড়েছিলাম আমাদের অঞ্চলে (ভারত-বাংলাদেশ) কৃষকেরা অর্ধ শিক্ষা পেয়ে কীটনাশক ব্যবহার করে উপকারী পোকাও মেরে ফেলেন। এ ছাড়া, শস্যকে বিষাক্ত করার কথা বাদই দিলাম। উপমহাদেশে ক্যানসার রোগ বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ খাদ্যে বিষক্রিয়া।

সহজভাবে বোঝাতে গেলে ধরুন কারওর শরীরে টিউমার ধরা পড়েছে। আপনি কি তাঁর শরীর থেকে টিউমার সরাবেন নাকি তাকে মেরে ফেলবেন? না, টিউমারের চিকিৎসা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

ভিকারুননিসার ঘটনার আপডেট জানতে প্রতিদিন পেপার পড়ছি। ৬ ডিসেম্বর দেখলাম শ্রেণি শিক্ষিকাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বাহ্! নকল করল ছাত্রী, টিসি দেওয়ার হুমকি দিলেন প্রিন্সিপাল, অপমান করলেন অন্যজনে, গ্রেপ্তার হলেন শ্রেণি শিক্ষিকা! অন্যদেরও গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা ছিল। প্রিন্সিপাল ও যারা মেয়েটির অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলেছেন, সবাই। তাঁরা আত্মহত্যায় প্ররোচনা করেছেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁরা গ্রেপ্তার হননি।

আচ্ছা, একটা কথা, তার জায়গায় আপনি হলে কী করতেন? আপনার স্কুলে কোনো মেয়ে নকল করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে এবং স্কুলের নিয়মে লেখা আছে নকল করলে বহিষ্কার করা হবে। ক্যানভাসে লেখা, তারপরও অ্যাপ্রুভ না হলে কেউ কেউ তেড়েফুঁড়ে আসেন অ্যাডমিনদের দিকে। সব অ্যাডমিনদের ষড়যন্ত্র। তারা এই করে ওই করে। কিন্তু অ্যাডমিনরা কেবল এটা দেখেন যে আপনি কী গ্রুপের নিয়ম মেনে চলেছেন, কী চলেননি। নিয়ম মানলে অ্যাপ্রুভ, না মানলে নাই। এখন তারা এই ক্ষোভে, লজ্জায় আত্মহত্যা করে ফেললে আমাদের দোষ? তেমনি, টিচাররাও নিয়মের বাইরে কিছু করেননি। রিমান্ডে নেওয়ার মতন অপরাধতো অবশ্যই নয়।

ইস্যু বানানো হচ্ছে বাবা-মায়ের অপমানের। হ্যাঁ, এটা একটা বিগ ডিল। এটা অবিশ্বাস্য কিছু নয়। বাংলাদেশে এই কাজটা না করলে বরং অবিশ্বাস করতাম। তবে আমি কথাবার্তার অপমানের কথা বলছি। মেয়ের বাবাকে ‘ময়লা চেয়ারে’ বসতে দেওয়া হলো, মাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল, ইত্যাদি ব্যাপারকে শুধু শুধুই ‘অপমান’ হিসেবে টেনে আনা হচ্ছে। স্কুলের অফিসে কখনই রাজ সিংহাসন বা ইতালিয়ান লেদার সোফা পাতা থাকে না। যেই আসেন, তিনি ওই ময়লা চেয়ারেই বসেন। এমন না যে, তার জন্য অর্ডার দিয়ে ময়লা চেয়ার আনানো হয়েছে। আমাদের মিডিয়াও বেশিই বাড়াবাড়ি করে।

ঘটনার আরেকটু ডিটেইল পড়তে গেলে জানা যায় মেয়ে স্কুল থেকে আগেই বাড়ি ফিরে আসে। মা একটু পরে বাড়ি ফেরত যান। বাবা দ্বারে দ্বারে মেয়ের জন্য দয়া ভিক্ষা করেন এবং একপর্যায়ে মেয়ের মায়ের ফোন কল পেয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন মেয়ে নেই।

বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট মাথায় রাখলে ধরে নিতে পারি, বাড়ি ফিরে এসে মা নিশ্চয়ই মেয়েকে আদর করে বোঝাননি যে, সব ঠিক হয়ে যাবে। দুই-চারটা কথা অবশ্যই শুনিয়েছেন। তাহলে মাও মেয়েকে দড়িতে ঝুলে যেতে উৎসাহ দিয়েছেন। যুগ যুগ ধরে এ ঘটনা ঘটে আসছে। তারপর অনেক ব্লোচনা হচ্ছে। কিন্তু মূল যে সমস্যা, পরীক্ষায় নকল, সেটার বিরুদ্ধে কোনোই ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ভিকারুননিসার মতন স্কুলে রোল নম্বর বারো যে মেয়েটির, সে কেন পরীক্ষায় নকল করবে এটি একটি প্রশ্ন। যদি নকল নাও করে, তারপরেও কেন সে স্কুলে পরীক্ষা চলাকালে সময়ে মোবাইল ফোন নিয়ে যাবে? আমাদের স্কুল-কলেজে পরীক্ষাগুলোও এমনভাবে ডিজাইন করা উচিত যাতে বই খুলে পরীক্ষা দিলেও নকল করতে কেউ না পারে। ওপেন বুক এক্সাম বা চিট শিট আমেরিকার বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই সাধারণ ঘটনা। ওপেন বুক মানে যে বই খুলে লেখা। এটা নিশ্চয়ই সবাই জানেন। চিট শিট মানে হচ্ছে একটি পেজে আমি যা খুশি লিখে নিয়ে যেতে পারব। পরীক্ষায় সেটা দেখে লিখতেও পারব। কিন্তু পরীক্ষাই এমনভাবে করা হয় যে, আমার মাথায় যদি কিছু না ঢুকে থাকে, তাহলে সেই চিট শিটই না, আস্ত বই নিয়ে বসলেও পাস করতে পারব না।

আরেকটা পরীক্ষা পদ্ধতি আছে বেশ জনপ্রিয়। সেটা হচ্ছে ক্লাসে পড়বেন, সঙ্গে একটি গ্রুপ প্রজেক্ট শুরু করবেন। পড়াশোনা এগোবে, প্রজেক্টও এগোবে। প্রজেক্ট করতে করতে আপনার মনে প্রশ্ন আসবে, গ্রুপের বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষককে জিজ্ঞেস করবেন, তারা উত্তর দেবেন। ক্লাসের শেষ দিন যেখানে বার্ষিক পরীক্ষা হবে, সেদিন আপনি আপনার গ্রুপ প্রজেক্ট জমা দেবেন। প্রেজেন্ট করবেন। শিক্ষক প্রশ্ন করবেন, আপনারা উত্তর দেবেন। সেটার ওপর আপনার পাস-ফেল। খুবই সহজ, কার্যকর ও মজার পদ্ধতি। বাংলাদেশে ক্লাস সিক্সে থাকতে ভূগোল পড়ার সময়ে ভাবতাম দক্ষিণ আমেরিকার কোন দেশে কোন ধরনের খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়, সেটা জেনে আমার কীই লাভটা হবে? সত্যি সত্যিই আমার আগ্রহ থাকত না এভাবে পড়ালেখা করতে। এ কারণেই পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট কখনই করিনি স্কুলে। অথচ আমিতো জানি আমার মাথা খুব একটা খারাপ না। মন দিয়ে যা পড়ি, তার গভীরে চলে যেতে পারি।

এখন আমি যদি ভূগোলের কোনো প্রজেক্ট করতাম, তাহলে নিজ উদ্যোগেই প্রেজেন্ট করতাম এই হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ, যেখানে অমুক অমুক দেশে তমুক তমুক খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়। আবার তমুক তমুক দেশে অমুক অমুক পদার্থ পাওয়া যায়। এই ওই কাজে লাগে এসব খনিজ।

অ্যাকাউন্টিংয়ের ছাত্রদের বুঝতে আরও সুবিধা হবে। আমরা বড় বড় কোম্পানির আস্ত আস্ত ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট তৈরি করতাম ক্লাসে বসে। তারপরে চলত সেসবের রেশিও বিশ্লেষণ। কত মজা! কার ভালো লাগে থিওরি না বুঝেই মুখস্থ করে যেতে?

মুখস্থ বিদ্যা আর নকল করার মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? দুই ক্ষেত্রেই তো ছাত্রছাত্রীর বিন্দুমাত্র লাভ হচ্ছে না। আমি সারা বছর মুখস্থ করে গেলাম ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল’। এদিকে পরীক্ষায় এল ‘পরীক্ষা শেষ হইবার পূর্বে ঘণ্টা বাজিয়া গেল’। আমার যদি বেসিক বুঝতে অসুবিধা না হয়, তাহলে আমি লিখতে পারব। যদি মুখস্থ বিদ্যা হয়, তাহলে আমি লাইব্রেরিতে বসে পরীক্ষা দিলেও ধরা খাব। ঠিক না?

কেউ কেউ বলবেন, এমন পরীক্ষাপদ্ধতি আমাদের দেশে চালু করা সম্ভব নয়। ভাই, আমরা গ্রেড সিস্টেমে পরীক্ষা দেওয়া প্রথম ব্যাচ। টেস্ট পরীক্ষা যখন পাস করি, তখনো জানি ডিভিশন পদ্ধতিতে পরীক্ষা হবে। শেষের দিকে এসে শুনি গ্রেডিং সিস্টেমে পরীক্ষা হবে। পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে বুঝিও নাই ভালো করেছি নাকি খারাপ। হিসাব করে আত্মীয়স্বজনকে বোঝাতে হয়েছে, কয়টা লেটার নিয়ে পাস করেছি। সরকার কিছু ইমপ্লিমেন্ট করতে চাইলেই করতে পারেন, বাংলাদেশে কেউ কিছু করতে পারবে না।

এরপরও অনেকেই আন্দোলন করবেন, এ ধরনের প্রশ্নপত্র, পরীক্ষা পদ্ধতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে হইচই করবেন। কিন্তু আশা করি, এটা বুঝতে কারওরই সমস্যা হবে না যে এর মাধ্যমে আমরা তোতাপাখি বানানোর শিক্ষা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে মানুষ বানানোর শিক্ষা পদ্ধতিতে প্রবেশ করব। পরীক্ষার রেজাল্ট হয়তো অনেকের খারাপ হবে। দেশজুড়ে লাখে লাখে গোল্ডেন জিপিএ পাওয়া যাবে না। কিন্তু যে ষাট-সত্তর নম্বর পাবে, সেটাও নিজের মেধা ও বুদ্ধিতেই পাবে। মুখস্থ বিদ্যার জোরে নয়।

আন্দোলনরত মেয়েদের কারওর হাতে প্ল্যাকার্ড দেখলাম। লেখা আছে, ‘নকল করা যদি হয় অপরাধ, তবে আমরাও শাস্তি চাই।’ সিরিয়াসলি? মেয়েদের না হয় বয়স কম, বুদ্ধি বৃদ্ধি ঘটেনি, তাই বলে অভিভাবকেরাও সাপোর্ট করে যাচ্ছেন? ইমোশনাল হওয়া এক ব্যাপার, আর মাথা নষ্ট হওয়া আরেক ব্যাপার। আজকে একটা মেয়ে নকল করায় অপরাধ ও অপমানবোধে আত্মহত্যা করেছে, তাই নকল করা হালাল হয়ে গেল? কালকে রেপও তাহলে হালাল হয়ে যাবে? খুনও তাই?

একদিকে শিক্ষক গ্রেপ্তার, অন্যদিকে নকলের হালালিকরণ। আমরা মাকড়সার আতঙ্কে বাড়ি পুড়িয়ে দিতে ওস্তাদ! গুড জব! কীপ ইট আপ!

মঞ্জুর চৌধুরী: ডালাস, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: <[email protected]>