অদ্ভুত মানুষ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ইস্ট গার্ডেন শপিং সেন্টারের নিচতলায় কিউতে দাঁড়িয়ে আছি কফি কিনতে। ঠিক তখনই আমার পেছনে এসে দাঁড়াল ছেলেটি। বয়স তেইশ–চব্বিশ হবে। মারোবরা বিচেও একদিন দেখেছি ছেলেটিকে। কেমন করে যেন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তেমন গুরুত্ব দিইনি। হয়তো আমাকে দেখতে তার পরিচিত কারও মতো মনে হয়েছে। এমন তো কতই হয়। তাই কোনো কথা হয়নি সেদিন।

পেছনে এসে দাঁড়ালে আমি ওর দিকে তাকাতেই ছেলিটি বলল, কেমন আছ?

ছেলেটির অ্যাকসেন্ট শুনে আর বুঝতে বাকি রইল না, অরিজিন আমেরিকায়। একসঙ্গে কফি হাতে হাঁটতে থাকলে, কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করতেই বলল, ম্যাকিউরিফিল্ড যাব। একটা প্রোপার্টি দেখতে।

: কীভাবে যাবে?

: এই তো ট্যাক্সিতে যাব। সাধারণত ট্যাক্সিতেই চলাফেরা করি। আমার গাড়ি নেই। ড্রাইভিং মোটেই এনজয় করি না।

ছেলেটির কথাবার্তা কেমন যেন ব্যতিক্রম লাগছে। ট্যাক্সিতে চলাফেরা করে। অদ্ভুত! মানুষ দুটো ডলার বাঁচাতে কত চেষ্টাই না করে। ছেলেটি বড়জোর মাসকট স্টেশন পর্যন্ত যেতে পারে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে অতি সুলভে ম্যকিউরিফিল্ড যাওয়া যায়।

বললাম, যদি তোমার আপত্তি না থাকে চল আমার সঙ্গে। ওখানে আমারও একটা প্রোপার্টি আছে। দেখতে যাচ্ছি। মাসখানেক আগে আমি একটি গাড়ি কিনেছি। নিশান এক্সট্রেইল। আশা করি তোমার পছন্দ হবে।

ছেলেটা অনায়াসেই রাজি হয়ে গেল। গাড়িতে উঠেই বলল, আমি ম্যাথিও। আমিও আমার নাম বললাম।

বিভিন্ন কথাবার্তা শেষে গাড়িটি এম ফাইভ ট্যানেলের কাছাকাছি পৌঁছালে বললাম, সিডনিতে কত দিন ধরে আছ?

: এই তো দুই বছর?

: কী কর এখানে?

: ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসে ফিজিকসে পড়ছি। পাশাপাশি ইষ্ট গার্ডেনে একটা শপে পার্টটাইম চাকরি করি।

: খুব ভালো। আচ্ছা, ট্যাক্সিতে চলাফেরা তো অনেক খরচ। পার্টটাইম চাকরি করে তোমার নিজের জন্য কোনো কিছু থাকে বলে তো মনে হয় না।

: না, অবশ্যই থাকে না। মায়ের সঙ্গে থাকি। খরচও তেমন নেই। চাকরির টাকা পুরোটাই এভাবে খরচ করি। ভালো লাগে। তবে আমার অনেক টাকা।

: তোমার অনেক টাকা?

: হ্যাঁ, আমার দাদা আমাকে এক শ ত্রিশ মিলিয়ন ডলার উইল করে গেছেন। আর বাবারও কিছু টাকা ছিল। তিন বছর হয় বাবা নেই। ব্রেইন ক্যানসারে মারা গেছেন। বাবা তেমন ক্যাশ রেখে না গেলেও রেখে গেছেন বেশ কিছু প্রোপার্টি। দাদার টাকাগুলো ব্যাংকে সেভাবেই রেখে দিয়েছি। আর বাবার প্রোপার্টিগুলো বিক্রি করে এখানে প্রোপার্টিতেই ইনভেস্ট করছি।

আকাশ থেকে পড়লেও মনে হয় এত অবাক হতাম না। এই ছেলে বলে কী!

: আচ্ছা, তোমার চাকরি করার কী দরকার?

: হ্যাঁ। দরকার আছে। কারণ আমি ওই টাকায় হাত দিতে চাই না।

কেমন যেন সন্দেহ লাগল। বললাম, এত টাকা তোমার এক জীবনে খরচ করে শেষ করতে পারবে বলে তো মনে হয় না।

: হ্যাঁ, সত্যিই তাই। তবে এ টাকা ওদের উপার্জিত টাকা। এখানে আমার তো কোনো ক্রেডিট নেই।

: আচ্ছা, কিছু যদি মনে না করো, একটা বিষয় জানতে চাই।

: হ্যাঁ বলো।

: এত টাকা তারা কীভাবে আয় করলেন?

একটা এক ঝলক হাসিতে আমার দিকে তাকিয়ে ম্যাথিও বলল, প্রতারণার মাধ্যমে।

আমার কেমন যেন লাগছে। এসব কী বলছে ছেলেটা। তবে ওর কথাবার্তায় বেশ আত্মবিশ্বাসের ছাপ। মানসিক অসুস্থতা বা নেশাগ্রস্ত বলেও মনে হচ্ছে না।

বললাম, প্রতারণা!

: হ্যাঁ, তাই বলছি। আমার দাদা ছিল খুবই এক্সপার্ট গেমলার। তিনি এমন এক আকর্ষণীয় গেম আবিষ্কার করেন, যে গেম খেলতে গিয়ে মানুষ লস্ট করত বেশি, উইন করত খুবই কম। এই যেমন এক শজনে আটানব্বইজনই হারত, দুজন হয়তো জিতত। দাদা আমার বাবাকে ওই গেমটা শেখান। তবে দাদা মারা যাওয়ার দুই বছর পর আমার বাবাও মারা যান।

এ সময় ম্যাথিও কিছু আবেগ তাড়িত হয়। ছলছল করে ওঠা চোখদুটো আড়াল করে বলল, দাদা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। আমি আমার দেশকে অনেক মিস করি।

: হ্যাঁ, তাই তো। আমিও খুবই নস্টালজিক। আচ্ছা ম্যাথিও, তোমার দেশে এত বড় বড় ইউনিভার্সটি থাকতে এই অস্ট্রেলিয়াতে কী কারণে আসা? খুব ভালো লাগে নিশ্চয়ই।

: আমার দিক থেকে তেমন বড় কোনো কারণ নেই যদিও। মা চলে এলেন। মায়ের ধারণা আমেরিকাতে থাকলে গান ভায়োলেন্সে হঠাৎ একদিন আমি মারা পড়তে পারি। তাই মা কিছুটা জোর করেই আমাকে নিয়ে এলেন এখানে।

: তোমার মায়ের শঙ্কা অমূলক নয়। গান ভায়োলেন্সে আমেরিকায় বছরে প্রায় ত্রিশ হাজার লোক মারা পড়ে।

: হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমার আর মায়ের গান দুটো জমা দিয়েই সিডনির উদ্দেশে ফ্লাই করি। এখানে তো দেখছি মানুষজন সঙ্গে কোনো গান রাখে না। অনুমতিও নেই। তাই এত ভায়োলেন্সও নেই এখানে। আচ্ছা এ দেশে তুমি কত বছর ধরে আছ।

: এই তো দেখতে দেখতে চৌদ্দ বছর হয়ে গেল।

: কখনো মারামারি দেখেছ?

ম্যাথিওর কথা শুনে একটা ঘটনা মনে পড়ে খুব হাসি পেল। যথাসম্ভব হাসি আড়াল করে বললাম, সিটিতে একটা বারের সামনে একবার মারামারি দেখেছি। সবাই ছিল অতিরিক্ত অ্যালকোহলিক। লোকজন সাধারণত যেভাবে মারামারি করে, ওটা ওইরকম ছিল না। এলোপাতাড়ি কিলঘুষি, খামচি আর ধাক্কাধাক্কি। হাস্যকর ভঙ্গি। তবে কেউ আহত হয়নি। ফাস্ট এইডও দরকার হয়নি।

ম্যাথিও হাসতে হাসতে বলল, আমেরিকাতে এই রকম পরিস্থিতে হয়তো দু–একটা খুন হয়ে যেত।

: হয়তো বা। আচ্ছা, তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

: তেমন জোর দিয়ে এখনো কিছু ভাবছি না। কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িত নই। তবে একটা ডিভাইস আবিষ্কার করতে চেষ্টা করছি। যেটাকে তুমি এনার্জি এনহান্সিং ডিভাইস বলতে পার। এটি কেউ সঙ্গে রাখলে তার আর ড্রাগস নিয়ে শরীর চাঙা করতে হবে না। আশা করছি, এভাবে ড্রাগস ব্যবসায় জড়িত মাফিয়া তৎপরতা পৃথিবীতে কমে আসবে।

: খুব ভালো। শুভ কামনা রইল তোমার প্রতি।

: হ্যাঁ, আরেকটি বিষয়ও খুব জোর দিয়ে ভাবছি। এনার্জি উৎপাদনে তেলের ব্যবহার জিরোতে নিয়ে আসা। কত সহজে এই ব্যবস্থাকে পৃথিবীতে দ্রুত প্রসার ঘটানো যায় তাই ভাবছি। এটা করতে পারলে পৃথিবীতে তেলের রাজনীতি কমবে। মধ্যপ্রাচ্যের রক্তপাতও কমে আসবে বলে আশা রাখি। পাশাপাশি নিকোলা টেসলার অসমাপ্ত পরিকল্পনাগুলো; জানি না কতটুকু পারব।

: খুবই ভালো উদ্যোগ। এসব অনেক সাধনার কাজ। আমার মনে হয় তুমি পারবে। তোমার ওই রকম শক্তিধর ভিত্তি আছে। টেসলার গবেষণা কর্মের কয়েকটি পাতা সরিয়ে নিয়ে তো কয়েকজন পৃথিবীতে সারা ফেলে দিয়েছিল...।

: হ্যাঁ, জানি। ফিজিকসের ইতিহাস এ লজ্জা আমাদের কপালে এঁটে দিয়েছে। মুক্তির উপায় নেই। কী আর করার আছে বলো। মানুষ আসলে এমনই। নিউটনের জীবনেও এমন দু–একটা কাহিনি আছে।

প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললাম, আচ্ছা, তোমার মা? কীভাবে সময় কাটে তাঁর।

: হ্যাঁ, মা একটা ফুলটাইম চাকরি করেন। বয়ফ্রেন্ডও আছে। ডেভিড। খুবই ভালো মানুষ।

: তুমি খুব লাকি। আমার মা নেই। বাবাও নেই।

গাড়িতে চার বছর বয়সী আমাদের ছোট্ট মামনির একটি ছবি সাঁটানো আছে। হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমাদের জড়িয়ে ধরা ছবিটা। এ সময় ছবিটার দিকে ম্যাথিওর দৃষ্টি পড়ল।

: তোমার পরিবার?

: হ্যাঁ তাই।

: ইয়াহু! অ্যাঞ্জেল। হাউ কিউট সি ইজ!

মৃদু হাসিতে ড্রাইভ করেই যাচ্ছি। বিকেল তিনটা। তখন টোল পয়েন্ট পার হয়েছি মাত্র। একটু পরেই গ্রিনফিল্ড এক্সিট নেব। হঠাৎ আড়চোখে খেয়াল করে দেখি ম্যথিও ছবিটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়েই আছে। এম ফাইভ ছেড়ে এক্সিটে ঢুকে পড়েছি।

ম্যাথিও বলল, তোমার বাবা বেঁচে থাকলে, আমাকে আমার দাদা যেমন আদর করতেন; তোমার বাবাও তার এই নাতনিকে এমনই আদর করতেন।

মনটাকে শক্ত রাখতে চেষ্টা করেও পারছি না। কারণ ড্রাইভ করছি। এখন আবেগের সময় নয়। কিন্তু মনের সঙ্গে লড়াই করে হেরে গেছি। চোখদুটো হঠাৎ ঝাপসা হয়েই এল। নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করে চলেছি।

এরই মধ্যে ট্রাফিক লাইটে থামলে ম্যাথিও বলল, তোমাকে দিচ্ছি না। তোমার মেয়েকে দিচ্ছি। আমার যদি এমন একটা বোন বা ভাগনি থাকত। কত আদর যে করতাম।

বলেই ম্যাথিও পাঁচটি এক শ ডলারের নোট ড্যাসর্বোডের ওপর রাখল।

: আরে কর কী!

: না, আর কিছু বলো না। বলছি তো। তোমার মেয়েকে দিয়েছি। তোমাকে নয়। তোমার মেয়েকে একটু আদর সোহাগ করার অধিকার কি আমার নেই?

চুপ করে আছি দেখে ম্যাথিও আবারও বলল, বল, আছে কী নেই?

: হ্যাঁ, অবশ্যই আছে।

মনে মনে বলি, না। এ টাকা আমি কিছুতেই নেব না। দেশে কোনো দরিদ্র পরিবারকে দিয়ে দেব।

তৃপ্তির নিশ্বাস ছেড়ে ম্যাথিও বলে, তোমার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল। তারপর ট্যাব অন করে বলল, তোমার ফেসবুক আইডি বল। আমি বলা মাত্রই আমাকে অ্যাড করে বলল, আচ্ছা। তোমার দেশে অথবা এখানকার বাঙালি কমিউনিটিতে ভালো মেয়ে আছে?

: হ্যাঁ, আছে! কেন?

: আমার জন্য।

: তার মানে তোমার জন্য মেয়ে দেখতে বলছ আমাকে? তুমি কি মজা করছ?

: না, মজা করছি না। সত্যিই বলছি। এ পর্যন্ত দু–একটা মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা যে হয়নি তা নয়, অবশ্যই হয়েছে। তবে ওদের লোভ দেখে নিজেই সরে এসেছি। তাই, খুব করে চাচ্ছি একটা ভালো মেয়ে...।

: কেমন ভালো?

: এই যেমন অনেক ভালোবাসে, মায়া আছে আর বিশ্বস্ত। অনেক নীতিপরায়ণ। কখনো লোভে পড়ে না এমন। তোমার সন্ধানে যদি এমন কোনো মেয়ে থাকে; আমাকে বলবে? যদি আমার জীবনসাথি হতে রাজি হয়।

নিভৃতচারী গুহাবাসী মানুষের মতো জীবন আমার। অফিস আর লাইব্রেরি রুমের বাইরে আমার কোনো জীবন নেই। এখন এই ছেলের জন্য আমি ওই রকম মেয়ে কোথায় খুঁজব? কী আর করা। এত আশা করে ছেলেটা অনুরোধ করল, মুখের ওপর না বলি কী করে।

বললাম, হ্যাঁ, আমি খুঁজে দেখব। আন্তরিকভাবেই চেষ্টা করব।

: অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো, আমি দাদা আর বাবার সবগুলো টাকা একত্র করে কোনো বৃদ্ধাশ্রমে অথবা কোনো অনাথাশ্রমে দিয়ে দেব। আমরা দুজনে মিলে একই অফিসে চাকরি করব। শূন্য থেকে শুরু হবে আমাদের জীবন। কারণ, অপরাধ মানুষের মনকে অস্থির করে দেয়। শান্তি–সুখ দুটোই তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়। তাই আমি এটাই চাই যে, এই সব প্রতারণার টাকা আমাদের জীবনে ঢুকবে না। তখন আমার জীবনটা কেমন হয়, দেখার খুব ইচ্ছে।

খুব ভালো। আচ্ছা দেখব। অবশ্যই দেখব।

জিপিএস ফলো করে ইতিমধ্যেই পার্লামেন্ট রোডের একটি বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামলে অনুরোধ করে ম্যাথিও বলল, প্লিজ, যোগাযোগ রেখ।

: অবশ্যই।

গাড়ি থেকে নেমে ক্রমে দৃশ্যান্তরে মিলিয়ে গেল ম্যাথিও। একটা শান্তির নিশ্বাসে আপন মনে বলি—কত অদ্ভুত মানুষ যে এ জগতে আছে...।
...

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>