একটি সরল নদীর গল্প-নয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাসায় আজ রান্নাবান্না করতে হয়নি। আগের দিনই জাহিদ ও আজমল হোসেন চার-পাঁচ দিনের রান্না একসঙ্গে করে ফ্রিজে রেখেছে। তাই ওরা আজ রাতের খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। আজমল হোসেন বেডরুমে লেপ মুড়ি দিয়ে শোয়ার পর কিছুক্ষণের মধ্যে নাক ডাকতে শুরু করেছেন। জাহিদ লেপ মুড়ি দিয়ে সোফায় শুলেও তার তাড়াতাড়ি ঘুম আসে না। সাধারণত রাত সাড়ে নয়টা-দশটার আগে সে ঘুমাতে যায় না। কখনো কখনো তার ঘুমাতে ঘুমাতে এগারোটা বেজে যায়। বেশির ভাগ সময়ই সে টিভি দেখতে দেখতে ঘুমায়।

এখন সবে সাড়ে সাতটা বাজে। আজও শীতটা বেশ জেঁকে পড়েছে। বাইরের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে না হলেও বড়জোর চার-পাঁচ ডিগ্রি হবে। ভোরের দিকে তা হিমাঙ্কের নিচে নেমে যাবে। আজ ওদের কাজ বেশি দূরে ছিল না। তাওরাঙ্গার কাছাকাছি বেথেলেহ্যাম রোডে ছিল। বেথেলেহ্যাম আবাসিক এলাকার কাছাকাছি বেথেলেহ্যাম কিউই ফলের অরচার্ডে ওদের কাজ ছিল। তাদের বাসা থেকে মাত্র দশ মিনিটের ড্রাইভ। আরও সাত দিন ওখানে কাজ চলবে।

জাহিদ সোফায় শুয়ে আজ টিভি চালু করল না। বুধবারে রাতে টিভিতে বিশেষ কোনো প্রোগ্রাম থাকে না। সাধারণ টক শো, বিভিন্ন ধারাবাহিক অনুষ্ঠান, ধারাবাহিক নাটক আর লম্বা লম্বা বিজ্ঞাপন। মঙ্গলবারেও একই অবস্থা। শুক্র-শনি ও রোববারে টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে মুভি চলে। সোমবার বা বৃহস্পতিবারেও কোনো কোনো চ্যানেলে নতুন বা পুরোনো মুভি দেখায়।

জাহিদ সাধারণত ধারাবাহিক নাটকগুলো দেখে না। টক শো বা ধারাবাহিক অনুষ্ঠানগুলো তো বিরক্তিকর। জাহিদদের বাসায় স্কাই স্যাটেলাইটের কোনো কানেকশন নেই। কোনো কালে ছিলও না। তাই ইচ্ছে করলেই সে যেকোনো মুভি চ্যানেলে মুভি দেখতে পারে না।

অনেকক্ষণ ধরেই জাহিদ সোফায় ঝিম মেরে শুয়ে আছে। সে ভালো করেই জানে, তার এখন মোটেও ঘুম আসবে না। তারপরও সে সোফায় পা মেলে টান টান হয়ে শুয়ে রইল। তার আজ শিরিনকে খুব মনে পড়ছে। শিরিনের সঙ্গে তার কথা হয় না প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেছে। তাদের মাঝেমধ্যে এমনটাই হয়। কখনো কখনো তাদের সপ্তাহের সাত দিনই কথা হয়। কখনো আবার এক মাসেও একবার কথা হয় না। তবে জাহিদ জানে, এটা সত্য যে ওদের প্রেমটা যেমনই হোক, শিরিন তার মাকে যেভাবে আগলে রাখছে, অন্য কেউ তা আগলে রাখত না।

শিরিন জাহিদের মামাতো বোন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণে অনার্স পড়ছে। বয়সে জাহিদের চেয়ে দশ বছরের ছোট। ওদের প্রেমটা ঠিক গতানুগতিক পথে প্রেম হয়নি। অনেকটা জাহিদের মার পছন্দেই প্রেমটা হয়। জাহিদ যখন নিউজিল্যান্ড আসে তখন শিরিন সবে কলেজে শুরু করেছে। মায়ের খবরাখবর নেওয়ার জন্য জাহিদের একমাত্র অবলম্বন ছিল শিরিন। সেই থেকে শিরিনের তার প্রতি অপেক্ষা। মা শিরিনকে এক রকম কথাই দিয়ে ফেলেছেন। জাহিদও মেনে নিয়েছে।

শিরিনকে যে জাহিদের ভালো লাগে না, তা নয়। বেশ ভালো লাগে। ফোনে কথা বলতে বলতে, ফেসবুক মেসেঞ্জারে লিখতে লিখতে নিউজিল্যান্ডে আসার পরপরই ওদের প্রেমটা হয়ে যায়। নিউজিল্যান্ডে আসার পরপর জাহিদ শিরিনকে বেশ চিঠি লিখত। ওসব চিঠিতে প্রেমের কথা যতটুকু না, মার কথাই বেশি লেখা থাকত। কিন্তু তারপরও তো চিঠি লেখা হতো। তারপর স্কাইপ, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুক মেজেঞ্জার আসার পর চিঠি লেখা পায় বন্ধই হয়ে যায়। আজ অনেক দিন পর জাহিদের আবার শিরিনকে একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে। হাতে কোনো কাজ নেই বলেই তার এই ইচ্ছেটা।

টিভির পাশেই বাজারের হিসাব ও কাজের হিসাব রাখার জন্য একটা বড় খাতা। জাহিদ সেই বড় খাতা থেকে দুটো পাতা ছিঁড়ে শিরিনকে চিঠি লিখতে বসল।

প্রিয় শিরিন,

শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা নিয়ো।

আমি জানি তোমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। আমিও এদিকে খুব ব্যস্ত ছিলাম। তাই তোমাকে গত তিন সপ্তাহ রিং করিনি। তোমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে। পরীক্ষা শেষে নিশ্চয়ই তুমি আমাদের ওখান থেকে ঘুরে আসবে। মাকে ডাক্তার দেখিয়ো। আমাদের বাড়িতে কিছুদিন থেকে এসো।

তুমি নিশ্চয়ই আমার চিঠি পেয়ে অবাক হবে। অনেক দিন পর তোমাকে চিঠি লিখছি। চিঠি লিখতে বসে আমার নিজের কাছেই অবাক লাগছে। আজকাল তো কেউ কাউকে চিঠি লেখে না। পৃথিবীতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের চিঠি লেখা প্রায় বন্ধ হয়েই গেছে। আজকাল পোস্ট শপ বা পোস্ট অফিসগুলো দাঁড়িয়ে আছে শুধুমাত্র অফিশিয়াল লেটার আর পার্সেল পাঠানোর জন্য। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, নিউজিল্যান্ডের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এখনো একজন আরেকজনকে প্রচুর চিঠি লেখেন। সত্যি বলতে কী, চিঠি লেখায় যে ভাব-ভালোবাসা প্রকাশ করা যায়, অন্য কোনো মাধ্যমে তা মোটেও সম্ভব নয়।

তোমার সঙ্গে সর্বশেষ যখন কথা বলি তখন তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে, আর কত অপেক্ষা করতে হবে? অপেক্ষার কী শেষ নেই? তোমাকে একটা কথা বলি। তোমার ভালোবাসার কারণেই কিনা, আজ আমার তো নিউজিল্যান্ডে একটা গতি হয়েছে। এখন আমার নিউজিল্যান্ডে পার্লামেন্ট রেসিডেন্সি আছে। এ দেশের সিটিজেন হওয়াটা শুধু সময়ের ব্যাপার। কিন্তু এ দেশি যে মেয়েকে কাগজের বিয়ে করেছিলাম, তার সঙ্গে আমার সেপারেশন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ডিভোর্স হয়নি। এ দেশের নিয়ম অনুযায়ী ডিভোর্সের জন্য দুই বছর অপেক্ষা করতে হয়। তারপর আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব। তখন অবশ্য তোমাকে বিয়ে করে নিউজিল্যান্ডে আনতে বেশি সময় লাগবে না। আরেকটু ধৈর্য ধরো লক্ষ্মীটি। এরই মধ্যে তুমি মাস্টার্সটাও শেষ করে আসতে পারবে। আমি নিজে তো টাকাপয়সার অভাবে মাস্টার্স করতে পারলাম না। তোমার সুযোগ আছে, তুমি শেষ করবে না কেন?

আমি এখন যে কাজ করি, কাজটা আমার মোটেও পছন্দের নয়। খুব কঠিন কাজ। কিন্তু অবাক ব্যাপার, আমার কাছে কাজটা কঠিন মনে হলেও আজমল স্যারের কাছে কাজটা কঠিন মনে হচ্ছে না। এমনকি অনেক বাঙালি বধূরাও স্বামীর সঙ্গে গিয়ে কিউই ফ্রুটের অরচার্ডে এই কাজটা করছে। ওরা বেশ আনন্দের সঙ্গেই কাজটা করছে। কিউই ফ্রুটের অরচার্ডে কাজ করে এখানে অনেকে দুই-তিনটা বাড়িও কিনেছে। একটা মজার গল্প বলি। এক ভদ্রলোক বউ-ছেলে নিয়ে নিউজিল্যান্ড থেকে বাংলাদেশ বেড়াতে গিয়েছেন। ভদ্রলোকের ছেলের বয়স আট কী নয় বছর। বাংলাদেশ যাওয়ার পর আত্মীয়স্বজন ভদ্রলোকের ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, তোমার বাবা নিউজিল্যান্ডে কী করেন? ছেলে ফটাফট উত্তর দেয়, আব্বু ডাল কাটে, আম্মুও ডাল কাটে। আমিও মাঝেমধ্যে কিউই ফ্রুটের বাগানে গিয়ে ডাল কাটি...! ভদ্রলোকের আত্মীয়স্বজন তার ছেলের কথা বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

কিন্তু শিরিন, আমার কাছে কেন কাজটা এত কঠিন মনে হচ্ছে, আমি তা বুঝতে পারছি না। সকালে অরচার্ডে গিয়ে যখন ঘাসের ওপরের পাতলা বরফ পায়ের নিচে মচমচ করে ভেঙে কাজ শুরু করি, তখন দীর্ঘ সারির পাতাহীন কিউই ফ্রুটের গাছগুলো দেখে আমার কাছে বিরানভূমি মনে হয়। কিছুক্ষণ গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে দিশেহারা হয়ে উঠি। আমি দীর্ঘদিন হেস্টিংস শহরে আপেল বাগানে কাজ করেছি। ওই কাজটাও কঠিন। কিন্তু কিউই ফ্রুটের কাজের মতো এত কঠিন না।

আজমল স্যার বেশ ভালো আছেন। আগের মতো টাকাপয়সার টেনশনে ভোগেন না। কোনো কোনো সপ্তাহে তার ইনকাম আমার চেয়েও বেশি হয়। এখানের কাজগুলো কন্ট্রাক্টের কাজ। যত কাজ করবে, তত টাকা। কিন্তু আজমল স্যারকে নিয়ে অন্য আরেকটা টেনশনে আছি। হেস্টিংস শহর ছাড়ার আগে স্যারের ব্যাপারে তোমাকে তো বলেছি। স্যার এখন নিউজিল্যান্ডে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। যেকোনো সময় তিনি ইমিগ্রেশন অফিসার বা পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যেতে পারেন। যদিও অনেকে আট-দশ বছর ধরে অবৈধভাবে বসবাস করে এখানে কাজ করছে।

আজমল স্যার মনে হয় না এ ব্যাপারটা নিয়ে কোনো টেনশনে আছেন। তিনি নিজের বর্তমান অবস্থান মেনেই নিয়েছেন। তবে তিনি যে কিউই ফ্রুটের অরচার্ডে ভালো কাজ করতে পারছেন, এতেই তিনি খুশি। কিন্তু আমি স্যারকে নিয়ে বেশ টেনশনে আছি। এ বছর ইমিগ্রেশন আর পুলিশ মিলে তাওরাঙ্গা-টিপুকির বিভিন্ন কিউই ফ্রুটের অরচার্ডে গিয়ে নিউজিল্যান্ডের অবৈধ বসবাসকারীদের ধরছে। যদিও ওদের আসার আগেই অরচার্ডে খবর চলে আসে। আর কিউই ফ্রুটের অরচার্ড এত বড় যে, তাদের আসার খবর শোনা মাত্র দৌড়ে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকা যায়। কিন্তু সমস্যা স্যারকে নিয়ে। ওদের দূর থেকে দেখামাত্র স্যার যে কোথাও গিয়ে দৌড়ে লুকাবে, তাঁর সেই ক্ষমতা বা বুদ্ধিও নেই।

তাওরাঙ্গা শহরটা অনেক সুন্দর। তাওরাঙ্গা শহরের পাশেই মাউন্ট মাঙ্গানুই বিচ। মাউন্ট মাঙ্গানুই বিচটা পৃথিবীর সের দশটা বিচের একটা বিচ। তুমি নিউজিল্যান্ডে এলে তোমাকে নিয়ে প্রাণভরে ঘুরব। নিউজিল্যান্ডে কত যে দেখার জিনিস আছে!

অনার্স পরীক্ষার পরপর তুমি আমাদের বাড়িতে যাবে বলেছিলে। তখন মাকে ডাক্তার দেখিয়ো। এবার বাড়িতে গিয়ে মার কাছেই বেশি থেকো। আমার চিন্তা কর না। আমি অনেক ভালো আছি। কিউই ফ্রুট অরচার্ডের কাজটা আমার ভালো লাগছে না। কিন্তু এই কাজটা আমি বেশি দিন করব না। হ্যামিল্টনে আমার কলেজজীবনের এক বন্ধু আছে। ওখানে গিয়ে একটা কোর্সে ভর্তি হব। এখানে লেখাপড়া করলে চাকরি পাওয়া যায়। তুমি আসার আগেই হয়তো চাকরিতে ঢুকব। কিন্তু সমস্যায় আছি আজমল স্যারকে নিয়ে। তবে স্যার যেহেতু কিউই ফ্রুট অরচার্ডের কাজটা করতে পারছেন, তাই তাঁর কাজের অভাব হবে না।

তুমি ভালো থেকো লক্ষ্মীটি। শরীরের যত্ন নিয়ো। অনেক ভালোবাসা রইল।

ইতি,

জাহিদ।

চিঠি লেখা শেষ করে জাহিদ একটা ভারী নিশ্বাস নিল। অনেক দিন পর সে কাউকে এত বড় চিঠি লিখেছে। নিউজিল্যান্ডে আসার পর পর প্রথম প্রথম সে শিরিনকে বেশ চিঠি লিখত। তবে সেসব চিঠিতে তার মার কথাই বেশি থাকত। মাঝখানে অনেক দিন সে চিঠি লেখেনি। আজ লিখল।

জাহিদ চিঠিটা ভাঁজ করে খাতাটার ভেতরেই রাখল। তারপর শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিয়ে পা দুটো টান টান করল। ঘড়ির দিকে তাকাল। সবে সাড়ে আটটা বাজে। টিভিটা ছাড়বে কিনা ভাবল। কিন্তু আজ কেন জানি তার টিভি ছাড়তে ইচ্ছে হলো না।

আজমল হোসেন বেডরুমে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। দেয়ালে ঘড়িটা চলছে টিক টিক, টিক টিক। বাইরে থেকে একটানা ঝিঁঝি পোকার ডাক আসছে, ঝিঁ-ই-ই, ঝিরিত ঝিরিত। বাইরে যে শীতটা জেঁকে পড়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে এরই মধ্যে কুয়াশার টুপটাপ জল পড়ার শব্দ শোনে। স্লিপ আউটের ছাদটা করোগেটেড আয়রনের। কুয়াশার টুপটাপ জল পড়ার শব্দ, বৃষ্টির শব্দ ভেতরে বসে স্পষ্টই শোনা যায়।

জাহিদ লম্বা সোফাটায় লেপ মুড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ পা ছেড়ে টান টান হয়ে শুয়ে রইল। কনকনে শীতের কারণে লেপ মুড়ি দিয়ে থাকলেও লাউঞ্জে নয় ফিনের একটা ইলেকট্রিক ওয়েল হিটার চলছে। ওয়েল হিটারটা কিছুক্ষণ পরপর তাপমাত্রার ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে ক্লিক ক্লিক শব্দ করছে। এ ছাড়া, রাতের একধরনের নিস্তব্ধতার শব্দ।

দরজায় তখনই কেউ একজন নক করল। জাহিদ কান খাঁড়া করল। ভাবল, এই শীতের রাতে তার বাসায় কে আসবে? হেদায়েত ভাই নয় তো?

জাহিদ জিজ্ঞেস করল, কে?

বাইরে হেদায়েত হোসেনই। তিনি গলা বাড়িয়ে বললেন, আমি হেদায়েত। জাহিদ, দরজা খোলো।

জাহিদ ব্যস্তভাবে সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল, জি হেদায়েত ভাই, আমি এখনই দরজা খুলছি।

হেদায়েত হোসেন বললেন, তাড়াতাড়ি খোলো। বাইরে মনে হচ্ছে শীত পড়ছে না, বরফ পড়ছে!

জাহিদ দরজা খুলে বলল, তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢোকেন। এই শীতের মধ্যে আসার কী দরকার ছিল? ফোনেই তো কথা বলতে পারতেন?

হেদায়েত হোসেন ভেতরে ঢুকে একটা সিঙ্গেল সোফায় বসে বললেন, কথাগুলো ফোনে বলার মতো না, তাই আসলাম। আর আমার মনটা খুব খারাপ। তাই ভাবলাম, তোমার সঙ্গে একটু গল্প করে যাই।

জাহিদ দরজা বন্ধ করে আগের স্থানে বসতে বসতে বলল, এসেছেন ভালো করেছেন। আপনার কি শীত লাগছে? তাহলে বেডরুম থেকে একটা কম্বল এনে দিই। মুড়ি দিয়ে বসেন। বেডরুমে এক্সট্রা কম্বল আছে।

হেদায়েত হোসেন বললেন, না না, লাগবে না। গাউনের নিচে অনেক গরম কাপড় পরেছি। এ ছাড়া, তুমি এখানে হিটার চালিয়ে রেখেছ। আমার তেমন শীত লাগছে না।

: আমার লাগছে। লেপের নিচে থেকেও মনে হচ্ছে শীতে জমে যাচ্ছি। আচ্ছা, চা বা কফি খাবেন?

: তুমি খাবে?

: আপনি খেলে হয়তো আমার জন্যও এক কাপ বানাব।

: আচ্ছা, বানাও। কিন্তু তুমি এখন আবার কষ্ট করে বানাবে?

: কষ্ট কীসের? পানি নিয়ে হট ওয়াটার জগ অন করে দেব। চা না কফি খাবেন?

: কফি খাব না। ঘুমের সমস্যা হবে। চা বানাও। রং চা বানাও। চিনি দিয়ো না। ডায়াবেটিক রোগী তো।

জাহিদ সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে বলল, আমিও রং চা-ই খাব।

লাউঞ্জের এক পাশেই ছোট্ট কিচেন। বেঞ্চটপটা যেন আরও ছোট। বেঞ্চটপের এক পাশে হট ওয়াটার জগ। হট ওয়াটার জগে আগে থেকেই পানি অর্ধেক ভরা ছিল। জাহিদ হট ওয়াটার জগটা শুধু অন করে দিল।

জাহিদ ছোট্ট শেলফ থেকে দুটো কাপ নিয়ে বেঞ্চটপের ওপর রাখতেই হেদায়েত হোসেন গলা বাড়িয়ে বললেন, এই বাসাটা তোমাদের জন্য খুব ছোট হয়ে গেছে, তাই না?

জাহিদ হেসে বলল, হেদায়েত ভাই, এটা সত্য। বাসাটা আমাদের জন্য আসলেই ছোট। এত ছোট বাসায় আগে কখনো থাকিনি তো। আরেকটা বেডরুম হলে ভালো হতো।

হেদায়েত হোসেন মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, আমি বুঝতে পারছি। আসলে স্লিপ আউটে দুটো বেডরুম খুব কম থাকে। স্লিপ আউট এক বেডরুমেরই হয়।

: আমি জানি। কিন্তু আমাকে এই ড্রয়িংরুমেই ঘুমাতে হচ্ছে, এই যা।

: কেন, বেডরুমে সমস্যা কী?

: স্যারের নাক ডাকা তো কাছ থেকে কখনো শোনেনি। একবার শুনলে বুঝতেন।

হেদায়েত হোসেন শব্দ করে হেসে ফেললেন। হাসি ধরে রেখেই জিজ্ঞেস করলেন, স্যার কোথায়? বেডরুমে?

জাহিদ বলল, জি।

: স্যার কী এখন সজাগ?

: না না, সেই কখন কাজ থেকে এসে শাওয়ার করেই দুই মুঠো খাবার মুখে দিয়ে ঘুমাতে চলে গেছেন! হেদায়েত ভাই, আপনি একটু কান পাতেন। স্যারের নাক ডাকার শব্দ আপনার ওখান থেকেও শুনতে পাবেন।

হেদায়েত হোসেন কান পেতে কিছুক্ষণ পর বলে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, শোনা যাচ্ছে। হা হা হা।

জাহিদ চায়ের কাপে পাতা দিয়ে হট ওয়াটার জগ থেকে পানি ঠেলে চামচে নেড়ে নিয়ে এল। সে নিজের কাপেও চিনি নিল না। সে যে চিনি ছাড়া চা খায়, তা নয়। কিন্তু তার শেলফ থেকে চিনির কৌটা নামিয়ে চিনি নিতে ইচ্ছে হলো না।

একটা চায়ের কাপ হেদায়েত হোসেনের দিকে এগিয়ে দিয়ে জাহিদ নিজের সোফায় গিয়ে বসল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, হেদায়েত ভাই, টিভি ছেড়ে দেব?

হেদায়েত হোসেন বললেন, না না, টিভি ছাড়ার দরকার নেই। স্যারের ঘুমের ডিস্টার্ব হবে।

: স্যারের কোনো ডিস্টার্ব হবে না। স্যার ঘুমালে দুনিয়ার কোনো খবর থাকে না। স্যারকে এখান থেকে এক শটা ডাক দেন, আপনি কোনো সাড়া পাবেন না।

: তাই নাকি।

: জি, অনেক দিন ধরে একসঙ্গে থাকছি তো। স্যারকে আমি ভালো করেই জানি। তবে ভাবির যেদিন ইনসিডেন্টটা হলো সেদিন বাসায় ফিরে দেখি স্যার ঘুম থেকে জেগে বসে আছেন। তাকে আর ঘুম থেকে জাগাতে হয়নি।

হেদায়েত হোসেন এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। একটা দীর্ঘশ্বাসও ছাড়লেন।

জাহিদ বলল, সরি। আপনাকে ভাবির কথা মনে করিয়ে দিলাম!

হেদায়েত হোসেন বললেন, না না, অসুবিধা নেই। তোমার ভাবির জন্য মন খারাপ বলেই তো তোমার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি। আচ্ছা, তুমি কত বছর হলো স্যারের সঙ্গে আছ?

: প্রায় ছয় বছর হয়ে যাচ্ছে।

: বেচারা অনেক দিন থেকেও কিছু করতে পারলেন না। স্যারের জন্য সত্যি কষ্ট হয়।

: জি, হেদায়েত ভাই। তবুও তো আপনি স্যারের সব জেনে কাজ দিয়েছেন।

হেদায়েত হোসেন মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু বলতে যাওয়ার আগে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। চুমুক দেওয়া মাত্রই বেশ প্রফুল্লচিত্তে বললেন, আহা, মনে হচ্ছে কত দিন পর কেউ এভাবে আমাকে চা বানিয়ে দিয়েছে। তোমার ভাবি চলে যাবার পর আর তো এভাবে কেউ চা বানিয়ে দেয়নি। আমার জীবনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।

জাহিদ জিজ্ঞেস করল, ভাবির কথা খুব মনে পড়ছে?

হেদায়েত হোসেন মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, জাহিদ, মনে তো পড়বেই। ছয় বছর প্রেম করার পর বিয়ে করে ষোলো বছর সংসার করেছি। জানি তোমার ভাবির মাথায় একটু প্রবলেম ছিল। বিয়ের আগে বুঝতে পারিনি। কিন্তু এই প্রবলেমটা জেনেও আমরা ষোলো বছর সংসার করেছি।

: ভাবি না আপনার খালাতো বোন ছিলেন? বিয়ের আগে কি ভাবির প্রবলেমটা ধরতে পারেননি?

: না। আর তোমার ভাবি খুব সুন্দর ছিল তো। তাই ওসব প্রবলেম কোনো প্রবলেমই মনে হয়নি। আর সে তো পাগল ছিল না। মাঝেমধ্যে পাগলামির ভূত চাপত। পাগল হলে কী তার সঙ্গে ষোলো বছর সংসার করতে পারতাম?

জাহিদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তা অবশ্য ঠিক। ভাবি মারা যাওয়ার আগে আমি তাঁকে তো দেড়-দুই মাস কাছ থেকে দেখেছি। আমার কাছে কিন্তু কখনো মনেই হয়নি ভাবির মানসিক কোনো সমস্যা আছে। বরং মনে হয়েছে, তিনি খুব চুপচাপ ধরনের অমায়িক একজন মহিলা।

হেদায়েত হোসেন একটা ভারী নিশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। তোমার ভাবির এমনিতে কোনো সমস্যা ছিল না। হঠাৎ হঠাৎ মানসিক ভারসাম্য রাখতে পারত না। তাও আবার বছরে এক-দুই মাস। এ জন্য তাওরাঙ্গার কিছু ফ্যামিলি দায়ী। ওরা জানত, লাকির সামান্য মানসিক সমস্যা আছে। কিন্তু তারপরও তাকে মানসিক চাপ দিত। উল্টাপাল্টা কথা বলত।

: কী উল্টাপাল্টা কথা বলত?

: কত কী উল্টাপাল্টা কথা! এই ধর কোনো ফিমেল ওয়ার্কার অরচার্ডে আমার অধীনে কাজ করছে। কত ধরনের ফিমেল ওয়ার্কারই থাকে। ইস্ট ইউরোপ, সাউথ আমেরিকা বা কোনো প্যাসিফিক আইল্যান্ডের। আমি সেই ফিমেল ওয়ার্কারের সঙ্গে কোনো কারণে অরচার্ডে কথা বললাম। ব্যস, ওটা তোমার ভাবির কানে চলে আসবে। কী কথা আসবে ওটা আমি জানতে পারি না। কিন্তু ততক্ষণে তোমার ভাবির মাথাটা খারাপ করে দেবে।

: এটা তো খুব অন্যায় কথা!

: শুধু কী অন্যায়, মহা অন্যায়। আসলে আমাদের এই বিদেশে বাঙালি সমাজটা খুব খারাপ। এখানকার বাঙালিরা সব উচ্চশিক্ষিত তো। উচ্চশিক্ষিতরা খারাপ হলে যা হয়।

জাহিদ বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন।

হেদায়েত হোসেন মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বললেন, আচ্ছা, বাদ দাও ওসব কথা। তোমাকে যে কথা বলার জন্য এ সময় এসেছি। স্যারকে নিয়ে একটু সমস্যায় পড়ে গেছি।

: কোন স্যার? আমাদের আজমল স্যার?

: হ্যাঁ, আজমল স্যার।

: স্যারের আবার কী হয়েছে?

: স্যারের কিছু হয়নি। কিন্তু সমস্যাটা হয়েছে, ইমিগ্রেশন অফিসার ও পুলিশ মিলে বিভিন্ন অরচার্ডে অবৈধ নাগরিক ধরার জন্য রেড দিচ্ছে।

: আমি যত দূর জানি, ওরা বিভিন্ন ইনফরমেশন ওপর নির্ভর করে রেড দেয়। এমনি এমনি রেড দিতে গেলে তো ওরা সারা জীবনও কাউকে খুঁজে পাবে না। তাওরাঙ্গা ও টিপুকিতে যে বড় বড় অরচার্ড! আর একেকটা অরচার্ডে বারো-চৌদ্দটা করে ব্লক।

: ওরা তথ্যের ভিত্তিতেই রেড দেয়। স্যারের তো এখন কোনো কাগজপত্র নেই। তাঁর কাজ করারও কোনো অনুমতি নেই।

: জি, হেদায়েত ভাই। এটা সত্য, স্যার এখন নিউজিল্যান্ডের অবৈধ নাগরিক। ওভার স্টেয়ার। কিন্তু তার ব্যাপারে কে তথ্য দেবে? তাঁকে তো এখানে কেউ ভালোভাবে চেনে না। অফিস–আদালতেও তাঁর এখানকার কোনো ইনফরমেশন নেই। স্যার যে তাওরাঙ্গা আছেন, ওটা হেস্টিংসের সাইদ ভাই, আপনি, আমি আর আপনার কিছু ওয়ার্কার বাদে কেউ তো জানে না।

: আজমল স্যারকে এখানকার কেউ না চিনলেও আমাকে তো সবাই চেনে। আমি স্যারকে কাজ দিয়েছি, ওটাই যথেষ্ট।

: আমি আপনার কথাটা ঠিক বুঝলাম না।

হেদায়েত হোসেন একটু ঝুঁকে চায়ের কাপটা সামনের টি টেবিলের ওপর রেখে বললেন, জাহিদ, স্যার যে অবৈধ, এই ইনফরমেশন স্যারের প্রতি শত্রুতা করে কেউ ইমিগ্রেশনে পাঠাবে না। আমার প্রতি শত্রুতা করে পাঠাবে। এখানে বাঙালি কন্ট্রাক্টররা একজন আরেকজনের কাঁচা মাংস চিবিয়ে খায়। তবে হ্যাঁ, সবাই নয়। আমার মতো নিরীহ গোছের কয়েকজন কন্ট্রাক্টর, যেমন মোজাম্মেল হোসেন, হায়দার আলী, জাকির হোসেন, মোসলেম উদ্দিনের কথা আলাদা। তারা কারও পিছে লাগতে যায় না। নিজেদের ওয়ার্কারদের নিয়েই সন্তুষ্ট। কিন্তু তিন জয়নালের কথা কে বলবে?

জাহিদ জিজ্ঞেস করল, তিন জয়নাল?

: হ্যাঁ, তিন জয়নাল। জয়নাল আবেদিন, জয়নাল হোসেন ও ফকরুদ্দিন জয়নাল।

: ওদেরকে তো চিনতে পারলাম না?

: আমি ওদের আরেকটা নাম বললে চিনতে পারবে।

: কী নাম?

: ম্যারিড জয়নাল, চুলওয়ালা জয়নাল ও পিচ্ছি জয়নাল।

জাহিদ হেসে ফেলল। বলল, আমি ওদের নাম শুনেছি। কিন্তু কখনো কাছ থেকে দেখিনি।

হেদায়েত হোসেন বলল, ওদের সঙ্গে না দেখা হওয়াই ভালো। ওরা পারে না এমন কোনো কাজ নেই।

: ওরা আমার কী করবে?

: তোমার কিছু করতে পারবে না। তুমি নিউজিল্যান্ডের পারমানেন্ট রেসিডেন্ট। কিন্তু আজমল স্যারের করবে। তিন জয়নাল অনেক বাঙালির ক্ষতি করেছে। এদের কারণে বাঙালিরা নিউজিল্যান্ডে অবৈধ হয়ে বেশি দিন অরচার্ডে কাজ করতে পারে না। ইমিগ্রেশন অফিসার বা পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যায়। অথচ দেখ, ইন্ডিয়ার পাঞ্জাবি ওয়ার্কার বা ফিজির ওয়ার্কাররা দশ-বারো বছর অবৈধভাবে বসবাস করেও ধরা পড়ে না। দিব্যি কাজ করে যাচ্ছে।

: এই তিন জয়নাল এরকম কেন?

: ওরা চায়, ওরাই শুধু কন্ট্রাক্টরি করবে। অরচার্ডে রাজত্ব করবে। বাঙালিদের মধ্যে ওটাই যেন ওদের রাজত্ব। আমরা যারা নিরীহ কন্ট্রাক্টর, তারা না পারছি তিন জয়নালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে, না পারছি ওদের দমিয়ে রাখতে। আসলে আমরা তো ওদের মতো এত নিচে নামতে পারি না!

: ওদের কি ওয়ার্কার কম?

: কমই। আর বাঙালিরা কেউ ওদের সঙ্গে কাজ করতে চায় না। কারণ ওরা অরচার্ডের কাজ নিয়ে মালিকের কাছ থেকে তো কমিশন নেয়ই, ওয়ার্কারদের কাছ থেকেও ভাগ বসায়?

: ভাগ বসায় মানে, কমিশন নেয়?

: হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ। কিন্তু আমরা মালিকের কমিশনটা নেই। ওয়ার্কারদের কাছ থেকে কমিশন নেই না। এতেই ওদের গাত্র জ্বালা।

: হেস্টিংসেও আপেল অরচার্ডে বেশ কয়েকজন বাঙালি কন্ট্রাক্টর আছে। ওখানে তো কেউ কারও পিছে এমনভাবে লাগে না? বরং ওদের মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্ক।

হেদায়েত হোসেন মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ওখানে যে তিন জয়নাল নেই!

জাহিদ শব্দ করে হেসে ফেলল। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>