জীবনের বোধ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পূর্ণিমা রাত এলেই আমি জানালার পর্দা সরিয়ে রাখি। আমাদের বাসার পাশের জায়গাটা ফাঁকা। রাতে চাঁদের আলো সরাসরি আমাদের শোয়ার ঘরে ঢুকে পরে। আকাশের চাঁদকে না দেখলেও মেঝের শুভ্র সাদা টাইলসের মধ্যে তার প্রতিফলন দেখে বুঝতে পারি চাঁদের অবস্থান এখন আকাশের কোন জায়গাটায়। প্রায় প্রতি পূর্ণিমা রাতেই ভালো ঘুম হয় না। বারান্দায় গিয়ে চেয়ার পেতে বসে থাকি চাঁদের দিকে চেয়ে। সূর্যের সঙ্গে চাঁদের এটাই তফাৎ। প্রখর সূর্যের সৌন্দর্য কখনোই খালি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু চাঁদের দিকে চেয়ে রাত পার করে দেওয়া যায়। আমি বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে একসময় ক্লান্ত হয়ে শোয়ার ঘরে এসে শুয়ে পড়ি। তবুও ঘুম আসে না। জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলোর দিকে চেয়ে থাকি। এভাবেই কখন ঘুমিয়ে যাই আর টের পাই না।

আজও কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলেই দেখলাম জানালার পর্দাগুলো জোরেশোরে নড়ছে। বাইরে বেশ বেগে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। আমি উঠে গিয়ে জানালার কাচটা বন্ধ করে দিয়ে এসে বিছানায় বসলাম। হঠাৎ কেউ একজন বলে উঠল, কি আলী সাহেব চিনতে পারছেন না মনে হয়? আমি বললাম তুমি এখানে কী করে? জানালার অর্ধেক অংশ দখল করে আছে ছোট ডাইনিং টেবিল। আমাদের এই ছোট্ট গ্রানি ফ্ল্যাটে জায়গার সংকুলান হয় না বলে ডাইনিং টেবিলটাকে কোনোমতে শোয়ার ঘরে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। ওই ডাইনিং টেবিলে বসে আমরা খাই না। শুধুমাত্র কোনো অতিথি এলে তাকে সেখানে খেতে দেওয়া হয়। আমরা সাধারণত দলবেঁধে মেঝেতে বসেই খাওয়া সেরে নিই।

কিছুক্ষণ আগে যে কথা বলল, আমি তাকে চিনি খুব ভালোভাবেই। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না। কারণ সে এখন সিঙ্গাপুরের একটা হাসপাতালে ভর্তি। আমার ছাত্র রানা। আমি তাকে বেশ কয়েক বছর পড়িয়েছিলাম। বলতে গেলে মাধ্যমিকের পুরো সময়টায় আমি তাকে পড়িয়েছি। এই পড়াশোনাটা ছিল উভয়মুখী। আমরা পড়াশোনার বাইরের বিষয় নিয়েই বেশি বেশি আলোচনা করতাম। সেখানে রাজনীতির কোনো স্থান ছিল না। বরং আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল সমকালীন সাহিত্য থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র সবকিছুই। রানা ছিল হ‌ুমায়ূন আহমেদের ভীষণ ভক্ত। এখনো তাই আছে। আর আমি হচ্ছি জাফর ইকবালের ভক্ত। আমাদের মধ্যে এ নিয়েও দীর্ঘক্ষণ আলাপ হতো যে তাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে কার মেধা কতখানি প্রখর। রানার কাছ থেকেই ধার নিয়ে নিয়ে আমি হ‌ুমায়ূন আহমেদের তখন পর্যন্ত প্রকাশিত সব বই পড়ে ফেলেছিলাম।

হ‌ুমায়ূন আহমেদের বই নিয়ে আমি রানাকে বলতাম, শোনো ওনার বই পড়তে ভালো লাগে। কিন্তু পড়া শেষ করার পর মনে হয় ছাতার একটা বই পড়ে সময় নষ্ট করলাম। তার উত্তরে রানা বলত, শোনেন আলী সাহেব, আপনি পড়ার সময় উপভোগ করছেন এটাই আসল ব্যাপার। আর বাংলাদেশের বইবিমুখ জনগণকে বই পড়ার অভ্যাসটা তো উনিই তৈরি করে দিলেন। আপনি শুরুতে ওনার বই পড়বেন। তারপর আপনার বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেলে আপনি আরও অনেক বই পড়ার আগ্রহবোধ করবেন। আমি বলতাম তা ঠিক, কিন্তু উনি ব্যক্তিগতভাবে বিতর্কিত হয়ে ওনার সৃষ্টিগুলোকেও বিতর্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। উত্তরে রানা বলত, আমরা খুব সহজেই মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাতে শুরু করি। আমি বললাম তাও ঠিক, আমাদের শুধুই ওনার সৃষ্টি নিয়ে ভাবা উচিত। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, একজন ব্যক্তি তো তার সৃষ্টির বাইরের কেউ নন। রানা বলত সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু একজন মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে ঠিক কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সেটা আমি আপনি শুধুই অনুমান করতে পারি। এমনই আরও কত আলোচনায় আমাদের সময় চলে যেত।

মানুষ যেমন তার সবচেয়ে দুষ্ট অবাধ্য ছেলেকে অবচেতনভাবেই একটু বেশি ভালোবাসেন, আমিও তেমনি রানাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দেখতাম। পড়াশোনায় রানা কোনো কালেই সিরিয়াস ছিল না। মোটামুটি একটা পড়াশোনা করে যেত যাতে পাস করা যায়। কিন্তু আমি জানতাম ওর মধ্যে মেধা আছে। সেটাকে সামান্য কাজে লাগালেই পরীক্ষায় অনেক ভালো করতে পারে। কিন্তু রানা ইচ্ছে করেই সেটা করত না। আমিও চাপাচাপি করতাম না। খালাম্মা আমাকে মাঝেমধ্যে তাগাদা দিলে আমি বলতাম, রানা ঠিক সময়মতো ভালো করবে। সময়মতো বলতে আমি বুঝতাম, সেটা অবশ্য পরিষ্কার করে বলতাম না। এর মধ্যেই আমি বুয়েট পাস দিয়ে চাকরি জীবনে ঢুকে পড়লাম। রানার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই যোগাযোগ কমে গেল। তবে ওর মাধ্যমিকের ফলাফলের পর খালাম্মা ফোন দিয়ে জানালেন, রানা মাধ্যমিকে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। আমি তখন খালাম্মাকে বললাম, আমি কিন্তু আগেই বলেছিলাম। খালাম্মা শুনে হাসলেন। তারপর রানার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হলো। রানা আমাকে বরাবরই মজা করে আলী সাহেব বলে ডাকত।

আমি রানার কোণাকুনি চেয়ারটা টেনে নিতে নিতে বললাম, কী খবর তোমার? উত্তরে রানা বলল, ইয়া আলী আপনার সঙ্গে অনেক দিন আড্ডা দেওয়া হয় না। তাই চলে আসলাম। রানা একটু বেশি খুশি থাকলে আমাকে আলী থেকে ইয়া আলী বলে সম্বোধন করে। আমি বললাম ভালো করেছ। তোমাকে পড়ানো শেষ করার পর তো আর তোমার সঙ্গে আড্ডায় দেওয়া হলো না। তুমি এখন কেমন আছ? উত্তরে রানা বলল, একজন ক্যানসারের রোগী যেমন থাকে তেমনই আছি। তবে মনে অনেক জোর পাই। এ যাত্রা মনে হয় বেঁচেই গেলাম আপনাদের ভালোবাসার জোরে। আমার চিকিৎসা শুরু হওয়ার পর আপনারা সবাই আমার প্রতি যে পরিমাণ ভালোবাসা দেখিয়েছেন সেই ভালোবাসাতেই আমার রোগ অর্ধেক ভালো হয়ে গেছে। আর বাকিটাও সেরে যাবে জটিল চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আচ্ছা বাদ দেন, রোগশোক নিয়ে আলাপ করতে ভালো লাগছে না। অন্য কিছু নিয়ে আলাপ করা যাক। আপনার সঙ্গে প্রায় এক যুগ পর দেখা।

আমি বললাম রানা মানুষ জন্ম নেয় আবার একদিন মরেও যায়। এটা কী চন্দ্র কারিগরের কোনো মজার খেলা নাকি এর কোনো গুঢ় তত্ত্ব আছে। আমার মনে হয় চন্দ্র কারিগর মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন একটা বিষয় উপলব্ধি করার জন্য, সেটা হচ্ছে ভালোবাসা। এই যেমন তুমি বললে, তুমি আমাদের ভালোবাসার জোরে এযাত্রা বেঁচে গেছ। ভালোবাসা তো আর ওষুধ না। এমনকি দেখতেও পাওয়া যায় না, তবুও কত তার শক্তি।

ইয়া আলী আমারও তাই মনে হয়। উত্তরে বলল রানা।

কিন্তু একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢোকে না। আমি আবার বললাম। সেটা হলো মানুষকে যখন উনি পৃথিবীতে পাঠালেনই তখন কেন তিনি সবাইকে সুখী ও সুস্থ মানুষ হিসেবে পাঠালেন না। এটা কী চন্দ্র কারিগরের কোনো ছেলেমানুষি খেলা আর আমরা সেই খেলারই অংশ মাত্র। রানা বলল আমিও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরি মাঝেমধ্যে। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে এই বৈচিত্র্যই আসলে মানুষকে অন্য সৃষ্টি থেকে আলাদা করেছে।

রানার অনবরত কথা বলে যেতে কষ্ট হচ্ছিল দেখে বেশির ভাগ কথা আমি একই বলে যাচ্ছিলাম। রানা দম নিয়ে নিয়ে একটা দুইটা লাইন বলে যাচ্ছিল। আমার ভাবতেও অবাক লাগছিল এই সেই রানা, যার সঙ্গে আড্ডা দিতে গেলে কথা বলারই সুযোগ পাওয়া দায় হতো। আমি বললাম, এই যে ফিনকি দেওয়া জ্যোৎস্না, মৃদুমন্দ বাতাস, তুমি আমি এই পৃথিবীতে আসার আগেও ছিল আবার আমি তুমি চলে যাওয়ার পরেও থাকবে। আমি তুমি শুধু সামান্য সময়ের জন্য দর্শকের ভূমিকায় এখানে আছি। আবার অনন্তকালের দিকে যাত্রা করব।

রানা বলল হ‌ুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব আমার কাছে ওনার তীক্ষ্ণ রসবোধ। উনি হাস্যরসের মাধ্যমে যেভাবে জীবনের ও সমাজের ক্ষতগুলোকে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে তেমনটা আর কেউ পারেননি। সবাই কঠিন সত্যগুলোকে আরও কঠিন করে উপস্থাপন করায় পাঠক সেই সত্যটাকে আর নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারেননি। কিন্তু ওনার বলার ধরনটা সহজ হওয়াতে সবাই দ্রুতই সেটা ধারণ করতে পেরেছে। আর কোনো কিছু একবার মনে ধারণ করলে সেটা কথা ও কর্মে প্রতিফলিত হবেই। যেমন বহুব্রীহি নাটকে উনি যুদ্ধাপরাধীদের কীভাবে একহাত নিলেন ভেবে দেখেন। তখনকার সময়ে এই বিষয়ে কথা বলাটাই ছিল অপরাধের পর্যায়ের। তবুও উনি টিয়া পাখির মুখ দিয়ে তাদের রাজাকার বলিয়ে ছেড়েছেন। উনি এমনভাবে কথাগুলো বলিয়েছেন যে, সবাই অনেক আনন্দ পেয়েছে আবার সঙ্গে সঙ্গেই সেটাকে অন্তরে ধারণও করেছে।

আমি বললাম একদম ঠিক। তবে আমার কাছে ওনার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব কি জানো? ওনার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে আমাদের শহরমুখী মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে উনি শেকড়ের কাছে নিয়ে গেছেন। শহরমুখী মানুষদের একটা সহজাত প্রবণতা হচ্ছে রাতারাতি নিজেকে শহুরে প্রমাণিত করা। অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে, নিজেকে শহুরে প্রমাণিত করতে না পারলে অন্য শহুরেদের কাছে আর মানসম্মান নিয়ে টিকে থাকা যাচ্ছে না। উনি সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির কাছে গ্রামের অনাড়ম্বর জীবনের গল্প বলে গেছেন। কিন্তু এমনভাবে বলেছেন যেন শহুরে মানুষজন সেটা সহজেই নিতে ও নিজেদের শেকড় নিয়ে কিছু সময়ের জন্য হলেও গর্ববোধ করতে পারে। আমি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি বহু শিক্ষিত শহুরে মানুষ এমনভাবে চলাফেরা করেন যেন তাদের আদিপুরুষ এই শহরেই ছিলেন। তবে সবচেয়ে খারাপ লাগে তারা নিজেদের আরও বেশি শহুরে প্রমাণ করতে গিয়ে গ্রামীণ মানুষদের ছোট করে ফেলেন। তুমি যদি উড়ে যায় বকপক্ষী নাটকের কথায় ধরো, তাহলে দেখবে উনি কত সুন্দরভাবে গ্রামের জীবনকে হাস্যরসের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এই নাটকটা আমি যতবার দেখি ততবারই মুগ্ধ হই এবং আবারও দেখার ইচ্ছে তৈরি হয়।

রানা বলল, আপনি একদম ঠিক বলেছেন। পাশাপাশি উনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে অনুভব করেছেন দেখেন। আগুনের পরশমণি ছবিটা যেই দেখবে সেই মুগ্ধ হবে। আপনার মনে আছে সেই দৃশ্যটার কথা যেখানে বদিরা একটা সরকারি অফিসে বোমা পেতে অফিসের লোকজনের কাছে যায় অ্যালার্ট করতে। একজন কর্মকর্তাকে গিয়ে বলে, আমরা মুক্তিবাহিনীর ছেলে কিছুক্ষণের মধ্যে এই ভবনটা উড়িয়ে দেওয়া হবে আপনারা সবাই বেরিয়ে যান। তখন সেই কর্মকর্তা বদিকে প্রশ্ন করে মুক্তিবাহিনী সেটা আবার কী? তখন বদি তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সজোরে তার গালে চপেটাঘাত করে প্রশ্নের জবাব দেয়। আমার মনে হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুললেই আমাদের এই কাজটা করা উচিত।

আমি বললাম, তুমি একদম ঠিক কথা বলেছ। এই জায়গাগুলোতে আমাদের কোনোভাবেই আপস করার সুযোগ নেই। পাশাপাশি তুমি যদি ওনার জ্যোৎস্না এবং জননীর গল্প পড় তাহলে দেখবে সেখানে উনি খুবই সচেতনভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র থেকে কয়েকটা পাতার বিবরণ হুবহু তুলে দিয়েছেন। যেখানে কয়েকজন ডোমের ভাষায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের প্রতি যে সহিংসতা হয়েছিল তার একটা সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যাবে। কারণ মুক্তিযুদ্ধ বলতে তো ইদানীং আমরা শুধু সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ আর এগারোটা সেক্টরের কথায় শুনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ছিল আসলে একটা সামগ্রিক যুদ্ধ এবং সেখানে সব বয়সী বাঙালিই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী অংশ নিয়েছিল। তার মধ্যে মেয়েরাও ছিল। কিন্তু লোকলজ্জাবশত আমরা মেয়েদের বিষয়টাকে এড়িয়ে যাই। আমার মনে হয় সে কারণেই উনি ইচ্ছে করেই ওই কটা পাতা যুক্ত করেছেন যাতে করে আমরা মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণকে কোনোভাবেই ছোট করে না দেখি এবং বুঝতে পারি নারীরা মুক্তিযুদ্ধের সময় কতটা বীভৎসতার শিকার হয়েছিলেন।

রানা বলল, আপনি একদম ঠিক বলেছেন। এর বাইরে এসে উনি কিন্তু ক্লান্ত শ্রান্ত শহুরে বাঙালিকে জীবনের গান শুনিয়েছেন। উনিই মনে হয় একমাত্র লেখক যিনি শহুরে জ্যাম ঘাম নিয়ে এত বিস্তারিত লিখেছেন। একেবারে ড্রেনের ময়লা পানি থেকে শুরু করে পাইপের মধ্যে মানুষের জীবনধারাকে দিয়েছেন শিল্পের মাত্রা। আপনার মনে আছে তাহারা নাটকের কথা। কী দুর্দান্ত চিত্রায়ণ। কী সুন্দর সংলাপ। সেখানে একই সঙ্গে আছে জীবনযুদ্ধের গল্প আবার আছে অধিকার প্রতিষ্ঠার গল্প। আবার আছে জীবনের অন্তর্নিহিত সম্পর্কগুলোর কথা। মা কোনো পরিস্থিতিতেই তার সন্তানদের ছেড়ে যান না, এই কথাটা উনি কত সহজভাবে বলিয়েছেন মায়ের মুখ দিয়ে। আবার আমরা কীভাবে আমাদের কাজের মেয়েদের জীবনমান উন্নয়নে অবদান রাখতে পারি সেটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন।

আমি বললাম, খুবই ভালো বলেছ। পাশাপাশি হিমুর মুখ দিয়ে উনি বলিয়েছেন শহুরে জীবনের অনিয়ম অব্যবস্থাপনার কথা। আবার উনি একই সঙ্গে বলেছেন সেই শহরের জোৎস্নালোকিত রাতের কথা, কদমের কথা। আর বলেছেন মেঘ ভেঙে নেমে আসা বৃষ্টির কথা। এসো করো স্নান নবধারা জলে। জীবনবোধের এমন বাস্তব উদাহরণই আসলে ওনার লেখাকে পাঠকপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। আর ওনার লেখার ভাষাটাও ছিল খুবই সহজসাধ্য। যে ভাষায় আসলে আমরা প্রতিনিয়ত ভাব বিনিময় করছি। তাই মূলধারার সাহিত্যিকেরা তার লেখাকে সাহিত্যের মর্যাদা দিতে চাননি। অবশ্য উনি সেটাকে থোড়াই কেয়ার করতেন। উনি বরং সেই সব সমালোচনাকে পজেটিভলি নিয়ে আরও বেশি বেশি লিখে গেছেন। আপনি যদি তার মোটা আকারের মানে বড় উপন্যাসগুলো পড়েন তাহলে বুঝবেন তার মধ্যে মূলধারার সাহিত্য লেখারও ক্ষমতা ছিল। কিন্তু উনি ইচ্ছে করেই আর সেটাকে ব্যবহার করেননি।

রানা বলল, আমরাতো তার আসল কৃতিত্বের কোথায় বেমালুম ভুলে বসে আছি। বাঙালির বই পড়ার অভ্যাস ছিল না। উনিই কিন্তু সেটা একা নিজ দায়িত্বে তৈরি করে দিয়েছেন। ওনার বই পড়ার সময়টা আপনি অবশ্যই উপভোগ করবেন যদিও বেশির ভাগ বই পড়ার শেষেই আপনি বলে উঠবেন যে সময় নষ্ট করলাম। কিন্তু সেই সঙ্গে আপনি কিন্তু সময়টা উপভোগও করেছেন। এই যেমন আমি ওনার বই দিয়ে বই পড়া শুরু করলেও যখন বই পড়ার অভ্যাসটা হয়ে গেল তখন পৃথিবীর আরও যতরকমের বই হাতের কাছে পেয়েছি সবই গোগ্রাসে গিলেছি।

এতক্ষণ অনবরত কথা বলার কারণে রানা প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছিল। ওর শরীরে এখন ক্যানসারের কোষগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে ওর ছোট বোন নীলপলার দেওয়া বোনমেরো থেকে তৈরি সুস্থ সবল কোষ। আমি নিশ্চিত জানি সেই যুদ্ধে ক্যানসারের কোষগুলো পরাজিত হবেই কারণ ভাইবোনের এই অকৃত্রিম শক্তির চেয়ে পৃথিবীর কোনো কিছুই শক্তশালী নয়। আমি কিছুটা দম নেওয়ার সময় দিয়ে একাই কথা চালিয়ে নিচ্ছিলাম।

আমি বললাম এই ব্যাপারটাতে আমি তোমার সঙ্গে শতভাগ একমত পোষণ করছি। তবে আমার মনে দাগ কেটে আছে ওনার আগুনের পরশমণি ছবির শেষ দৃশ্যটা যেটাকে আমি ওনার সিগনেচার দৃশ্য বলি। জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন মানুষের জীবনের প্রতি আকুলতা। বদি হাত বাড়িয়ে দিয়ে সূর্যের আলো স্পর্শ করতে চাইছে। আমার কাছে মনে হয়েছে বদি আসলে জীবনকে স্পর্শ করতে চাইছে কারণ সূর্যই তো পৃথিবীতে সমস্ত জীবনের উৎস।

এটুকু বলার পরই রানা হঠাৎ করেই বলে উঠল, আলী ভাই আমি সূর্য স্পর্শ করতে চাই।

রানার কথাগুলো আমার কানে অস্পষ্টভাবে ভেসে আসে। বরং সেটাকে ছাপিয়ে মোরগের গলা শোনা যেতে থাকে। আমি মনে মনে বলছিলাম আমার কী আবারও হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। তাড়াতাড়ি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি ভোররাতের চাঁদের আলো সত্যিই আমাদের ঘরের মেঝেতে জ্যোৎস্নার চাঁদর তৈরি করেছে ঠিক যেমন মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের কবরের ওপর জ্যোৎস্নার আলো খেলকরার কথা হ‌ুমায়ূন আহমেদ বলে গেছেন তার জ্যোৎস্না ও জননীর গল্পের বইয়ে। আমি উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে আবারও মোরগের গলার আওয়াজ পেলাম। তারা সকালের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। তখন বুঝতে পারলাম আসল ঘটনাটা। নাজমুল ভাই ওনার নাতনি জেইনা ও জাহিয়াকে মুরগি চেনানোর জন্য স্যাটারডে মার্কেট থেকে সস্তায় দুটো মোরগ কিনে এনেছেন। তারাই গত কদিন ধরে সকালবেলা ডেকে চলেছে। তার মানে একটু পরেই সূর্য উঠবে।

প্রকৃতিতে একটা জীবনমুখী পরিবেশ। রাতের শেষে সকাল হচ্ছে। মোরগ তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। নতুন একটা দিনের শুরু হতে যাচ্ছে রাত শেষে। তখন আমি ভাবতে থাকি রানারও জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘ ক্লান্তিকর যুদ্ধ শেষে। আর রানার সঙ্গে কথোপকথনের এই স্বপ্নটা আমি দেখছি একদম ভোরবেলায়। আমার দাদি বলতেন, ভোরবেলায় দেখা স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়।

লেখকের ইমেইল: <[email protected]>