চাঁনলতার হাতে বিজয়ফুল!

সেই ভয়াবহ কালরাতে নন্দীপুর গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কী নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল। পুরো গ্রাম জুড়ে ভয়াবহ আতঙ্ক। ছেলে, বুড়ো, উঠতি তরুণী, সদ্য বিবাহিত নারী কেউ রেহাই পায়নি সেই নির্মমতা থেকে। ধানের গলুই, মাটির গর্ত আর গোয়ালঘরে লুকিয়েও আত্মরক্ষা করতে পারেনি কেউ।

লোহর নদীর তীর ঘেঁষেই আমিনাদের বাড়ি। চড়ুইভাতির কোলাহল শেষে খেতের আইল বেয়ে মাছধরা আর বনবাদাড়ে চষে বেড়ানোই যার একমাত্র কাজ। হঠাৎই বিয়ে হয়ে যায় সোয়াবই গাঁয়ের মুনশি বাড়ির ছেলে কাশেমের সঙ্গে। শ্বশুরবাড়িতে আর যাওয়া হয়নি। নৌকা বাড়ির ঘাটে ভিড়বার আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নির্যাতিত হয় আমিনা। দুই দিন পর বিলপাড়ের খেতে কচুরিপানার ভেতর ফুলে ফেঁপে ওঠে আমিনার লাশ। সারা শরীরজুড়ে নষ্টভ্রষ্ট লম্পটদের মরণকামড়। বাবার বুক ভারী হয়ে আসে। এত ভারী! ফিরে আর কোনো দিন দেখা হয়নি বটতলা, সেই চিরচেনা বাগানবাড়ি, পূর্ব জনমের ভিটা নন্দীপুর।

কুদ্দুস গ্রামের হাটে সবজি বেঁচে। বিক্রি বাট্টা ভালো হলে সালেহা ও দুই শিশুপুত্রসহ সংসার ভালোই চলে। বিছরায় ফলফলাদি, পিছ বাড়ির গর্তে মাছ চাষ আর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দুই ফসলি জমিতে ধান চাষ করেও বাকি চাহিদা পূরণ হয়। সেই ভয়াবহ রাতে স্ত্রী–সন্তান নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা কুদ্দুসকে ডেকে নিয়ে মেরে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী। রাজাকার জমিরউদ্দিন এই হত্যার নেপথ্যে ছিলেন। গ্রাম ঘুরে ঘুরে কোথায় কোন মুক্তিযোদ্ধা লুকিয়ে আছেন সেই সংবাদ পৌঁছে দিত তাদের কাছে। বিকৃত উল্লাসে ফেটে পড়ত হায়েনার দল। সালেহা ভাইয়ের বাড়িতেও ঠাঁই পায়নি। দূরের আত্মীয়ের বাড়িতে বেছে নিতে হয়েছিল এক নির্মম জীবন। দুই ছেলে এখনো কামলা খেটে বাঁচে।

ভাতঘরের স্বপ্ন নিয়েই জামিলা এসেছিলেন ফজলের সংসারে। ঢেঁকি ঘরজুড়ে ধানি গন্ধের যে জীবন সে তো সোহাগের। হাটবারে মজার পুটুলি, এক গাছি লালচুড়ি, স্টিমারে গঞ্জে যাওয়া আর দরগাহ বাড়ির পদ্মপুকুরে হুন্দামেন্দির চন্দন স্নান অতঃপর নিষ্ঠুর সমাজের রক্তচক্ষু, চারিত্রিক অপবাদ সইতে না পেরে কড়ইগাছে ঝুলে চরম অসহায়ত্বের কাছে আত্মাহুতি, জীবন সমর্পণ। সে দিন সেই মৃতদেহ কেউ ছুঁতেও আসেনি। শকুনের ব্যবচ্ছেদে লন্ডভন্ড জামিলার ছেলে সুজনও জারজ উপাধি পেয়ে গ্রামের মাতব্বরদের সালিসে নন্দীপুর ছাড়তে বাধ্য হয়।

মাস্টার বাড়িতে সারা বছরব্যাপী জমিজমা দেখাশোনার কাজ করত তমিজউদ্দিন। ওই বাড়ির এক কোণায় একটা ছাপড়া বানিয়ে স্ত্রী সুলেখা ও ছেলে নয়নকে নিয়ে ঘর পেতেছিলেন তমিজউদ্দিন। হঠাৎ মধ্যরাতে পাকিস্তানি আর্মি নয়নকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। রাজাকার আবদুল কাদির নয়নকে উদ্ধার করার অছিলায় সুলেখাকেও ফুসলিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পাকিস্তানি আর্মির হাতে সম্ভ্রম হারিয়েও একমাত্র পুত্র নয়নকে বাঁচাতে পারেনি সুলেখা। এলোপাতাড়ি গুলিতে নৃশংসভাবে নিহত হয় নয়ন। সুলেখা নয়নের পিরান হাতে পথে পথে কাঁদে, বিলাপ করে ‘ও নয়নের বাপ, তুমি অহনও যুদ্ধে যাও নাই...যুদ্ধে যাও নাই! আমার নয়ন আর নাই, আমি কী লইয়া বাঁচুম’। তমিজউদ্দিন স্ত্রী–সন্তান আর নিজের জীবনের বিনিময়ে মায়ের বুক ফুঁড়ে উত্তোলন করেছে স্বাধীন পতাকা।

উঠোনে শীতলপাটি বিছিয়ে আমি আর আমার কাজিন জেনী মন দিয়ে শুনছি রহমত চাচার স্মৃতি আওড়ানো একাত্তরের লোমহর্ষক ঘটনাগুলো। বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে নেমে এসেছে একফালি রূপালি চাঁদ। অথচ ভিজে যাচ্ছি না আমি, বুকে বইছে হু হু কান্না, এক গহিন আর্তনাদ। কান্নাটুকু বিলপাড় ঘেঁষে দখিনের বাতাসটুকুকে আরও ভারী করে তুলছে।

ওই দূর হিজল গাঁয়ে, বটতলায় দাঁড়িয়ে রূপচাঁন আজও কাঁদে। সোনার নোলক হারিয়ে গেছে সংসার বুঝে ওঠার আগেই। একমাত্র সন্তান যুদ্ধে গিয়ে আর ফেরত আসেনি। সন্তানকে এক মুঠো ভাত মুখে তুলে দেওয়ার অপেক্ষায় আজও মা! বিড়বিড় করে বলেন, ‘মায়ের মুখ না দেইখা ক্যামনে থাকস বাজান, পরান পুড়ে না!’ পুঁই পাতা নড়েচড়ে, একচালার ঘরের ছাদে উঁকি দেয় শিম ফুল। বাহির বাড়িতে খোলা চুল আর বুক পাঁজর চৌচির হওয়া এক প্যাঁচে ছেঁড়া শাড়িতে আঁচল বিছিয়ে বিলাপ করছেন মা।

আঁকাবাঁকা মেঠো পথে হেঁটে যেতেই বাউল করিম চাচার গানে উদাস হই—‘রে মন আমার, কেন বান্ধো দালানঘর...।’

ধানের শিষে দখিনা বাতাসের চঞ্চল শিহরণ। মাটির রাস্তার একপাশে জলের টলটলে ঢেউ। কোনো কিছুই চাপা কান্না আর হৃদয়ক্ষরণের ব্যান্ডেজ হতে পারছে না। হঠাৎ ইথারে ভাসে সেই গান—

‘সব কটা জানালা খুলে দাও না
আমি গাইব গাইব বিজয়েরই গান...।’

চাঁনলতার হাতে তখন বিজয়ফুল! ডালিম ফুলের মতন রাঙা ঠোঁটে ওই তো মা হাসছে।